শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রোজার আগে খেজুরের বাজার অস্থির

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
  ০৭ মার্চ ২০২৪, ০৯:৩৩
ছবি: সংগৃহীত

পবিত্র রমজান ঘিরে দেশে খেজুরের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। শুল্ক কমানো ও বাজার তদারকিসহ নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ এ খাদ্যটির দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। তিন-চার মাস আগে যেসব খেজুরের দাম প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ছিল, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিরিক্ত শুল্ক, ডলার রেট বৃদ্ধি, এলসি না পাওয়া, সরবরাহে ঘাটতি ও অসাধু ব্যবসায়ীদের তৈরি করা কৃত্রিম সংকটে ভোক্তারা যথাযথ দামে খেজুর কিনতে পারছেন না।

তবে আমদানিকারকরা দাবি করছেন, খেজুরের দাম বাড়েনি। তাদের মতে, তিন-চার বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে খেজুরের দাম যা ছিল এখন আবারও সে অবস্থায় ফিরেছে। মাঝের বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে সৌদিতে হাজিদের যাওয়া সীমিত থাকায় মধ্যপ্রাচ্যে খেজুরের চাহিদা কম ছিল। যার কারণে দাম পড়ে গিয়েছিল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় খেজুরের আন্তর্জাতিক বাজারদর আগের অবস্থানে ফিরেছে। দেশের বাজারে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন। আগে ১ ডলার বাণিজ্যিক ঋণপত্রের (এলসি) বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ থেকে ৮৬ টাকা। এখন সেখানে আমদানিকারকদের পরিশোধ করতে হচ্ছে ১০৮ থেকে ১০৯ টাকা পর্যন্ত। এখানেই খেজুরের দাম বেড়ে গেছে শতকরা ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। আবার আমদানি পণ্যের ওপর সরকারি ডিউটি ট্যাক্স ও ডলার রেট বেড়ে যাওয়ার কারণে বেড়ে গেছে। যেখানে আগে একটা ক্যারেটের জন্য খরচ হতো ৩০০ টাকা, এখন সেটা ৫০০ টাকা। তারা আরো বলছেন, সব মিলিয়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছে শতকরা ২২ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। এ কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে খেজুরের দাম কয়েক বছর আগের দাম থাকলেও দেশের বাজারে বাড়তি।

রাজধানী ঢাকার বাদামতলী ফল বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রাত পোহানোর আগেই এ ঘাটে শোরগোল শুরু হয়। সারিবদ্ধ ট্রাক থেকে আড়তে আড়তে নামে খেজুর। সরবরাহের এমন প্রাচুর্য থাকলেও খেজুরের দামে লাগাম নেই। সরকার ঘোষিত ১০ শতাংশ শুল্ক কমানোর প্রভাব নেই পাইকারি বাজারে। ঘাট থেকে খেজুর কিনছেন সারা দেশে থেকে আসা খুচরা বিক্রেতারা। প্রতিদিন বাক্সপ্রতি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত খেজুরের দাম বাড়ছে। পর্যাপ্ত সরবরাহের পরও দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটকেই দুষছেন।

ক্রেতা এরশাদ সরকার বলেন, এখন তো নিম্নমানের খেজুরের দাম সাড়ে ৪০০ টাকার ওপরে। ভালোমানের খেজুরের দাম জিজ্ঞেস করতে ভয় করে। এত দাম! গরিব মানুষ যে ২০০ টাকার খেজুর কিনে খাবে, সে খেজুরেও ১০০ টাকা দাম বাড়ছে। এত দাম কীভাবে হয়? খেজুরের গাড়ি যখন আসে তখন দালালরা সব কিনে নেয়, তারপর স্বাধীনমতো আমাদের কাছে বেচে।

তিনি বলেন, গেল বছরের তুলনায় খেজুরের প্রতিটি ধরনের দাম কেজিতে বেড়েছে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া দাবাস, বরই ও তিউনেশিয়ান খেজুর কিনতে ক্রেতার গুনতে হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা। আর মরিয়ম খেজুরের দাম মানভেদে ৯০০ থেকে ১২৫০ টাকা, মাবরুম প্রতি কেজি ১৩০০, আজোয়া খেজুর ১১০০ থেকে ১৫০০ টাকা। প্রতিটি পদের খেজুরের দামই কেজিতে বেড়েছে অন্তত ২০০ টাকা। এতে বিক্রি কমেছে খুচরা বিক্রেতাদের।

আরেক ক্রেতা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী তাহের আলী বলেন, তিন-চার মাস আগে যে খেজুরের দাম ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, এখন সেটা হাঁকা হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা কেজি। এমন যদি হয়, তাহলে খেজুর কিনব কী করে। এবার রোজায় হয় খেজুর খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে, না হলে যেখানে পাঁচ কেজি খেজুর লাগত এখন সেখানে এক-দুই কেজি দিয়ে কাজ চালাতে হবে।

বাদামতলি ফলমুণ্ডির ব্যবসায়ী রিয়াজুল ইসলাম বলেন, বাড়তি আমদানি শুল্কের কারণে অনেক আমদানিকারক খেজুর আমদানি করেননি। আর এখন খেজুরের সংকট রয়েছে। তাই দামও বাড়ছে। রাজধানীর পাইকারি বাজার বাদামতলীর ফল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স এ. মজিদ অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইউসুফ খান বলেন, ফলের বাজার বর্তমানে অস্থিতিশীল। অনেক ব্যাংক এলসি খুলছে না, যার কারণে আমরা অনেক ভোগান্তিতে পড়েছি। ব্যাংক থেকে ব্যাংকে দৌড়েও আমরা সময়মতো এলসি করতে পারিনি। তারপর সরকার যখন রমজানের বাজার সহনশীল করার জন্য এলসির অনুমতি দিল তখন আমরা ব্যাংকে গিয়ে যেখানে দশটা এলসি করতে পারতাম, সেখানে একটা এলসি করতে পেরেছি। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়াও মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন তিনি।

তিনি আরো জানান, ডলার রেট নিয়মিত ওঠানামা করার কারণে আমাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। দেখা যাচ্ছে খেজুর আমদানি করতে ২ হাজার ৭০০ থেকে ৮০০ ডলারে কনটেইনার বুক করা যেত, এখন সেখানে ৪ হাজার ৭০০ খেকে ৫ হাজার ২০০ ডলার পর্যন্ত পড়ছে। এর ফলে সরকারের ডিউটি-ট্যাক্স সব কিছুই বেড়েছে। খেজুরের দাম বাড়াতে আমদানিকারকদের তেমন একটা কিছু করার নেই বলে দাবি ইউসুফ খানের। আমরা হয়তো আগে ১০ শতাংশ লাভ ধরে বিক্রি করতাম, এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না, ২০ থেকে ৫০ টাকা লাভে ৫ কেজির প্যাকেটগুলো ছেড়ে দিচ্ছি। আমরা হয়তো লাভ কম করছি কিন্তু বাড়তি চাপটা ভোক্তাকেই বহন করতে হবে।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ডলার রেট বেশি। এছাড়া আমদানিও এবার অনেক কম। এ জন্য বাজার কিছুটা অস্থির। তিনি বলেন, খুচরা বাজারে কেউ কেউ দ্বিগুণ দামে খেজুর বিক্রি করলেও পাইকারিতে এটা করার সুযোগ নেই।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন জানান, এবারও পর্যাপ্ত খেজুর আমদানি হয়েছে। সরকার ১০ শতাংশ শুল্কও ছাড় দিয়েছে। তবে মনিটরিংয়ে দুর্বলতা রয়ে গেছে। এর ফলে খেজুরের বাজার ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে। এদিকে কৃত্রিম সংকট তৈরি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, আমরা তো কয়েক দফায় মিটিং করেছি শুল্ক কমানোর বিষয়ে। আশা করি খুব দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। ব্যবসায়ীরা কত দিয়ে আমদানি করছেন এটা তদারক করব। তার সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের তফাত বেশি হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে