রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বন্ধুত্ব রঙিন ঘুড়ির মতন

লোকে বলে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নাকি রক্তের সম্পর্ক থেকেও বড়। ঠিক তাই তো! আড্ডা, গল্প, ভ্রমণ, হাসি, রাগ আর অভিমান সবকিছু মিলিয়ে বন্ধুত্ব টক-ঝাল চকোলেটের মতো, একজন আরেকজনের রক্তে মিশে যাওয়া। বাস্তবতার 'নীরব-সত্য' হস্তক্ষেপে একেকজনকে ভিন্ন জায়গায় চলে যেতে হয়। শারীরিক অবস্থানে দূরত্ব বাড়লেও মনের দূরত্ব খুব যে বাড়ে না। এই বন্ধু দিবসে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-বন্ধুদের অভিমত তুলে ধরেছেন সিফাত রাব্বানী।
সিফাত রাব্বানী
  ০৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

এক সঙ্গে হাসা, এক সঙ্গে বাঁচা

সাদিয়া ইসলাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় দিনের ক্লাসে আমার প্রথম যাত্রা। নতুন পরিবেশে নতুনদের সঙ্গে তখন পরিচয়ের পর্ব অন্যদের মতো। সবাই তো এখন বন্ধু। দেশের নানা প্রান্ত থেকে একেকজন। বিষয়টি রহস্যময় যে আমাদের জীবনে নতুন করে কেউ চলে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পাঁচ-সাত দিন যাদের সঙ্গে খুব মেশা হতো এখন তাদের সঙ্গেই যোগাযোগ কম হয়। কিন্তু আমার আরও কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কটা পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছে এই পাঁচ বছরে। একেকজনের সঙ্গে একেক ভাবে, এই বন্ধুত্বের শেকড় যে কোনো ঝড় পূর্ণ শক্তিতে আঘাত হানলেও যে শক্তই থাকবে। কারও সঙ্গে সব কিছু ভাগাভাগি করা, মিড সেমিস্টার পরীক্ষায় কে কার সঙ্গে বসসে এটা নিয়ে কখনো খুনসুটি, কে কাকে রেখে চলে গেল সব মিলিয়ে বন্ধুত্ব নানা স্মৃতিতে রঙিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কিছুদিন আছি, চাই বন্ধুদের সঙ্গে এই দিনগুলো আরও স্মৃতিময় করতে। আমার ক্যাম্পাস জীবন যারা এত সুন্দরভাবে রাঙিয়ে দিল, তাদের খুব সহজে ভোলা যাবে না। আমার বন্ধুদের কাছেও একই চাওয়া কখনো যেন যোগাযোগহীনতায় থাকতে না হয়। কারণ যোগাযোগই তো সম্পর্কের প্রাণ। বন্ধু দিবসে আমার প্রিয় বন্ধুদের সুস্বাস্থ্য ও সার্বিক মঙ্গলকামনা করি।

আমরা চারজন চার প্রান্তে

সাবিনা চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

২০১৬ সালে এসএসসি শেষ করে সবে কলেজে উঠেছি। প্রথম দিনেই দেরি করে ক্লাসে প্রবেশ করে দেখলাম শেষের দিকে খালি একটা বেঞ্চে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ম্যামের ক্লাস পরক্ষণেই শেষ। ম্যাম বের হতেই দেখলাম একজন মহীয়সী তার ডায়েরি দেখাতে ব্যস্ত সবাইকে। আমার মতো একা মানুষ ক্লাসে তখন আর ছিল না তার ওপর ডায়েরি দেখিয়ে বন্ধু বানানোর অভিনব কৌশল ছিল চোখে পড়ার মতো। এরপর যা হলো, আরেকজন ওসেইন বোল্টের গতিতে এসে আমার পাশে বসল, তারও একাকিত্ব দেখে একটু হালকা মনে হচ্ছিল। আমি আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবো তখনই সে বললো 'আমার নাম সিথী, তোমার নাম কি? আমিও বললাম 'সাবিনা'। এরপর দুইজন মিলে 'ডায়েরি আপার' কান্ড দেখছিলাম। হঠাৎ পেছন ফিরেই দেখি আপু আমাদের ঘাড়ের ওপর! আমাদের দুই উজবুককে বললো, 'আমি ঝুমুর' পাশের জন্য বললো আমি 'সাদিয়া'। সেখান থেকেই চার বাঁদরের একটা সার্কেল হয়ে গেল। ক্লাসের বাকিরা নাম দিল 'থি এস জে'। সেই থেকে আমাদের বন্ধুত্ব ভীষণ গভীর। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা হলো চার জনের চার প্রান্তে। দেখা নেই কিন্তু যোগাযোগ আছে। ঈদ কিংবা পুজোর ছুটি আমাদের একসঙ্গে আড্ডা চলবেই। এটাই যেন অটুট থাকে এই প্রত্যাশা এই বন্ধু দিবসে।

আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে?

মাহমুদা টুম্পা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

সেদিন রুমমেট রাজনী আপু জিজ্ঞেস করেছিল তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে, একজনের নাম বলো। আমি হকচকিয়ে গেলাম প্রশ্নটা শুনে। এতটা অবাক হয়েছি- হয়তো আগে কখনো এরকম হইনি। আমি ভাবছি কার নাম বলব- নাসরিন, ফাতেমা, তমা, রূপা না আঁখির নাম। দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। আপুর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম- আপু আমি স্পেসিফিকভাবে বলতে পারছি না একজনের নাম। আপু মুচকি হেসেছিল।

পরের দিন গ্রম্নপ স্টাডিতে তোদের এ প্রশ্ন করতেই তোরাও হেসে গড়াগড়ি। বলতে থাকলি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড কে তুই জানিস। আমি আরও দ্বিধায় পড়ে গেলাম। সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে তোদের সঙ্গে পরিচয়। ছয়জন ছয় জায়গার তবুও আত্মিক একটা মিল আছে। একই হল হওয়ার কারণে ডিপার্টমেন্টে একসঙ্গে যাওয়া-আসা। যখন ক্লাসে যেতাম সব আপুরা চিলস্নায়ে উঠত ম্যানেজমেন্ট পার্টি। কতটা সুন্দর আমাদের বন্ধন। এ বন্ধনের জন্য অন্যরা আনন্দের হিংসা করে। করাটা স্বাভাবিক। আমি হলফ করে বলতে পারি এ বন্ধুত্ব অন্য কারোর নেই। ৫ বছর হয়ে গেল বন্ধুত্বে ফাটল ধরেনি, আরও সুদৃঢ় হয়েছে। মাস্টার্সে পড়েও সবাই আমাদের ফার্স্ট ইয়ার ভাবে শুধুই শক্তিশালী বন্ধুত্বের কারণে। এ বন্ধুত্ব আমাদের প্রাণোচ্ছ্বাস রেখেছে- করেছে ফার্স্ট ইয়ারের মতো চঞ্চল উদ্দাম। আজীবন চঞ্চলতা ধরে রাখতে চাই তোদের কারণে। রূপা, ফাতেমা, তমা, আঁখি, নাসরিন আজীবন বন্ধুত্বের সুতোয় মালা হয়ে থাকতে চাই। তবুও মনের মধ্যে আমার এখনো খটকা লাগে আসলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে?

বৈসাদৃশ্য বিষয়ের মধ্যেও সম্পর্ক গাঢ়

সানজিদা ইসলাম, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কটির নাম বন্ধুত্ব'- অ্যারিস্টটলের এই চিরসত্য বাক্যটির গভীরতা কতটা, তা তখনই বোঝা যায় যখন জীবনে খুঁজে পাওয়া যায় সত্যিকারের একজন বন্ধু। আমার জীবনে এমনই এক বন্ধু আছে যার সঙ্গে আমার বৈসাদৃশ্যর শেষ নেই তবুও আমাদের ভালোবাসার কমতি নেই। ২০১০ সাল! অনেক বছর আগে সেদিন স্কুলে প্রথম পরিচয় হয় আমাদের তারপর সাধারণ বন্ধু থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠে সে। আমি বরাবরই ছিলাম চঞ্চল-দুষ্টু প্রকৃতির আর সে ছিল শান্ত-নম্র প্রকৃতির। আমি তাকে দেখতাম ক্লাসে চুপটি করে এক জায়গায় বসে সে হয়তো পড়ছে, নয়তো গুনগুন করে গাইছে নয়তো কোনো কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন আছে, আর এদিকে আমি পুরো ক্লাস মাতিয়ে রাখতাম হই-হুলেস্নাড় হাসি-ঠাট্টা করে। আমি যা যা পছন্দ করতাম তার প্রায়ই ছিল তার অপছন্দের, আবার সে যা পছন্দ করত তাতে আমার ছিল না বিন্দুমাত্র আগ্রহ তবুও কীভাবে কি হয়ে গেল! এখন ২০২৩ সাল, এতটা সময় পরেও সে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়েই রয়ে গেছে। এখন দুজন থাকি দুই শহরে, চাইলেই এখন আর দেখা হয় না, একসঙ্গে ফুচকা, আইস্ক্রিম খাওয়া হয় না, একসঙ্গে হাত ধরে বিকেলে রাস্তায় হাঁটা হয় না, একসঙ্গে বসে হাসি-ঠাট্টা করা হয় না, তবুও আমাদের বন্ধুত্ব থেকে গেছে অটুট। একেই হয়তো বলে আত্মার সম্পর্ক। আমাদের এই বন্ধন যেন এমনই অটুট থাকে আজ এই বন্ধু দিবসে এটুকুই চাই।

