রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অনিন্দ্যসুন্দর বাকৃবির বোটানিক্যাল গার্ডেন

মোছা. ফাতেমা তুজ্জোহরা
  ২২ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

ময়মনসিংহ শহরের অদূরে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) প্রকৃতির এক অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার। শিক্ষা গবেষণায় অনন্য উচ্চতায় থাকা প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে একাধিক দর্শনীয় স্থান। তার মধ্যে অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন। প্রকৃতি আর অজস্র বৃক্ষের মিতালিতে অনিন্দ্যসুন্দর এক সংগ্রহশালা এটি।

ময়মনসিংহের একসময়ের প্রবল খরস্রোতা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের একদম কোলঘেঁষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ একর জায়গা নিয়ে রয়েছে এই বোটানিক্যাল গার্ডেন। এখানে রয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অঞ্চলের বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় কয়েক হাজার উদ্ভিদের বিশাল সম্ভার। দেশি প্রায় সব প্রজাতির উদ্ভিদের পাশাপাশি বিদেশি অনেক বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।

ছোট-বড়-মাঝারি ধরনের অসংখ্য গাছে ভরপুর গার্ডেনে রয়েছে ৬০০ প্রজাতির প্রায় ১০০০টি বড়, ১২৭৮টি মাঝারি ও ৪৪৬৭টি ছোটসহ প্রায় ৬৭৪৫টি গাছ। আন্তর্জাতিক সংস্থা বোটানিক গার্ডেনস কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনাল (বিজিসিআই) কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেন এটি। তাই তো এ গার্ডেনটিকে একনজর দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ ছুটে আসে। যা বিমোহিত করে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের।

বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালি সহজে খুঁজে পাওয়ার জন্য উদ্ভিদরাজি সমন্বয়ে গঠিত গার্ডেনটি ৩০টি জোনে বিভক্ত করা হয়েছে। ঔষধি, ফুল, ফল, ক্যাকটাস, অর্কিড, পাম, সাইকাস, মসলা, টিম্বার, বাঁশ, বেত, বিরল উদ্ভিদ ও বনজ উদ্ভিদ জোনসহ জলজ উদ্ভিদ (হাইড্রোফাইটিক) সংরক্ষণের জন্য ওয়াটার গার্ডেন, মরুভূমি ও পাথুরে অঞ্চলের উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য রক গার্ডেন গড়ে তোলা হয়েছে।

বাগান পরিচালনার জন্য ভেতরে রয়েছে দুইতলা অফিস কক্ষ। অফিস কক্ষ-সংলগ্ন নিসর্গ ভবনের ভেতরে রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় অসংখ্য প্রজাতির ক্যাকটাস। এর অপরূপ সৌন্দর্যই যেন নিসর্গ নামের সার্থকতা বহন করছে। বাগানের সর্ব দক্ষিণে রয়েছে মনোরম অর্কিড হাউস। তবে বেশি দেখা পাওয়া যাবে দেবদারু গাছের। রয়েছে সুবিশাল পানির ট্যাংক।

নগ্নবীজি উদ্ভিদ-১ ও পামবাগান জোনে মনিরাম, সাইকাডস, ডাইগুন, জ্যামিয়া, এনসেফালটরসসহ ১২ প্রজাতির নগ্নবীজি উদ্ভিদ এবং তালিপাম, সাগুপাম, মাতালপাম, চাউগোটা, বনগুয়া, চায়নাপামসহ ৩২ প্রজাতির পামজাতীয় উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। নগ্নবীজি উদ্ভিদের আরেকটি জোনে অরোউকোরিয়া, থুঁজা, ঝাউ, পাইন, পডোকার্পাস, জুনিপেরাস ঝাউ গাছসহ ১০ প্রজাতির উদ্ভিদ এই জোনে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

এখানে রয়েছে চা ও কফি বাগান। সেখানে বিটি ১, বিটি ২, বিটি ৩, বিটি ৭, টিভি ১, টিভি ৫-সহ বিভিন্ন চায়ের জাতের সংরক্ষণ এখানে রয়েছে। বাংলাদেশকে পরম মমতায় আগলে রাখা সুন্দরবনের গাছের জন্য রয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী সুন্দরবন জোন। এসব উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য যেমন পরিবেশ প্রয়োজন ঠিক তেমন করেই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে, যা বাংলাদেশে প্রথম ও একমাত্র। শ্বাসমূল (নিউমেটাফোর) ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা এখানে সংরক্ষিত। সুন্দরবনের সুন্দরী গাছও এখানে পাওয়া যায়। এ ছাড়া রয়েছে গরান, গেওয়া, কেওড়া, পশুর, বাইন, হোগলা ও ফার্নজাতীয় নানা প্রজাতির উদ্ভিদ।

ঔষধি গাছের জোনে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে অশ্বগন্ধা, সর্পগন্ধা, গন্ধভাদুলি, পুনর্নভা, কুর্চি, বচ, উলটচন্ডাল, অন্তমূল, অঞ্জন প্রভৃতি ঔষুধি গাছ এখানে স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া আরও নানান রকমের ঔষধি গাছ আছে এখানে। যা থেকে দর্শনার্থীরা সহজেই এসব গাছ-গাছালি সম্পর্কে ধারণা পাবে।

এ ছাড়া রয়েছে বিদেশি, দেশি ফুল ও ফলের গাছ। কমব্রিটাম, রনডেলেসিয়া, পালাম, ক্যামেলিয়া, আফ্রিকান টিউলিপ, ট্যাবেবুঁইয়া, রাইবেলি, জেসিয়া, ডায়ান্থাস, সিলভিয়া, হৈমন্তি বিভিন্ন ধরনের ফুলগাছ এবং স্টার আপেল, আমেরিকান পেয়ারা, থাই মালটা, আঙুর, প্যাসান ফলসহ বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফলের গাছ এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়া বাঁশবাগানে রয়েছে ১৬ প্রজাতির বাঁশ, মসলা জোনে রয়েছে একশ'র বেশি মসলাজাতীয় উদ্ভিদ।

বোটানিক্যাল গার্ডেন হাঁটতে থাকলে হঠাৎ চোখে পড়বে নাগলিঙ্গম নামের একটি অপরিচিত বৃক্ষ। গাছের গোড়া ফুঁড়ে বের হওয়া লম্বা লতার মতো শাখায় ছোট ছোট হাজারো কুঁড়ি। কুঁড়ি থেকে টকটকে লাল পলাশ কিংবা শিমুলের মতো ফুল মুখ বের করে আছে আকাশের পানে। নাগলিঙ্গম ফুলের পাপড়ি, রেণু, গঠন মোহনীয়। পাপড়ির মাথায় অসংখ্য ছোট ছোট সাপের মতো ফণা। এর আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার গভীর বনাঞ্চলে।

গাছ সাধারণত ১০-৩০ মিটার লম্বা হয়। গোড়ায় বেলের মতো শত শত ফল হয়। একই সঙ্গে ফুল, ফল ও গাছের পাতা আলাদা বৈশিষ্ট্যের। নাগলিঙ্গমগাছ সাধারণত কাঠবৃক্ষের মতো হলেও অন্য জাতের গাছের মতো এর শাখায় নয় বরং ফুল ফোটে গুঁড়িতে। এ ফুল সচরাচর দেখা যায় না। নয়নকাড়া ফুল আর বিচিত্র গোলাকার ফলের মনকাড়া সৌন্দর্য বিমোহিত করে সবাইকে।

এখানে অত্যন্ত রক্ষণশীল উপায়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে কিছু বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ। এসব উদ্ভিদের মধ্যে এমন কিছু উদ্ভিদ আছে, যা কেবল এ গার্ডেনেই দেখা যায়। বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে রাজ-অশোক, ডেফল, কালাবাউস, ক্যারিলিম্ফ, ফলসা, মনহোটা, মাক্কি, পেয়ালা, বনভুবি, লোহাকাট, উদাল, পানবিলাস, টেকোমা, বহেরা, হরতকী, কাটাসিংড়া, ম্যালারিউকা, প্যাপিরাস, রাইবেলি, রুপিলিয়া, স্ট্যাভিয়া, হিং, পেল্টোফোরামসহ বিভিন্ন উদ্ভিদ।

পাশাপাশি উলেস্নখযোগ্য বিষয় হলো এখানকার পট হাউস। বিরল প্রজাতির হার্ব জাতীয় ঔষুধি ও সুগন্ধি জাতীয় উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা হয় পট হাউসে। এখানকার ঔষুধি জোনে রয়েছে অর্ধশতাধিক প্রজাতির ঔষুধি উদ্ভিদ। এরমধ্যে আপাং, পেটারি, বাসক, উচান্টি, ঈশ্বরমূল, রইনা, দাঁদমর্দন, হুরহুরিয়া, মূতা, কালাহুজা, অতশি, স্বর্ণলতা, চাপড়া, হরিণা, আসামলতা, জির, উলটচন্ডাল, ফলসা, তোকমা, জ্যাট্রোফা, লাল রিয়া, মহুয়া, নাগকেশর, জয়ত্রী, কালিজিরা, রক্তচিতা, সর্পগন্ধা, দুধকরচ, ইন্দ্রযব প্রভৃতি। পট হাউসসহ গার্ডেনের সব ঔষুধি গাছ নিয়ে একটি প্রকাশনা রয়েছে। এতে কোনো ঔষুধি গাছ কী কাজে ব্যবহৃত হয় তার বর্ণনা ও ছবি রয়েছে।

বাগানের পূর্ব দিকের সীমানাঘেঁষে ২০১০ সালে নির্মিত হয় একটি ক্যাকটাস হাউস। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় ৬০-এর অধিক প্রজাতির ক্যাকটাস নিয়ে সাজানো হয়েছে হাউসটি। ক্যাকটাস এক ধরনের ফণীমনসাজাতীয় উদ্ভিদ। ক্যাকটাসের পুরো দেহ থাকে কাঁটায় আচ্ছাদিত।

এ ছাড়া এখানে রয়েছে একটি নার্সারি। শোভাবর্ধনকারী, অর্কিড, ক্যাকটাস, দেশীয় বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতিসহ বিভিন্ন ফুলগাছের চারা এখান থেকে ক্রয়ের সুবিধাও রয়েছে। উদ্ভিদরাজির পাশাপাশি বাগানটিতে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন পশু-পাখির প্রতিকৃতি। বিশ্রামের জন্য নদের পাড়ঘেঁষে রয়েছে ৪০টির অধিক বিশ্রাম বেঞ্চ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম, স্নাতক পর্যায়ে বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষার্থীদের উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞানার্জন এবং মাস্টার্স ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের গবেষণা কার্যক্রমে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে পরিচিত করানো হয় বাগানের সঙ্গে। ব্যবহারিক ক্লাসে উদ্ভিদ চেনার জন্য এখানে আসতে হয় শিক্ষার্থীদের। পরীক্ষার সময় উদ্ভিদ তথা উদ্ভিদের পাতা, ফুল, ফল, বীজ শনাক্তকরণের ওপর নম্বর রয়েছে।

এ ছাড়া দেশের সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়ের শিক্ষার্থীরা উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে জানতে ও দেখতে এখানে আসেন। বাগানের প্রধান দায়িত্বে রয়েছেন একজন কিউরেটর। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের মধ্য থেকে একজন গার্ডেনের কিউরেটরের দায়িত্ব পান। তার তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হয় গার্ডেনটি।

বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহানারা বেগম। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রয়েছে একাধিক কর্মচারী। শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি হলেও দর্শনার্থীদের জন্য জনপ্রতি টিকিটমূল্য ১০ টাকা। বাগানটি সপ্তাহের রবি থেকে বৃহস্পতিবার পাঁচ দিন দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টা এবং শুক্র ও শনিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। অনিন্দ্যসুন্দর আর নানা উদ্ভিদের সমন্বয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনটি বৃহত্তম ময়মনসিংহের গর্ব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে