সুন্দরবন উপকূলীয় খুলনার দক্ষিণ জনপদে ইসলাম ধর্মের অন্যতম প্রচারক হযরত পীর জাফর আউলিয়া (রহঃ) প্রায় সাড়ে ৫ শ’ বছর পূর্বে কপিলমুনিতে আসেন।
তবে জাফর আউলিয়া ঠিক কবে কপিলমুনিতে আসেন তার সঠিক সময় জানা না গেলেও তিনি ছিলেন, হযরত খাজা খান জাহান আলীর শিষ্য। কথিত আছে, সাধক পীর কপিলমুনিতে অবস্থানকালীণ নিজ সাধনা আশ্রমেই মৃত্যু বরণ করেন এবং সেখানেই তাঁর সমাধি ও পরবর্তীকালে মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়।
কথিত আছে, তাঁর কপিলমুনি আগমনের সময় কপিলমুনি অঞ্চল ছিল ঘণ অরণ্যে ভরা। ইসলাম ধর্ম প্রচার ও বিশ্বাস আনতে কপোতাক্ষ তীরবর্তী বর্তমান সমাধিস্থলে নিজ আশ্রম গড়ে তোলেন। ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি তিনি বহু অলৌকিক ঘটনার জন্ম দিয়ে তৎকালীণ সময়ে একের পর এক চাঞ্চল্যের জন্ম দিলে অল্প সময়েই তার প্রতি বিশ্বাস ও বহু শিষ্য তৈরি হয়। মৃত্যুর পর তার সমাধিকে ঘিরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সন্ধ্যা প্রদীপ প্রজ্জলনের পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যায় মানতসহ শুভ কাজের শুরুতে তার মাজার জিয়ারত করেন।
খুলনা জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনির প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত জাফর আউলিয়ার মাজার। কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ। মাত্র কয়েক গজ ব্যাসের মধ্যে কপিলেশ্বরী কালী মন্দির, সার্ব্বজনীন পূজা মন্ডপ, কপিলেশ্বমুনির আশ্রম, দু’টি মসজিদ, জাফর আউলিয়া মাদ্রাসা, রামকৃষ্ণ মন্দির, বেদ মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয়, শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন ধর্মের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয় অবস্থানেও কারো কোন দিন কোন প্রকার ক্ষতি কিংবা সম্প্রীতি ভঙ্গের কারণ হয়নি। তাই আরেক অর্থে কপিলমুনিকে বলা হয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জনপদ।
এর আগে হযরত উলুঘ খানজাহান আলী (রাঃ) ১৩৬৯ খ্রিস্টব্দে দিল্লীতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আকবর খাঁ এবং মাতার নাম আম্বিয়া বিবি। খানজাহান আলীর প্রাথমিক শিক্ষা তার পিতার কাছে শুরু হলেও তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন দিল্লীস্থ বিখ্যাত ওয়ালি এ কামিল পীর শাহ নেয়ামত উল্লাহর কাছে। তিনি কুরআন, হাদীস, সুন্নাহ ও ফিকহ শাস্ত্রের উপর গভীর জ্ঞানার্জন করেন।
খানজাহান আলী ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক সেনা বাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্ম জীবন আরম্ভ করেন। এরপর অল্প দিনেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন। ১৩৯৪ খৃষ্টাব্দে মাত্র ২৬/২৭ বছর বয়সে তিনি জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান (গভর্ণর) পদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে সুলতান খানজাহানের নেতৃত্বে ৬০,০০০ সুশিক্ষিত অগ্রবর্তী সেনাদলসহ আরও দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে বাংলা আক্রমণ করলে রাজা গণেশ দিনাজপুরের ভাতুরিয়াতেতে আশ্রয় নেন। ১৪১৮ খৃষ্টাব্দে খানজাহান যশোরের বার বাজারে অবস্থান নেন এবং বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারে কার্যক্রম শুরু করেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত খানজাহান আলীর মৃত্যু হয় প্রায় ৫৬৫ বছর আগে। আর হযরত জাফর আউলিয়া খানজাহান আলীর শিষ্য হলে তিনিও প্রায় সাড়ে ৫শ’ বছর আগে কপিলমুনিতে আসেন ইসলাম প্রচারের জন্য।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘ দিন জাফর আউলিয়ার মাজারটি ছিল অবহেলিত। ১৯৬৯ সালের দিকে জাতীয় সংসদের সাবেক স্পীকার প্রয়াত শেখ রাজ্জাক আলী তৎকালীণ প্রায় ৮শ’ টাকা খরচ করে মাজারটির সংস্কার ও পর্যায়ক্রমে কয়েক দফায় সরকারি ও ব্যক্তিগত অর্থায়নে দর্শনীয় পর্যায়ে রুপায়ন করেন। ১৯৫৮ সালে পীরের নামানুসারে স্থানীয় কতিপয় প্রগতিশীল ও শিক্ষানুরাগী মানুষ প্রতিষ্ঠা করেন, জাফর আউলিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা। সাবেক স্পীকার প্রয়াত শেখ রাজ্জাক আলী নিজ ১০ লক্ষ টাকা অর্থায়নে মাজার প্রাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করেন, জাফর আউলিয়া জামে মসজিদ।
সেই শ্মরণাতীত কাল থেকে অদ্যাবধি প্রতিদিন পিরের মাজারে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আসে অসংখ্য ভক্তবৃন্দ। সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ভুলে সব ধরনের ধর্মাবলম্বীরা মানতসহ ও শিরনি নিয়ে আসেন করুণা প্রত্যাশায়। কপিলমুনির কপোতাক্ষ তীরে আরেক সনাতনী সাধক পুরুষ কপিলেশ্বর মুনির (কপিলদের) সিদ্ধীলাভের ক্ষণ প্রতিবছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে কপোতাক্ষের কালীবাড়ি ঘাটে গঙ্গাস্নান উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বারুণী মেলাও বসে জাফর আউলিয়া মাজার চত্ত্বরে। কপিলমুনি-কাঠামারী সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামানুসারে ‘জাফর আউলিয়া সড়ক’। পীরজাফর আউলিয়াকে (রহঃ) ঘিরে রয়েছে অনেক অলৌকিক কাহিনী।
কথিত আছে, একদিন তিনি তাঁর অন্যতম শিষ্য ছালাওয়ালা ফকিরসহ দুর্গম এলাকায় যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থানকালে জনৈকা বৃদ্ধা তাকে নিজ গরুর ধুধ দিতেন পান করার জন্য। আকষ্মিক একদিন বৃদ্ধার গাভীটি মারা যাওয়ার কারণে দুধ দিতে পারেননি। তবে যথারীতি পীরের শিষ্য ছালাওয়ালা যান বৃদ্ধার বাড়িতে দুধ আনতে। সেখানে গিয়ে বৃদ্ধার গরু মৃত্যুর খবরে হতবাক হয়ে পড়েন। দুধ না হলে হুজুর কি খাবেন? এমতাবস্থায় তিনি বৃদ্ধার কাছ থেকে জেনে নেন মরা গাভীটির কোথায় ফেলা হয়েছে। এরপর ছালাওয়ালা ফকির মরা গাভীটি লেজ ধরে টেনে বলেন, এই গাভী ওঠ। এসময় মরা গাভী উঠে দাঁড়ালে তার থেকে দুধ নিয়ে ফকির খাওয়ান পীর জাফর আউলিয়াকে। বিষয়টি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে পীর কেবলা অবগত হয়ে ছালাওয়ালাকে ধমকে বলেন, ‘তুই আমাকে মরা গরুর দুধ খাওয়াবি’। সঙ্গে সঙ্গে এহেন অপরাধে অন্য শিষ্যরা ছালাওয়ালাকে বস্তাবন্দি করে নদীতে ফেলে দেয়। পুরো এলাকায় কানাঘুষা শুরু হয়, পীর কেবলা তার এক শিষ্যকে বস্তাবন্দি করে নদীতে ডুবিয়ে মেরেছে’। হুজুর অলৌকিক শক্তি বলে সম্ভবত তিনি চমক দেওয়ার জন্যই ওই এলাকা ত্যাগ করে কপিলমুনি ফিরে আসেন এবং শিষ্যদের নিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে তিনি স্থায়ী স্থান তৈরি করেন। তিনি ইসলাম প্রচার কর্মকান্ডের সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক বলে মানুষের খেদমত শুরু করেন। নদীভাঙ্গন, খালের বাঁধ, বনে বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেতে তদবির দিতেন। এ ধরনের অসংখ্য অলৌকিকতার দৃষ্টান্ত জনপদে আজও কথিত আছে।
মাজারে আসা ভক্তরা বলেন, ‘তারা পূর্ব পূরুষ ধরে পীরের মাজারে আসেন। পীরের দোয়া, আশীর্বাদ, ধুলিমাটিতে এখনো আশান হয় তাদের যাবতীয় মুশকিলসহ মনোবাসনা পূরণ হয়’।
মাজারের বংশ পরম্পরার খাদেম ইউনুস ফকির জানান ‘আমরা বংশানুক্রমিকভাবে সেই স্মরণাতীতকাল থেকে মাজারের খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। মাজারে আগত ভক্তদের দানিও পণ্য তারা সেবা হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রতিবছর পৌষ এবং বৈশাখ মাসে আশপাশের কয়েকটি থানার ভক্তবৃন্দের বাড়ি থেকে তারা খাদ্যশস্য ফল-ফলাদী, শাকসবজি এমনকি নগদ অর্থ উপহার হিসেবে সংগ্রহে যান। মাজারের দেখভালের দায়িত্বে থাকা পাঁচটি ফকির পরিবার এই উপঢেীকন সামগ্রী গ্রহণ করেন।
এলাকাবাসীর দাবি, পীর জাফর আউলিয়ার মাজারটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় নিয়ে দেখভাল করা হোক। জেলার ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব স্থান হিসেবে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে অকুকূল পরিবেশ জরুরী। এব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহনে তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।