ত্রিভুবনের তিন বন্ধুর গল্প

মো. সিনান তালুকদার, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

গত বছর নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলাম। আমার সাবজেক্ট এলো ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশন সাইন্স। ফেসবুক-মেসেঞ্জারে গ্রম্নপ খোলা হলো। গ্রম্নপের সবার সঙ্গে পরিচয় হলো। ক্লাস শুরু হতে প্রায় এক মাস বাকি। হঠাৎ এক রাতে গ্রম্নপে একজন মেসেজ দিয়ে বললো তার মাইগ্রেশন হয়ে এগ্রিকালচার এসেছে। আমিও চেক করে দেখলাম আমারও এগ্রিকালচার এসেছে। এরপর ক্লাস শুরুর তারিখ দিয়ে দিল, তবে নোয়াখালীতে থাকার ব্যবস্থা হয়নি তখনও। এরপর গ্রম্নপের মেম্বার রচিনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ও বলে যে একটা রুমে ওরা দুজন থাকবে ঠিক করেছে তবে আমি চাইলে আমাকে রুমমেট হিসেবে নিতে রাজি। আমি রাজি হয়ে গেলাম। ক্লাস শুরুর দুদিন আগে আমি ঢাকা থেকে নোয়াখালী চলে এলাম। পরিচয় হলো রুমমেট রচিন-লোকমানের সঙ্গে। একসঙ্গে থাকার ফলে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়। পরে ক্লাস শুরু হওয়ার পরে আমাদের সিরিয়াল দেখতে পেলাম। ৩৪, ৩৫, ৩৬ যথাক্রমে লোকমান, রচিন, সিনান! সবাই তো অবাক! আমরা তিনজন বন্ধু একসঙ্গে ঘোরাফেরা করি, একসঙ্গে ক্লাসে আসি, এক বেঞ্চে বসে ক্লাস করি, আবার তিনজনই পরপর রোলধারী। এখন আমরা তিনজন একে অন্যের সবচেয়ে কাছের বন্ধু।

শেষ বেঞ্চে একসঙ্গে বসা

রহিমা প্রামাণিক লিজা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সালটা ২০১৯, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হই। একটা মেয়েকে লক্ষ্য করতাম প্রায়ই ক্লাসে দেরি করে আসে। হঠাৎ একদিন আমার একটু দেরি হওয়ায় লাস্ট বেঞ্চে বসেছি। সেদিন লেট করে আসা মেয়েটা ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে ঢুকে আমার পাশে বসল। প্রথম ক্লাস শেষ হওয়ার পর সে আমাকে জানালো অর্থনীতি নাকি অনেক কঠিন। আমি বললাম, 'কই না তো'। তারপর সে আমাকে তার সমস্যাগুলো বললো। আমি তাকে বুঝিয়ে দিলাম। এরপর জানতে পারলাম তার নাম সাদিয়া। সেই থেকে বন্ধুত্বের শুরু। আমি তাকে পড়াশোনার বিষয়ে সব সমস্যা জানাতাম এবং তার কাছ থেকে বুঝে নিতাম আর সে আমার কাছ থেকে। আমি তাকে পড়াতাম ভূগোল ও অর্থনীতি আর সে আমাকে আইসিটি। এভাবে কলেজজীবন শেষ হয়ে গেল। আমরা স্বপ্ন বুনতাম দুজনই ঢাবিতে পড়ব, কলেজজীবনের মতো একে অপরের হাত ধরে ঘুরব আর ভবিষ্যতের গল্প করব। কিন্তু ভাগ্যক্রমে দুজনে ভিন্ন দুই শহরের ভিন্ন দুই প্রতিষ্ঠানে। তবে যেখানেই থাকুক না কেন আমার প্রিয় বান্ধবী সব সময় তার মঙ্গলকামনা করি, ভালো থেকো সাদিয়া।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে