বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

৪টি হত্যা মামলার আসামি থাকার পরও বহাল ইউপি চেয়ারম্যান

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি
  ০৩ জুন ২০২৫, ২১:১৭
৪টি হত্যা মামলার আসামি থাকার পরও বহাল ইউপি চেয়ারম্যান
ছবি: যায়যায়দিন

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১২ নং চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উত্তরবঙ্গের মাদকসম্রাট আওয়ামীলীগ নেতা শাহীদ রানা টিপু দীর্ঘ ১০ মাস ধরে পলাতক থাকা সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে চারটি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতা এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় ইউনিয়নবাসী চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এই অবস্থার প্রতিবাদে সোমবার (২ জুন) দুপুরে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন এলাকার সাধারণ মানুষ।

‘সেবাবঞ্চিত ইউনিয়নবাসী’ ব্যানারে আয়োজিত এ মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ২০২৫ সালের আগস্ট থেকে চেয়ারম্যান টিপু পলাতক। এর ফলে ইউনিয়নের নাগরিকরা প্রায় সকল সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ভাতা, জন্ম-মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশন, সরকারি বরাদ্দ কিংবা প্রকল্প অনুমোদনের মতো প্রাথমিক সেবা থেকেও মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন। বক্তারা দ্রুত টিপুকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত এবং তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। দাবি না মানলে ইউনিয়ন পরিষদে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন তারা।

1

মানববন্ধনে অংশ নেওয়া স্থানীয় বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, “চেয়ারম্যান তো চারটা খুন করে পালিয়ে আছে। কিন্তু তাই বলে কি ইউনিয়ন পরিষদ বন্ধ থাকবে? ইউপি সদস্যরা তো আছেন, তারা কাজ করতে পারেন। কিন্তু তারাও অফিসে আসেন না। তাদের কাছে গেলেও সাড়া মেলে না।” তিনি অভিযোগ করেন, ইউপি সদস্যরা বেতন-ভাতা না পাওয়ার অজুহাতে দায়িত্ব পালনে গড়িমসি করছেন, যার ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে।

ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী অফিসার আঞ্জুমান সুলতানা বলেন, আমি নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মানববন্ধনে অংশ নেওয়া মো. ইসমাইল হক বলেন, “একজন ইউপি চেয়ারম্যান চারটি খুনের আসামী! এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে?” তিনি অভিযোগ করেন, এসব মামলায় টিপু পলাতক থাকলেও কখনোই তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। বরং তার বিরুদ্ধে কথা বললেই হুমকি আসে। তিনি আরও বলেন, “আইজিপি-ডিআইজি পর্যায়ের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক, টাকার কাছে সবাই বিক্রি হয়ে গেছে।”

২০১৮ সালের ১০ মার্চ: এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষের জেরে বোমা হামলায় নিহত হন আইয়ুব আলী। এই মামলার চার্জশিটে প্রধান আসামী করা হয় চেয়ারম্যান শাহীদ রানা টিপুকে।

২০২৩ সালের ২৩ এপ্রিল: সদর উপজেলার সুন্দরপুর এলাকায় বালুমহল দখল নিয়ে বিরোধের জেরে বোমা হামলায় নিহত হন জিয়াউর রহমান। তার স্ত্রী মিলিয়ারা বেগম চেয়ারম্যান টিপুকে প্রধান আসামী করে মামলা দায়ের করেন।

২০২৩ সালের ১৯ এপ্রিল: চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের উদয়ন মোড়ে যুবলীগ নেতা খাইরুল আলম জেমকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই মামলারও অন্যতম আসামী টিপু চেয়ারম্যান।

২০২৫ সালের ১২ জানুয়ারি: চরবাগডাঙ্গা এলাকায় র‌্যাব সোর্স পরিচিত আব্দুল হাকিম পিন্টুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত পিন্টুর বাবা হুমায়ুন বাদী হয়ে চেয়ারম্যান টিপুকে প্রধান আসামী করে মামলা করেন। অভিযোগ, মাদক সংশ্লিষ্ট তথ্য ফাঁস করায় পিন্টুকে হত্যা করা হয়।

ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনের প্রশ্নবিদ্ধ নীরবতা আমাদের বোধগম্য নই। দীর্ঘদিন ধরে মাদকসম্রাট ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক থাকলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আমরা ইউএনও ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানিয়েছি তারপরেও বিষয়টির সুরহা পায়নি। ইউএনও স্যার বলেছিলেন শ্রীঘ্রই প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে তবুও এখনো প্রশাসন নিয়োগ দিচ্ছেন না।

ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য শিল্পী বেগম বলেন, “সাড়ে তিন বছরে আমরা একটি সভাও করতে পারিনি। আমাদের বেতন-ভাতা বন্ধ। বাইরে থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে পলাতক চেয়ারম্যান টিপু। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও আমরা কিছু করতে পারছি না।”

একই অভিযোগ তুলেছেন ওয়ার্ড সদস্য আশরাফুল হক, রফিকুল ইসলাম ও নাসির হোসেন। তারা জানান, পলাতক চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে পরিষদের কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে গেছে।

ইউনিয়নবাসীর অভিযোগ, টিপু চেয়ারম্যান রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থবলের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে চলছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দাখিল, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন হলেও দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেছেন, “সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের কথা বলা হয়, অথচ এক খুনি চেয়ারম্যান ১০ মাস ধরে পলাতক, প্রশাসন কিছুই করছে না। এটা কাদের প্রটেকশনে চলছে, তা জনগণ বুঝে গেছে।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের জনগণ আজ একটি অচল ও অপরাধীদের কবলে বন্দি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে বাঁচছে। চারটি হত্যাকাণ্ডের আসামী হয়ে পলাতক থাকা সত্ত্বেও শাহীদ রানা টিপুর বহাল তবিয়তে ক্ষমতা ও প্রভাব খাটানোর ঘটনা শুধু স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতা নয়, এটি দেশের আইনের শাসনের প্রশ্নেও বড় এক চ্যালেঞ্জ। দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিপুর স্থায়ী বরখাস্ত এবং তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণই পারে এই সংকটের সমাধান আনতে। অন্যথায় জনগণের ঘৃণা ও বিক্ষোভ আরও বিস্ফোরক রূপ নিতে বাধ্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে