প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনতে সহায়তা করা বাংলাদেশিদের প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আগামী অর্থবছরে উদ্যোগটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নির্দেশিকা প্রণয়ন ও একটি ধারণাপত্র প্রস্তুতের কাজ করছে।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনুসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিডার পরিচালনা পর্ষদের তৃতীয় সভায় এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় প্রস্তাবটির নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।
বিডা জানিয়েছে, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনতে যেসব বাংলাদেশি ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন, তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে এফডিআই প্রচারে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য।
বিডা-র ভাষ্য অনুযায়ী, জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও বিস্তৃত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভূমিকা নিশ্চিত করাই এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য।
বিডা-র নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বৈঠকে ধারণাপত্র উপস্থাপন করে বলেন, 'অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি (এনআরবি) স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনায় সহায়তা করতে চান। তবে বর্তমানে তাদের অবদানের স্বীকৃতি বা পুরস্কৃত করার জন্য কোনো প্রণোদনা ব্যবস্থা নেই।'
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠাতে উৎসাহিত করতে সরকার ২০১৯ সালে ২ শতাংশ প্রণোদনা চালু করে, যা পরে বৃদ্ধি করে ২.৫ শতাংশ করা হয়। একইভাবে, এফডিআই আনার জন্য ব্যক্তিদের ১ শতাংশ করমুক্ত প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিডা।
চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, 'অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি বিদেশে শক্ত নেটওয়ার্ক রয়েছে এবং তারা সে দেশের ভাষা ও ব্যবসার পরিবেশ ভালো বোঝেন। তাদের স্বীকৃতি দিয়ে আমরা আলাদাভাবে লোক নিয়োগ না করেও, তাদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিনিয়োগ আনতে পারি।'
এই প্রণোদনা স্কিম সকল বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত থাকবে, যারা দেশের বাইরে থেকেও অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তবে প্রণোদনা শুধু ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য হবে, প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নয়। এছাড়া, যারা সরাসরি এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে এফডিআই আনতে সাহায্য করবে, তারাই এই প্রণোদনা পাবে।
ব্যক্তিকে অবশ্যই স্বাধীন মধ্যস্থতাকারী হতে হবে। যেকোনো সরাসরি বা পরোক্ষ সম্পর্ক বা পদ থেকে মুক্ত থাকতে হবে, যাতে চুক্তি কোনোভাবে প্রভাবিত না হয়। প্রণোদনার জন্য কেবল নতুন ইক্যুইটি বিনিয়োগই প্রযোজ্য, যার ন্যূনতম মূল্য হতে হবে ৫ মিলিয়ন ডলার। কিস্তিতে আসা বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও মোট বিনিয়োগমূল্যের ভিত্তিতে প্রণোদনা নির্ধারিত হবে। বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের বিনিয়োগ এতে অন্তর্ভুক্ত নয়।
উদাহরণ হিসেবে আশিক মাহমুদ বলেন, চীনে বসবাসরত একজন প্রবাসী বাংলাদেশি, যিনি চীনা ভাষা জানেন, তিনি সে দেশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমন এক যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারেন—যেটা বিডার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে।
তিনি বলেন, 'কোনো এনআরবি যদি নিজের উদ্যোগ, যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিয়ে আসেন—যেটা হয়তো বিডা নিজে করতে পারত না—তাহলে রেমিটেন্স-এর মতোই তাকে কেন আমরা প্রণোদনা দিয়ে স্বীকৃতি দেব না?'
স্কিমটি কার্যকর করতে 'এফডিআই স্বীকৃতি' নামে একটি তহবিল গঠন করা হবে, যা অর্থবছরের শুরুতেই বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-কে বরাদ্দ দেওয়া হবে। বিনিয়োগ জনসমক্ষে ঘোষণার ১৪ দিনের মধ্যে আবেদনকারীকে নির্ধারিত ফরম্যাটে আবেদন করতে হবে। এর সঙ্গে দাখিল করতে হবে–প্রমাণস্বরূপ কিছু দলিল, বৈধ পরিচয়পত্র এবং পেশাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র।
আবেদনকারীকে হলফনামার মাধ্যমে ঘোষণা দিতে হবে, বিনিয়োগকারী পক্ষের সঙ্গে তার কোনো স্বার্থ বা সংঘাতপূর্ণ সম্পর্ক নেই। পাশাপাশি, বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় তার ভূমিকা প্রমাণ করতে ইমেইল, চিঠিপত্র বা সংশ্লিষ্ট পক্ষের প্রত্যয়ন পত্র সংযুক্ত করতে হবে।
প্রতিটি আবেদন যাচাই ও মূল্যায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হবে।
এই কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন–অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)–এর নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান এবং অর্থ সচিব। প্রয়োজনে যাচাই প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত সদস্য বা তৃতীয় পক্ষের বিশেষজ্ঞদেরও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
অনুমোদিত প্রণোদনার অর্থ আবেদনকারীর ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করা হবে।
সভায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'আর্থিক প্রবাহ সবসময়ই অনিশ্চিত—আসে, আবার চলে যেতে পারে। কতদিন পর যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।'
তিনি প্রণোদনা কাঠামোতে শিল্প অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনার পরামর্শ দেন। বিডা-র বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি বলেন, 'গভর্নিং বোর্ড নীতিগতভাবে সম্মতি দিয়েছে। আমরা ধারণাপত্র উপস্থাপন করেছি এবং এখন একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) তৈরির কাজ চলছে। এটি চূড়ান্ত হলে প্রতিটি সংশ্লিষ্ট পক্ষের দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হবে। প্রণোদনা কমিটির মতামতের ভিত্তিতে গাইডলাইন প্রস্তুত করা হবে এবং পরবর্তী গভর্নিং বোর্ড সভায় তা উপস্থাপন করা হবে।'
বিডা গভর্নিং বোর্ডের আগের বৈঠকটি হয়েছিল ২০২০ সালে। সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল। নির্বাহী চেয়ারম্যান জানান, এখন থেকে প্রতি তিন মাস পরপর এ ধরনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, যাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়।
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব ভিত্তিক (পিপিপি) বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।