বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২
ট্রাম্পের শুল্কনীতিসহ বহুমুখী সংকট

ইউরোপীয় বন্দরে চরম পণ্যজট সরবরাহ চেইনে বিপর্যয়

যাযাদি ডেস্ক
  ০১ জুলাই ২০২৫, ২০:০৯
ইউরোপীয় বন্দরে চরম পণ্যজট সরবরাহ চেইনে বিপর্যয়
জার্মানির হামবুর্গ বন্দরে কনটেইনারবাহী জাহাজ | ছবি: সংগৃহিত

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন ধরনের নীতিগত পদক্ষেপ নিয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। পুনরুদ্ধারের এ প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ বাধা হিসেবে যুক্ত হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি, যা কিনা মহাদেশটির অর্থনীতিতে পরিবেশগত বিপর্যয়ে সৃষ্ট জটিলতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। সম্প্রতি শিপিং ও লজিস্টিক কোম্পানিগুলো সতর্ক করে জানিয়েছে, ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও স্থানীয় নদীগুলোয় পানিস্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ইউরোপের বন্দরগুলোয় পণ্য খালাস ও জাহাজীকরণ কার্যক্রমে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে। বন্দরগুলোয় তৈরি হয়েছে পণ্যজট, যা প্রতিনিয়ত তীব্রতর হচ্ছে। কভিড মহামারীর পর সবচেয়ে বড় দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ইউরোপভিত্তিক পণ্যের সরবরাহ চেইন।

এফটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ইউরোপের বিভিন্ন বন্দর ও নদীপথে পণ্য তুলতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করছে বার্জ। এ কারণে কনটেইনার জাহাজগুলো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে। এ সংকট সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে রটারডাম, অ্যান্টওয়ার্প ও হামবুর্গ বন্দরে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সামনের কয়েক মাস এ পরিস্থিতি চলমান থাকতে পারে।

নেদারল্যান্ডসভিত্তিক শিপিং কোম্পানি ডব্লিউইসি লাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিজার লুইকেনার জানান, ইউরোপের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এখন সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করছে। তা সত্ত্বেও বড় সব কেন্দ্রগুলোয় পণ্য উপচে পড়ছে।

ইউরো-রিজন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী আলবার্ট ভ্যান ওমেন বলেন, ‘কভিডের সময় সরবরাহ চেইনের ওপর যে ধরনের চাপ ছিল, এ মুহূর্তে পরিস্থিতি তেমনই বা আরো বেশি খারাপ।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপের বন্দরে চলমান এ সংকট বিশ্বজুড়ে অঞ্চলটির ওপর নির্ভরশীল লজিস্টিক ব্যবস্থার ওপর বড় ধাক্কা দিয়েছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে কম মজুদ রেখে নির্ভরযোগ্য সময় অনুযায়ী পণ্য সংগ্রহ করে এসেছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

জার্মান লজিস্টিক কোম্পানি কনটারগো গ্রাহকদের সতর্ক করে জানিয়েছে, কনটেইনার সংগ্রহে বার্জগুলোকে অ্যান্টওয়ার্পে গড়ে ৬৬ ও রটারডামে ৭৭ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সাধারণত বার্জগুলো নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী দ্রুত পণ্য তোলে। কিন্তু এখন সে সময়সূচি মানা যাচ্ছে না।

ডিএইচএল জার্মানির জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যাসপার এলারব্যাক জানান, এখনো কোনো গ্রাহককে যন্ত্রাংশের ঘাটতির কারণে উৎপাদন বন্ধ করতে হয়নি। কিন্তু শিগগিরই তারা এ ধরনের নাটকীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে।

ইউরো-রিজন গ্রুপের ভ্যান ওমেন বলেন, ‘ইউরোপের দ্বিতীয় ব্যস্ততম কনটেইনার বন্দর অ্যান্টওয়ার্পে জাহাজ এখন নির্ধারিত সময়ের তুলনায় তিন থেকে চার দিন পিছিয়ে কনটেইনার খালাস করছে।’

তিনি আরো জানান, সমুদ্রপথে পণ্যবাহী জাহাজগুলো দেরিতে পৌঁছাচ্ছে। এতে বার্জে কনটেইনার সংগ্রহ করা যায় না। ফলে শেষ পর্যন্ত গ্রাহক বা ব্যবহারকারী দেরিতে পণ্য পাচ্ছেন।

চলমান এ সংকটের জন্য ট্রাম্পের হঠাৎ পরিবর্তিত শুল্কনীতিকেও দায়ী করছে লজিস্টিক কোম্পানিগুলো। তারা বলছে, এটি কনটেইনার শিপিং রুটে আমূল পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে।

এমনিতে শুষ্ক বসন্তের প্রভাবে রাইন নদীতে পানি এখন কম। তাই লোডিং সীমিত করতে বাধ্য হচ্ছে বার্জ। এছাড়া শিপিং সংস্থাগুলো নতুন জোট গঠনের ফলে বিভিন্ন বন্দরে রুট বদল ও সময়সূচি পরিবর্তনের কারণে সাময়িক বিশৃঙ্খলাও দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে সুইজারল্যান্ডের মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানি (এমএসসি) ও ডেনমার্কের মায়েরস্কের মধ্যকার চুক্তি বাতিলের পর এ ধাক্কা আরো বেড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এশিয়া থেকে ইউরোপে আমদানি বৃদ্ধি। কারণ উচ্চ মার্কিন শুল্কের কারণে অনেক পণ্য এখন ইউরোপমুখী হচ্ছে।

ডিএইচএলের এলারব্যাক বলেন, ‘বিভিন্ন বাণিজ্য রুটে পরিবহন বৃদ্ধির তথ্য দেখলে বোঝা যায়, যেসব পণ্য বরাবরই মার্কিন বাজারে যেত তার অনেকটাই এখন ইউরোপে যাচ্ছে।’

শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারি বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে ইজারা নিয়ে কাজ করেন এমন টার্মিনাল পরিচালনাকারীরা জরুরি ভিত্তিতে নতুন কর্মী নিয়োগ ও যন্ত্রপাতি কিনে চাপ কমানোর চেষ্টা করছেন।

রটারডামের অন্যতম প্রধান টার্মিনাল অপারেটর ইসিটি জানিয়েছে, তাদের কেন্দ্রগুলো খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। একই পরিস্থিতি উত্তর ইউরোপেও প্রযোজ্য। সব মিলিয়ে পণ্যজটের মূল কারণ নতুন জোট, চাহিদা বৃদ্ধি এবং ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা।

অ্যান্টওয়ার্প ও রটারডামসহ বিভিন্ন বন্দরে টার্মিনাল পরিচালনা করছে দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড। সংস্থাটির বাণিজ্য বিভাগের প্রধান মার্ক রোজেনবার্গ বলেন, ‘কার্গো প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং যতটা সম্ভব বাধা কমাতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘উচ্চমানের সেবা বজায়, সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ ও পুরো ইউরোপীয় টার্মিনাল নেটওয়ার্কে স্থিতিশীলতা আনার মাধ্যমে আমাদের গ্রাহকদের সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ডিপি ওয়ার্ল্ড।’

অ্যান্টওয়ার্প-ব্রুজ বন্দর কর্তৃপক্ষও দীর্ঘস্থায়ী ও অতিরিক্ত জটিলতার কথা স্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, ‘এর ফলে স্বল্পমেয়াদে কার্যকরী সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের সিস্টেম এখনো পরিকল্পিত সীমার মধ্যেই কাজ করছে।’

তবে খাতসংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন, ইউরোপের বন্দরে পণ্যজটের সংকট সহজে কাটবে না। লুইকেনার জানান, ইউরোপের অভ্যন্তরীণ বাজারে সক্রিয় কিছু শিপিং কোম্পানি রটারডামের বিভিন্ন টার্মিনাল থেকে কনটেইনার সংগ্রহে স্বাভাবিক অবস্থার সর্বোচ্চ তিনদিনের জায়গায় এখন এক সপ্তাহ সময় নিচ্ছে। এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য যেসব অবকাঠামোগত বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা বাস্তবায়নে কয়েক বছর লেগে যাবে। তাই সমস্যাগুলো সহজে দূর হচ্ছে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে