সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১৮ আশ্বিন ১৪৩০
walton

ভয়াবহ ভূমিকম্পের আশঙ্কা : ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে ঢাকা

বীরেন মুখার্জী
  ০৬ মে ২০২৩, ০৯:৫৬
ছবি-যাযাদি

দেশে মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প ঘটছে। ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুসারে উত্তরে তিব্বত সাব-প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং দক্ষিণে বার্মিজ সাব-প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থানগত কারণেও ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। যে কোনো সময়ে হতে পারে ৮ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প। উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বা বিপদের মাত্রা অনেক বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে রাজধানী। ধসে পড়বে অন্তত ছয় হাজার ভবন, মৃত্যু হবে অন্তত তিন লাখ মানুষের। ঘনবসতির এই শহরটির ঝুঁকি কমাতে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও এর বেশিরভাগই আলোর মুখ দেখেনি।

তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে ছোট বড় ভূমিকম্পে ১৪১ বার কেঁপে ওঠে দেশ। সবশেষ শুক্রবার ভোরে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস-এর হিসাব অনুযায়ী রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪.৩। গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার। গত ১৫-২০ বছরের মধ্যে ঢাকার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জে ৫.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। ঢাকার কাছের ভূমিকম্পের ঘটনাগুলো বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট ছোট ভূকম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দেয়। বড় ভূমিকম্পের শত বছরের মধ্যে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়। দেশে সবশেষ বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে। এছাড়া ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে। সে হিসাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকট।

গত ২০০ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৮টি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে একটি হয়েছিল ১৮৬৯ সালে সিলেট অঞ্চলের কাছার এলাকায়। রিখটার স্কেলে এ কম্পনের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬। ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প, ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল, ১৯২৩ সালের দুর্গাপুরের ভূমিকম্পের এ অঞ্চল ভীষণ ঝুঁকিতে। ভূমিকম্পের কারণে সিলেটে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়- যা এখনো রয়েছে। ‘ডাউকি ফল্টে’ অবস্থান হওয়ায় সিলেট বড় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হতে পারে বলেও তারা জানিয়েছেন। ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে সিলেট হয়ে ভুটান পর্যন্ত ভূগর্ভে যে চ্যুতি আছে, তাতে বিপুল পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে। সেটি মৃদু ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার একটি সংবাদমাধ্যমকে জানান, পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এ রকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্ত্বের মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। সেটা যখন শিলার ধারণ ক্ষমতা পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোনো বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূ-পৃষ্ঠে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্টলাইন। আর ফল্টলাইনের আশপাশের দেশগুলোর ভূমিকম্পের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলের প্লেটের গঠন ও মুভমেন্ট নিয়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই যুগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলের ইন্ডিয়া প্লেট ও বার্মিজ প্লেটের সংযোগস্থলে দীর্ঘসময় ধরে কোনো ভূমিকম্পের শক্তি বের হয়নি। ফলে সেখানে ৪০০ থেকে হাজার বছর ধরে শক্তি জমা হয়ে রয়েছে। গবেষণা বলছে, ইন্ডিয়া প্লেট পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মিজ প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে। আর এই মাত্রার ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকাসহ দেশে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে।

বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, বার্মিজ প্লেট বছরে ২ সে.মি. করে অগ্রসর হচ্ছে ইন্ডিয়ান প্লেটের দিকে। অন্যদিকে বছরে ৬ সে.মি. করে ইউরেশিয়ান প্লেটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ইন্ডিয়ান প্লেট। আবার হিমালয়ের পাদদেশে নেপাল যে টেকটোনিক প্লেটের ওপরে বসে রয়েছে, সেটার ওপরেই রয়েছে ভারতের উত্তর অংশ।

হায়দরাবাদ ভিত্তিক ন্যাশনাল জিওফিজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এনজিআরআই)-র গবেষণা অনুযায়ী, পৃথিবীর উপরিতলে থাকা বিভিন্ন প্লেট ক্রমাগত নড়াচড়া করছে। এরমধ্যে ভারতীয় প্লেটটি ৫ সেমি করে সরে যাচ্ছে প্রতি বছর। এ কারণেই অস্বাভাবিকভাবে চাপ বাড়ছে হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলে, যা বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে বড়সড় ভূমিকম্পের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার ভোরে হওয়া ৪.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার সিটি সেন্টার থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে দোহারে। ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব ছিল ৮ সেকেন্ড।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা জানান, চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াই হাজার উপজেলায় ৩ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।

ভূমিকম্প শনাক্তকারী সংস্থা আর্থকোয়েকট্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের ১৮ মার্চ এই অবস্থানেই দোহার থেকে ১৪.২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ৪.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল।

ঢাকার কাছাকাছি অবস্থানের ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলেও গত বিশ বছরের মধ্যে একাধিক ছোট ছোট ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে। ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ১২ কিলোমিটার পূর্বে ৪ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়।

আর্থকোয়েকট্র্যাক থেকে ২০০৮ এ টাঙ্গাইলের নাগরপুরে ও ২০১৯ সালে মির্জাপুরে চার মাত্রার নিচে ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া গত ১৫ বছরে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জে অন্তত চারবার ভূমিকম্প হয়েছে বলে জানাচ্ছে সংস্থাটি। ঢাকার কাছে ফরিদপুরেও গত ১৫ বছরের মধ্যে দুইবার চার মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছে।

২০১৫ সালে নেপালে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ‘ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার। সেই সিদ্ধান্তটি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এ ছাড়া ওই বৈঠকে ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এনডিএমআইএস) নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরির সিদ্ধান্তও হয়েছিল। এটি আজও আলোর মুখ দেখেনি।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
shwapno

উপরে