ছাত্র-জনতার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর শেরপুরের সদর থানায় করা তিনটি হত্যা মামলার তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে গত ১ জুলাই । এর মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও নির্যাতনের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জুলাইয়েই দেয়া শুরু হলো।
পুলিশ জানায়, শেরপুরের মামলার তদন্তে দেখা গেছে, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর জিপ গাড়ি তুলে দেয় চালক। এতে ঘটনাস্থলে দুজন নিহত হন।
গত বছর ৪ আগস্ট শেরপুর শহরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ওই আন্দোলনে দুই শিক্ষার্থী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি চাপায় ও একজন গুলিতে নিহত হন। শেরপুর সদর থানায় তিনটি হত্যা মামলা করেন নিহতদের স্বজনরা।
তিনটি মামলার তদন্ত শেষে শেরপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে গত ১ জুলাই চার্জশিট জমা দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তিনটি মামলায় ৪৯৬ জনের নামে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতিক, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই সময় শেরপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন বিসিএস ৪১তম ব্যাচের কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম শাকিল। গত বছর ৪ আগস্ট শাকিলকে গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন চালক হারুনুর রশীদ। এ সময় ছাত্ররা শেরপুর শহরে সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে আন্দোলন করতে থাকেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাকিলের নির্দেশে চালক হারুন গাড়ি দ্রুতগতিতে চালিয়ে দেন ছাত্রদের ওপর। এতে ঘটনাস্থলে শিক্ষার্থী মাহবুব আলম ও শারদুল আশীষ সৌরভ নিহত হন। আহত হন অনেকে।
এ ঘটনায় শেরপুর সদর থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা করা হয়। একটি মামলার তদন্তভার পান উপপরিদর্শক (এসআই) আনসার আলী। তদন্তে নেমে তিনি গাড়িচালক হারুনকে চলতি বছর জানুয়ারি মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গ্রেপ্তার করেন। গাড়িচালক হারুন শেরপুরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে বদলি হয়ে সেখানে কর্মরত ছিলেন।
জিজ্ঞাসাবাদে হারুন জানান, ম্যাজিস্ট্রেট শাকিলের নির্দেশে তিনি ছাত্রদের ওপর গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিলেন। সূত্র জানায়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল গ্রেপ্তারের বাইরে থাকায় তিনি মামলাটির তদন্তকাজ প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। তবে পুলিশ তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাঁকে চার্জশিটভুক্তআসামি করে আদালতে তা জমা দিয়েছে বলে জানাযায়। শেরপুরে গুলিতে নিহত হন সবুজ নামের আরেক শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় আরো একটি হত্যা মামলা হয় ।
এদিকে মামলার আসামি তারিকুল ইসলাম শাকিল বর্তমানে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (আইসিটি শাখা, শিক্ষা শাখা, ব্যবসায় ও বাণিজ্য শাখা) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
শনিবার উনার সাথে টেলিফোনে মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’ যে গাড়িটি ছাত্রদের ওপরে পিষ্ট হয়েছে সে গাড়িতে আপনি ছিলেন কি না—জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করুন।’ গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশের বেশির ভাগ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এরপর ৬ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ সদস্যরা থানায় দায়িত্ব পালন করেননি। ১৫ আগস্ট থেকে থানার কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় থানায় মামলা করার সুযোগ পাননি বিচার প্রার্থীরা।
এমন পরিস্থিতিতে গত বছর ১৩ আগস্ট আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন আমির হামজা নামের এক নাগরিক। গত বছর ১৯ জুলাই রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে মুদি দোকানের মালিক আবু সায়েদ নিহত হন। ওই ঘটনায় আমির হামজা বাদী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিবিপ্রধান মো. হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারকে আসামি করে মামলা করেন। পাশাপাশি অজ্ঞাত পরিচয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাদের এই মামলায় আসামি করা হয়।
সূত্র জানায়, গত বছর ১৩ আগস্ট করা মামলার পর জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হতাহত হওয়ার ঘটনায় একের পর এক মামলা হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজার ৭৯০টি।
এ বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘তিনটি মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অন্য মামলাগুলো গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। কারণ এই তদন্ত পতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিচার কার্যক্রম চলবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন। প্রকৃত অপরাধীরা যেন চার্জশিটভুক্ত হন, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে’ এবং‘পর্যায়ক্রমে সব মামলার প্রতিবেদন আদালতে পাঠানো হবে। জুলাই আন্দোলনের মামলাগুলো খুবই স্পর্শকাতর। এছাড়া অনেক মামলার আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক আইজিপি, বড় বড় রাজনীতিবিদসহ সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এতে মামলাগুলো খুব সতর্কতার সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। যাতে চার্জশিট দেওয়ার পর কোনো ধরনের প্রশ্ন না ওঠে। এ ছাড়া কোনো কোনো মামলায় নিরীহ মানুষকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আসামি করা হয়েছে বলেও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেসব বিষয়ও মাথায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে।
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইজিপি তদন্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে কোনো নিরীহ মানুষ চার্জশিটভুক্ত হয়ে হয়রানির শিকার না হয়। প্রতিটি মামলার তথ্য কয়েকবার করে যাচাই করা হচ্ছে, ফলে সময় লাগছে। তিনি জানান, ঢাকা ও পটুয়াখালীর আরো কয়েকটি মামলার চার্জশিট প্রায় প্রস্তুত।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২১৩ হত্যা মামলা : রাজধানীসহ সারা দেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত বছর ১৩ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ২৫৩টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা ২১৩টি। বাকি মামলাগুলোর বেশির ভাগই হত্যাচেষ্টা ও অপহরণ মামলা।
এ ছাড়া সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে ৯৫২ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হলেন ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তৎকালীন প্রধান হারুন উর রশিদ। সারা দেশে তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলার সংখ্যা ১৭১টি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, তাঁর বিরুদ্ধে ১৫৫টি মামলা রয়েছে। ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১১৭টি, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকারের নামে ১২৫টি, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৪৬টি এবং অতিরিক্ত ডিআইজি এস এম মেহেদী হাসানের নামে ৩১টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ৩২ জনের বেশি পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।