খুলনার পাইকগাছার কপোতাক্ষ নদে ডিঙ্গি নৌকায় সুখেন বিশ্বাস এক যুগ ধরে ভাসমান জীবন যাপন করছেন। নদী ভাঙনে বাড়ী ঘর বিলিন হয়ে গেছে। জমি নেই ঘর নেই। ভাগ্য বিড়ম্বনায় শিকার হয়ে বৃদ্ধ সুখেন বিশ্বাস সমতলের জীবন যাপন থেকে ছিটকে পড়েছেন।
কপোতাক্ষ নদের বোয়ালিয়া মালোপাড়ার পশ্চিম পাড়ে আশ্রায়ণ প্রকল্পে ঘর চেয়েও ঘর না পাওয়ায় সুখেনের ডাঙ্গায় ফেরা হয়নি। তাই স্ত্রী নমিতা বিশ্বাসকে নিয়ে ডিঙ্গি নৌকায় ভাসমান জীবন যাপন করছেন।
তার বয়স প্রায় ৭০ বছর। জলে ভাসা জীবন তার জলে ডুবেছে। খেয়ে না খেয়ে কোন রকম দিন কাটছে তার। জীবিকার প্রয়োজনে কপোতাক্ষ নদে ও শিবসা নদীর জলে জীবন চাকা ঘুরাতে মাছ ধরেন।
প্রকৃতি দূর্যোগসহ নানান প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করেছেন। তবুও জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার বাসনায় স্বপ্ন বুনছেন। যদি আশ্রায়ন প্রকল্পে ঘর একটা ঘর মেলে।
আবার এক সময় সমতলের জীবনে ফিরে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর থেকে দিনরাত অক্লান্ত খাটুনি খাটেছেন জাল নদী জলে।
কাঠের তৈরী নৌকায় জলে ভেসে ভেসে এক যুগের বেশী কাটিয়েছেন সুখেন-নমিতা দম্পতি। ছোট্ট একটা নৌকাই তার ঘর-বাড়ি-সংসার।
যাযাবর বা বেদে না হয়েও নৌকায় ভাসমান জীবন যাপন করছেন। সকাল দুপুর পড়ন্ত বিকেল গোধূলি শেষে সন্ধ্যা হলে সোলার লাইট এর আলোতে আলোকিত হয় নৌকা।
বিকালে চুলা জালায় নৌকায়, রাতেই হয় খাওয়া। এভাবেই বসবাস করে আসছেন ওই নদীর কিনারে থাকা সুখেন পরিবার।
সুখেন ভাবুক মানুষ। সময় পেলে নৌকায় বসে আপন মনে একতারা বাজিয়ে বাউল গান গায়।
এতে তার মন কিছুটা হালকা হয়। আধুনিক সভ্যতা থেকে ছিটকে পরা এই দরিদ্র মালো পরিবারটি। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এই পরিবারটি নদীতে নৌকায় বসতি গড়ে তুলেছে।
জানা গেছে, পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের হিতামপুর বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় কপোতাক্ষ নদের তীরে সুখেন বিশ্বাসের জমি ঘর-বাড়ি ছিলো।
কপোতাক্ষ নদের ভাঙ্গনে সুখেনসহ অনেকের জমি ঘর বিলিন হয়ে যায়। হত দরিদ্র সুখেন ঘর-বাড়ি হারিয়ে ভাসমান জীবন যাপন করতে থাকে। তার চার মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে।
ছেলে বিদ্যুৎ বিশ্বাস কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। তার এক মেয়ে কপোতাক্ষ নদের চরে সরকারি জমিতে দোচালা টিনের ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন।
বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যুৎ বিশ্বাস বোনের তৈরি করা ঘরের এক রুমে থাকেন। সুখেনের থাকার জায়গা না হওয়ায় নিরুপায় হয়ে মাছ ধরা নৌকায় বসবাস শুরু করেন।
নৌকায় তাদের সব কিছু ঘর-বাড়ি, সংসার আবার রোজগারের একমাত্র অবলম্বন নৌকা আর জাল। সুখেন-নমিতার নৌকায় ভাসমান জীবন। বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় কপোতাক্ষ নদ থেকে শিবসা নদীর ব্রীজ পর্যন্ত ছোট জাল ফেলে মাছ ধরে সংসার চালায়।
ভাসমান জীবন যাপন করা সুখেন বিশ্বাস ও তার স্ত্রী নমিতা বিশ্বাসকে কপোতাক্ষ নদে খুজে পাওয়া যায়।
তার এমন ভাসমান জীবন-যাপন নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, কপোতাক্ষ নদের ভাঙ্গনে আমার জমি ঘর বিলিন হয়ে গৃহহীন হয়েছি। পরের জায়গায় এখানে সেখানে থেকেছি।
গরিব মানুষ জমি কেনার টাকা নেই, তাই নিরুপায় হয়ে আমরা নৌকায় বসবাস করছি।
আম্ফান ঝড়ে আমার নৌকা নদী থেকে উঠায়ে নিয়ে দুরে ফেলে দেয়।এতে নৌকা ভেঙ্গে চুরমার হযে যায়। তখন ধার দেনা করে খাই।
অনেক কষ্ট করে ১৫ হাজার টাকা সুদে নিয়ে নৌকা কিনেছি। এই নৌকা দিয়ে জাল ফেলে মাছ ধরি আবার নৌকায় ঘর সংসার সব কিছু।শিবসা ব্রিজের পাশে মাসের ১৫/২০ দিন মাছ ধরি।
যে মাছ পাই তা বিক্রি করে চাউল ডাউল কিনে দুই জনের সংসার চালাই। রাতে নদীর পাশে গাছে নৌকার রশি বেধে ঘুমাই। ঝড়ের খবর পেলে খালের ভিতর নৌকা নিয়ে বেধে রাখি।
মাঝে মাঝে বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় কপোতাক্ষ নদে এসে মেয়ের বাসায় রান্না করে নৌকায় নিয়ে খেয়ে নৌকায় ঘুমায়। নদীতে তেমন মাছ পড়েনা, গোনে ৫০০ গ্রাম থেকে এক কেজি আর বেগোনে ২০০/৩০০ গ্রাম মাছ পড়ে জালে।
এই মাছ বিক্রি করে কোন রকমে সংসার চলছে। তিনি আরো বলেন, ‘গুচ্ছ গ্রামে ঘর চাইছিলাম ঘর হয়নি, নৌকায় থাকতে ভয় লাগে ঝড় বৃষ্টিতে কখন কি হয়। আমাকে একটা ঘর দিলে নিশ্চিত থাকতে পারবো।’
পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহেরা নাজনীন জানান, উ‘নি প্রকৃত ভূমিহীন হলে প্রতিবেদনসহ আবেদন করলে ডিসি স্যারকে বলে খাস জমির ব্যাবস্থা করা যাবে। আর নদীর ধারে আশ্রায়ণ কেন্দ্রের কোন ঘর খালি আছে কিনা খোজ নিতে হবে। খালি ঘর পেলে উনাকে ঘর দেওয়ার ব্যাবস্থা করা হবে ‘