হিমালয়কন্যাখ্যাত পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ফুল ফোটেছে শীত প্রধান দেশের দৃষ্টি নন্দন ফুল টিউলিপ। প্রথমবারের মতো ফার্ম আকারে চাষ করছেন প্রান্তিক ক্ষুদ্র চাষীরা। উত্তরাঞ্চলের শীত মৌসুমে বেশ শীতের তাপমাত্রা কম থাকায় টিউলিপ চাষের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পরিক্ষামূলকভাবে টিউলিপ উৎপাদনে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোস্যাল ডেভলেভমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। প্রকল্পটিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফ।
উপজেলার দর্জিপাড়া এবং শারিয়াল জোত গ্রামের ৮ জন ক্ষুদ্র চাষি পরীক্ষামুলকভাবে ৪০ শতক জমিতে ৬ প্রজাতির ৪০ হাজার টিউলিপের চাষ করছেন। জানুয়ারির ১ তারিখে লাগিয়েছিলেন বীজ। সাধারণত ২৫-২৮ দিনের মধ্যে ফুল ধরার কথা থাকলেও ২৩ দিনের মধ্যে ধরেছে ফুল। টিউলিপের দৃষ্টি নন্দন সৌন্দর্য ও হাসি দেখে চাষিরা অভিভূত। ইএসডিওর নারী সদস্য ও উদ্যোক্তারা টিউলিপ চাষ করছেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারলে যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে তেমনি পর্যটনে নতুনমাত্রা তৈরি করবে।
সোমবার সকালে শারিয়াল জোত ও দর্জিপাড়া গ্রামে টিউলিপ বাগান ঘুরে দেখা যায়, বাগানগুলোতে ফুটতে শুরু করেছে ফুল ফোটা। বেগুনি (পারপল) রংয়ের টিউলিপ ফোটা শুরু করেছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকদের এই টিউলিপ ফুল ঘুরে দেখতে দেখা গেছে।
উদ্যোক্তা মনোয়ারা ও মোর্শেদা খাতুনের সাথে কথা হলে তারা জানান, আমরা ইএসডিও’র সহযোগিতায় ২০ শতক জমিতে টিউলিপ লাগিয়েছি। লাগানোর ২৩ দিনেই ফুল ধরতে শুরু করেছে। এরকম জায়গায় নেদারল্যান্ডের ফুল চাষ করতে পেরে খুব ভালো লাগছে। আশা করছি ভাল দাম পাব।
আরেক উদ্যোক্তা আয়শা আক্তার জানান, ইউএসও’র সহযোগিতায় আমি ৫ শতক জমিতে টিউলিপ লাগিয়েছি। ফুল ফোটা নিয়ে দু:শ্চিন্তায় ছিলাম। ফুল ফোটায় খুব অভিভূত হয়েছি। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এই ফুল দেখতে আসছে। এ ফুল বাজারজাত করতে পারলে পরের বছর আরো বেশি জমিতে এ ফুল চাষ করবো।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা শাহ আল আমিন ও অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা তামান্না ফেরদৌস জানান, শুনেই ছুটে এসেছি দেখতে। নেদারল্যান্ডের শীতাঞ্চলের ফুল এখন তেঁতুলিয়ায় ফুটেছে। সরাসরি টিউলিপ দেখবো কখনো ভাবিনি। এর আগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে টিউলিপের ছবি এবং ভিডিও দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এখন বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি, এই অনুভূতিটাই অন্যরকম।
তেঁতুলিয়ায় টিউলিপ ফুলের চাষ দেখতে ছুটে যান নীলফামারীর সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন, আমেরিকান প্রবাসী মিজানুর রহমান সিদ্দিকী রঞ্জুসহ বেশ কয়েকজন পর্যটক। তারা জানান, তেঁতুলিয়ার মাটিতে টিউলিপ চাষের বিষয়টি অবাক করেছে। ফুল ফোটায় এখানে বাণিজ্যিকভাবে যেমন এ ফুলের চাষ করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আমাদের মতো পর্যটকদের দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। এ অঞ্চলে পর্যটনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিল এ ফুল।
ইএসডিও’র সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর আইনুল ইসলাম জানান, দেশের উত্তরাঞ্চলের পর্যটনের শিল্পের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে ইএসডিও’র উদ্যোগে পিকেএসএফ সহযোগিতায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে টিউলিপ ফুল চাষ সম্প্রসারণের উপযোগিতা নির্ণয় শীর্ষক ভ্যালু চেইন পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রাথমিকভাবে আমরা প্রান্তিক ৮জন নারী উদ্যোক্তাকে নিয়ে পরীক্ষামূলক ৪০ শতক জমিতে টিউলিপ চাষ শুরু করেছি। টিউলিপের ৬ প্রজাতির ১২টি রং রয়েছে। যা এখন পারপল কালার তথা বেগুনী রংয়ের ফুল ধরেছে।
ইএসডিও’র নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান জানান, বাংলাদেশে ফার্ম আকারে টিউলিপের চাষ এটাই প্রথম। বিদেশী ফুলটি দেশে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দিতে দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়াকে বেঁছে নিয়েছি। আমরা ৮জন প্রান্তিক চাষীদের নিয়ে ৪০ হাজার টিউলিপের বøাব (বীজ) লাগিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এ ফুলের চাষ শুরু করেছি। ফুলও আসতে শুরু করেছে। এ ফুলের চাষের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অন্যতম অঞ্চল এখন তেঁতুলিয়া। ইতিমধ্যে টিউলিপ ফুলের বাগান দেখতে বিভিন্ন পর্যটকের সমাগম ঘটতে শুরু করেছে। আশা করছি এ ফুলের চাষের মাধ্যমে চা শিল্পের মতো টিউলিপ চাষের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। অর্থনীতি, শৈল্পিক ও পর্যটনে নতুনমাত্রা তৈরি করতেই আমাদের এই উদ্যোগ। এছাড়াও ইকো ট্যুরিজম গড়তে বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বলে জানান তিনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশে এখনো সেভাবে ‘টিউলিপ ফুলের চাষ শুরু হয়নি। বড় পরিসরে টিউলিপ চাষ উত্তরবঙ্গের তেঁতুলিয়ায় প্রথম। ফুলটি চাষ করতে হলে তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে উত্তরের এ উপজেলায় বরফের পর্বতযুগল হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা কাছে থাকার এখানে বেশ সময় শীত থাকে। এরকম শীতে টিউলিপ চাষে সুবিধা রয়েছে। বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এদেশে ফুল ফুটলেও পরবর্তীকালে রোপণের জন্য টিউলিপগাছের বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বাল্ব সংরক্ষণ করতে হয়। তাই এটা টিউলিপ চাষের বড় সীমাবদ্ধতা। বাণিজ্যিক চাষের উদ্যেশ্যে বাংলাদেশের জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টিউলিপ ফুলের জাত উদ্ভাবন করতে গবেষণা চলছে। আশা করছি পরীক্ষামূলকভাবে এ চাষ সাফল্যের মুখ দেখবে এবং পর্যটন শিল্পের ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
টিউলিপ শীত প্রধান অঞ্চলের ফুল। যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘টিউলিপা’। এটি নেদারল্যান্ডস’র ফুল। যা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুত্বপূর্ণ ফুল উৎপাদনকারী উদ্ভিদ। এটি বাগানে কিংবা কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা হয়। ফুলদানীতে সাজিয়ে রাখার জন্য এর আবেদন অনন্য। বর্ষজীবি ও কন্দযুক্ত প্রজাতির এ গাছটি লিলিয়াসিয়ে পরিবারভূক্ত উদ্ভিদ। টিউলিপের প্রায় ১৫০ প্রজাতি এবং এদের অসংখ্য সংকর রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের হাইব্রিডসহ টিউলিপের সকল প্রজাতিকেই সাধারণভাবে টিউলিপ নামে ডাকা হয়। টিউলিপ মূলত বর্ষজীবি ও শীত প্রধান দেশের বসন্ত কালীন ফুল হিসেবে পরিচিত।
যাযাদি/ এস