রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিজমির মাটি উর্বরতা হারিয়েছে ৭৫ শতাংশ

ডক্টর মো: নূরুল হুদা আল মামুন
  ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

মাটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি পৃথিবীর অধিকাংশ জীবের খাদ্য উৎপাদন এবং বসবাসের মাধ্যম। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে প্রাকৃতিক খনিজসম্পদ খুব একটা বেশি নেই। ফলে এ দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা কৃষির ওপর নিভর্রশীল। আর কৃষিকাজের মূল ভিত্তি হলো মৃত্তিকাসম্পদ। এ দেশের অধিকাংশ মানুষের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িত সোনার চেয়ে দামি এই মৃত্তিকাসম্পদ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, এ মাটির পরিবেশ ও মাটির উর্বরতা আজ নানা কারণে হুমকির মুখে। এছাড়া মাটির অবক্ষয়ের কারণে আগামী ২৫ বছরে খাদ্যের দাম ৩০ শতাংশ বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মোট কৃষিজমির শতকরা ৭৫ ভাগ তার উর্বরতা হারিয়েছে। অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারই এর প্রধান কারণ বলে এক সমীক্ষায় উলেস্নখ করা হয়েছে।

ফসল উৎপাদনে নানাবিধ সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো মাটির তীব্র অম্স্নতা বা এসিডিটি বা মাটির গ্যাস্টিক সমস্যা। বাংলাদেশে মোট ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ৮৫ লাখ ৮৬ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৭৮ হাজা হেক্টর জমির মাটি অত্যধিক অম্স্ন (পিএইচ মান ৪.৫ এর নিচে) এবং প্রায় ৩৬ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমির মাটি অধিক অম্স্ন (পিএইচ মান ৪.৫ থেকে ৫.৫)। প্রতিনিয়ত অপরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহারের মাধ্যমে বৃদ্ধি পাচ্ছে মাটির অম্স্নত্ব বা এসিডিটি। মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায় যে, সারাদেশে ২০১০ সালে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি খুব শক্তিশালীভাবে অম্স্নীয় (পিএইচ <৪.৫) এবং প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন হেক্টর জমি প্রবলভাবে অম্স্নীয় (পিএইচ ৪.৫-৫.৫) মাটির আওতায় ছিল। যা ২০২০ সালের সমীক্ষায় দেখা যায়, অত্যন্ত শক্তিশালী অম্স্নয় জমি বেড়ে ২.৭৮ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে এবং এবং ৩.৬৪ মিলিয়ন হেক্টর জমি প্রবলভাবে অম্স্নীয় জমিতে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া ২০১০ সালে ০.৩০ মিলিয়ন হেক্টর জমির মাটি ক্যালশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি ছিল- যা ২০২০ সালের গবেষণায় দেখা গেছে যে, ক্যালশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম খুবই নিম্ন থেকে নিম্ন অবস্থার মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ২.১০ এবং ১.০৫ মিলিয়ন হেক্টর- যা বাংলাদেশের মোট আবাদি জমির যথাক্রমে ২৪.৫৩% এবং ১২.৩১%। অত্যধিক থেকে অধিক অম্স্নীয় মাটিতে ফসফরাস, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামও মলিবডেনামের স্বল্পতা এবং অ্যালুমিনিয়াম, আয়রন ও ম্যাঙ্গানিজের আধিক্য থাকায় ফসলের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এবং ফলন হ্রাস পায়। বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট, চটগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলসহ বরেন্দ্র ও মধুপুর গড় অঞ্চলের অধিকাংশ মাটি অত্যধিক থেকে অধিক অম্স্ন ফলশ্রম্নতিতে, এই সব অঞ্চলে আবাদকৃত ফসলের কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ফলন পেতে হলে এ ধরনের মাটির অত্যধিক ও অধিক অম্স্নতা হ্রাস করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।

মাটির অম্স্নতা বা পিএইচ কী: মাটিতে হাইড্রোজেন আয়নের শক্তি কে মাটির পিএইচ বলা হয়। মাটির পিএইচ এর পরিমাপ হলো মাটির অম্স্নতা বা ক্ষারকত্ব। মাটির অম্স্নত্ব/ ক্ষারত্বের সমতা না থাকলে মাটিতে খাদ্য উপাদান পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকা সত্ত্বেও গাছ মাটি থেকে খাদ্য উপাদানগুলো সঠিক মাত্রায় নিতে পারে না। তাই, কোন খাদ্য উপাদানের অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দিলে প্রথমেই দেখা দরকার মাটির পিএইচ ঠিক আছে কিনা। মাটির পিএইচ ১ থেকে ১৪ মাত্রার স্কেলে পরিমাপ করা হয়। মাটিতে যদি প্রচুর হাইড্রোজেন আয়ন থাকে, তাহলে পিএইচ কম হবে এবং মিশ্রণটি অম্স্নীয় হবে। আর যদি হাইড্রোজেন আয়নের মাত্রা কম থাকে তাহলে মাটি ক্ষারীয় হবে। যখন পিএইচ ৭ মাত্রায় হয় তখন মিশ্রণটি নিরপেক্ষ হয় আবার মাটির পিএইচ ৭ এর উপরে উঠলে মাটি ক্ষারীয় হয়। পিএইচ এর এই প্রাপ্যতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি সারের পুষ্টির বিভিন্ন আয়নগুলোর প্রাপ্যতাকে প্রভাবিত করে। ভালো ফসল উৎপাদনের জন্য মাটির অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রয়োজন। মাটির পিএইচ-এর মান ৫.৬ থেকে ৭.৩-এর মধ্যে থাকলে অর্থাৎ মৃদু অম্স্ন থেকে মৃদু ক্ষারীয় মাটিতে এসব পুষ্টি উপাদান ফসলের জন্য সহজলভ্য হয়। এই পিএইচ মান সম্পন্ন মাটি, মাটিতে অবস্থিত অণুজীবসমূহের বংশ বৃদ্ধির জন্য অনুকূল- যা ফসলের জন্য আবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানের সহজলভ্যতা বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মাটিতে ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামসহ অন্যান্য ক্ষারীয় উপাদানের ঘাটতি রয়েছে যা মাটির অম্স্নতা বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ।

ফলন কম হওয়ার কারণ : ফলে শিকড় স্থাপনা ও ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। জৈব পদাথের্র পচন অসম্পূর্ণ হওয়ায় মাটির উর্বরতা কমে যায়। উপকারী জীবাণু তথা অণুজীবসমূহের সক্রিয়তা ব্যাহত হওয়ায় মাটিতে পুষ্টি মৌলের রূপান্তর, চলাচল ও ফসলে প্রাপ্যতা কমে যায়। সারের ব্যবহারিক উৎকর্ষতা কমে যায়। মাটির অম্স্নত্ব বৃদ্ধি পেলে অ্যালুমিনিয়ামের বিষক্রিয়া বাড়তে পারে। ফলে একদিকে ফসফেট ঘটিত সারের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। শিকড়ের শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত হওয়ায় পানি ও কিছু পুষ্টিকণা শোষণ ক্ষমতা কমে যায় বলে মাটিতে অণুখাদ্যের ঘাটতি হয়। ডাল জাতীয় ফসলের বৃদ্ধি ও ফলন ব্যাহত হয়।

অম্স্ন মাটির পরিচর্যা: ধানের জমিতে পানি ধরে রাখলে তিন সপ্তাহের মধ্যে অম্স্নত্ব অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কাঠের ছাই বা তুষের টাটকা ছাই জমিতে দিলে অ্যালুমিনিয়ামজনিত বিষক্রিয়ার প্রভাব কমে। উন্নতমানের পর্যাপ্ত জৈব সার প্রয়োগ করে উপকার পাওয়া যায়। মাটির পিএইচ ৫.৫ এর কম হলে চুন জাতীয় পদার্থ দিয়ে মাটির শোধন করা প্রয়োজন। অধিক অম্স্নীয় মাটিতে ডলোচুনের সুপারিশকৃত মাত্রা হলো শতকে ০৪ কেজি বা একরে ৪০০ কেজি বা হেক্টরে ১০০০ কেজি। কোনোভাবেই এর মাত্রা কম বেশি করা যাবে না। কোনো জমিতে একবার ডলোচুন প্রয়োগ করলে পরে তিন বছর আর ডলোচুন প্রয়োগ কয়ার প্রয়োজন হয় না। কোনো জমিতে ডলোচুন প্রয়োগের আগে সুপারিশকৃত মাত্রা অনুসারে মোট ডলোচুনকে সমান দুইভাগে ভাগ করে নিতে হবে। জমির মাটিতে জো থাকা অবস্থায় উত্তর-দক্ষিণ বরাবরে অর্ধেক পরিমাণ ডলোচুন ছিটিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক পরিমাণ ডলোচুন পূর্ব-পশ্চিম বরাবর বা আড়াআড়িভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। ডলোচুন প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। কমপক্ষে ৭ দিন পর জমিতে প্রয়োজনীয় চাষ ও মই দিয়ে ফসল বুনতে বা গাছ রোপণ করতে হবে। ডলোচুন প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে বীজ বপন করলে বীজের অঙ্কুরোদগমের হার কমে যেতে পারে বা অঙ্কুরিত গাছের মূল ও কান্ডের বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। জমি যদি শুকনা হয় বা রস কম থাকে তাহলে ডলোচুন ব্যবহারের নিয়ম হলো ফাঁকা জমিতে প্রয়োজন মতো ডলোচুন আড়াআড়িভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এরপর চাষ দিয়ে মই দিয়ে সমান করতে হবে। সঙ্গে হালকা সেচ দিতে হবে। অতঃপর কমপক্ষে ৭ দিন পর জমিতে প্রয়োজনীয় চাষ ও মই দিয়ে ফসলের বীজ বুনতে বা গাছ রোপণ করতে হবে।

পরিশেষে, মাটির স্বাস্থ্যের সঙ্গে মাটির অম্স্নত্বের সম্পর্ক নিবিড়। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের কৃষি এখন খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে উত্তরণ ঘটছে। এ অবস্থায় মাটির অম্স্নত্ব কমিয়ে এবং মাটির জীববৈচিত্র রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন। এর মাধ্যমে মাটির উর্বরতা বজায় রাখা দেশের ভবিষ্যৎ কৃষি উৎপাদনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ

উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক

গবেষণাগার, ফরিদপুর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে