শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পৃথিবীর কান্না

অনিক শুভ
  ০১ মে ২০১৯, ০০:০০

চারপাশে পানি থই থই করছে। বোরো ধানসহ সব ফসল পানির নিচে ডুবে গেছে। আমন ধানও চাষ হলো না। দেখা দিল খাদ্যাভাব। এরপর শুরু হলো শৈত্যপ্রবাহ। ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতের কারণে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শিম, তরমুজ থেকে শুরু করে প্রায় সব ফসলের ফুল ঝরে গেল। নারিকেল, সুপারি, কলাগাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে গাছ মারা যেতে লাগল। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট পরিবেশের সমন্বয়ে সৃষ্টি সুন্দর পৃথিবী আজ বিপর্যয়ের মুখে একমাত্র মানুষের অসচেতনতার জন্য। এবার চিন্তিত হলো পৃথিবীর সব মানুষ।

মানুষের এবার ২০১২-এর কথা মনে পড়ে গেল। সবাই বলেছিল পৃথিবী ২০১২-এ ধ্বংস হবে। কিন্তু ধ্বংস হয়নি। তবে কি এখন ধ্বংস হবে! আলামত তো তাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

নিজ নিজ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অতি জরুরি সভার আয়োজন করেছেন। সবার একটাই উদ্দেশ্য, যে করে হোক পৃথিবীকে দূষণ থেকে মুক্ত করতে হবে। ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে।

চারদিকে হাহাকার। কোথাও কোনো শান্তি নেই। হঠাৎ কান্নার শব্দে টুবাইর ঘুম ভেঙে গেল। এমন শব্দ ও রোজই শোনে। তবে আজ শব্দটা অনেক নিষ্ঠুরভাবে কানে বাজচ্ছে। এই করুন আর্তনাদে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলো টুবাই।

টুবাই বাইরে এসে দেখলো উঠানের এক কোণে ডিম্বাকৃতির এক বস্তু। ওখান থেকে মনে হয় এমন শব্দ ভেসে আসছে। ধীর পায়ে বস্তুটির দিকে এগিয়ে গেল টুবাই। উঠান থেকে কুড়িয়ে নিল একটি কঞ্চি। কঞ্চিটি দিয়ে যেই বস্তুটিকে নাড়িয়ে দিল, সঙ্গে সঙ্গে কান্নার শব্দ থেমে গেল। শব্দ থেমে যাওয়ায় টুবাই খুব অবাক হয়ে বলল, 'কে তুমি?'

বস্তুটি চটজলদি উত্তর দিল, 'তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?'

হুম পাচ্ছি। তুমি কাঁদছ কেন? এত কষ্ট কেন তোমার?

তোমাদের আচরণে কাঁদছি।

আমাদের আচরণে! কে তুমি?

আমি... আমি তোমাদেরই পৃথিবী।

পৃথিবী!

হঁ্যা... আমি পৃথিবী।

আমরা কি এমন করেছি তোমার সঙ্গে?

যার জন্য তুমি আজ এত দুঃখী?

তোমরা মানুষের জন্যই আমার বুকে এসিড বৃষ্টি হয়। আর তাতে সমগ্র প্রাণিকূল ভয়ংকর দুর্গতিতে পড়ে। তোমাদের কর্মকান্ডে বাতাসে যখন গ্যাস ও ধূলিকণার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে বায়ু দূষিত হয়; জলাশয়ে বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ও বিভিন্ন প্রাণীর মলমূত্র ফেলে পানি দূষিত করো; ট্যানারিসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার বর্জ্য, এসিড, রাসায়নিক দ্রব- খাল, বিল ও নদীর পানির সঙ্গে ফসলি জমির সঙ্গে ছেড়ে মাটি দূষিত করো; অযথা মাইক বাজিয়ে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, বাস-ট্রাক, রেলগাড়ি, লঞ্চ-স্টিমারের হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে শব্দ দূষণ করো? তখন আমার খুব কষ্ট হয়। আর আমার এই কষ্ট, এই আর্তনাদ একমাত্র তুমিই শুনতে পাচ্ছো।

হুম। ঠিক বলেছো। আমরা মানুষের জন্যই আজ তোমার এ অবস্থা। আমাদের অসতর্কতার জন্য, সবকিছুর অপব্যবহারের জন্য তোমাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হলো। তুমি নাশ হলে, আমরাও নির্মূল হয়ে যাবো তোমার বুক থেকে।

আমরা এতদিন নির্বিচারে বননিধন করে, প্রাণী শিকার করে জীবস্তরের ফুড চেইন নষ্ট করেছি। যার ফলে পুরো ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্য বিলিনের মুখে।

এখন যে করে হোক একটা উপায় বের করতে হবে। পৃথিবী তোমাকে বাঁচাতে হবে। সব প্রাণিকূলকে বাঁচতে হবে।

পৃথিবীর সঙ্গে টুবাইর অনেক অভিসন্ধি হলো। কিন্তু পরিকল্পনা সঠিক হলো না। পরে তারা সিদ্ধান্ত নিল আগে এক এক করে সব মানুষকে পৃথিবীর এই দুর্গতির কথা বোঝাবে যে পৃথিবী না থাকলে তারাও থাকবে না। তারপর একত্রিত হয়ে সবাই যাবে বৃক্ষরাজের কাছে।

সবাই একত্রিত হয়ে যখন বৃক্ষরাজের কাছে গেল, দেখল বৃক্ষরাজ নিজেও শুকিয়ে নিস্তেজ হয়ে আছেন। পৃথিবী বিনয়ের সঙ্গে বৃক্ষরাজকে বললেন, 'বৃক্ষরাজ আমরা সবাই কেন আপনার কাছে এসেছি আপনি তো আন্দাজ করতে পারছেন। আমার কষ্টের কথা তো জানেন। আমাকে বাঁচাতে হলে আপনাকে কিছু একটা করতে হবে। না হয় পুরো জৈববৈচিত্র্য থেকে শুরু করে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। দয়া করে আপনি ওদের জন্য হলেও কিছু করুন।'

বৃক্ষরাজ মাথা নিচু করে পৃথিবীকে বলল, 'পৃথিবী, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার কিছু করার নেই। যা করার সব মানুষ করতে পারত। ওরা ইচ্ছা করলে আপনাকে অনেক সুন্দর রেখে নিজেরাই শান্তিতে বাস করতে পারত। কিন্তু ওরা সেটা করেনি। যার ফলে আমাদের সবার এ অবস্থা।'

বৃক্ষরাজের এমন কথা শুনে সবাই সব মানুষ এক সঙ্গে বলল, 'বৃক্ষরাজ... আমরা দুঃখিত। আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমরা আর এমন ভুল করব না। এমন কিছু করব না যাতে আমাদের জন্য পৃথিবী দূষিত হয়ে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে যায়। আমরা এখন বুঝতে পারছি পৃথিবীর কিছু হলে আমরাও জীবিত থাকব না...

টুবাই সবাইকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বৃক্ষরাজকে বললেন, 'দুনিয়ার সব রোগের ওষুধ আপনার কাছে রয়েছে। আপনি বাতাস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ ও অক্সিজেন ত্যাগের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করেন। আপনাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক বৃক্ষ দশজন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করতে পারেন। আপনারা বাতাস থেকে ষাট পাউন্ডের অধিক বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করতে পারেন। শুধু তাই নয়- শত শত টন কার্বন শোষণের মাধ্যমে বায়ুর দূষণ রোধ ও তাপদাহ দুপুরে প্রস্বেদনের মাধ্যমে বাতাসে প্রায় একশত গ্যালন পানি নির্গত করে পরিবেশ ঠান্ডা রাখেন। শব্দ দূষণেও আপনার জবাব নেই...'

টুবাইর কথা শেষ না হতেই বৃক্ষরাজ বললেন, 'এসব করতে পারলে কি হবে? মানুষই তো আমাদের কেটে কেটে আজ পৃথিবীর এ অবস্থা করল।'

টুবাই আবার বলল, 'আমরা ভুল করেছি। তাই আজ প্রায়শ্চিত্ত করার সময় এসেছে। আমরা আর আপনাদের কাটব না। বন উজাড় করব না। দয়া করে আপনি কোনো উপায় বলুন যাতে আমরা সবাই বাঁচতে পারি।'

বৃক্ষরাজ অনেক ভেবে বললেন, 'উপায় একটা আছে।'

সবাই একসঙ্গে জানতে চাইল, 'কী এমন উপায়?'

মানুষকে গাছ লাগাতে হবে। এই পৃথিবীর সব বসতবাড়ির প্রাঙ্গণে গাছ লাগাতে হবে। স্থলভাগের যেখানে জায়গা থাকবে, সুযোগ থাকবে সেখানে রোপণ করতে হবে গাছ। তবেই আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারব।

বৃক্ষরাজের এমন প্রস্তাবে সবাই একমত হলো। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ অন্তত একটি করে গাছের চারা রোপণ ও পরিচর্যা করার সিদ্ধান্ত নিল।

চারা রোপণের পর ক্রমান্বয়ে বৃক্ষ তার কাজ শুরু করে দিল। ধীরে ধীরে দূষণ কমে শুরু করল। পৃথিবীর কল্যাণ হতে লাগল।

সবাই বৃক্ষরাজকে কৃতজ্ঞতা জানালো তার মহানুভবতার জন্য। কিন্তু বৃক্ষরাজ বললেন, 'পৃথিবীকে দূষণমুক্ত রাখতে হলে আমার পাশাপাশি তোমরা মানুষেরও অনেক করণীয় রয়েছে। তোমাদের নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে। যানবাহনে সিসামুক্ত ও সিএনজি ব্যবহার করতে হবে। শিল্পকারখানার বর্জ্য খাল, বিল, নদীতে না ফেলে ইটিপি স্থাপনের মাধ্যমে শোধন করতে হবে। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ ও শব্দ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সবসময় এয়ার মনিটরিং করতে হবে।'

মাথা নত করে সব মানুষ বৃক্ষরাজের কথায় সম্মতি জানিয়ে প্রতিজ্ঞা করল তারা সব নিয়মকানুন পালন করে চলবে। পৃথিবীকে সুস্থ রাখবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<47609 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1