রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

পথশিশুদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনা

বর্তমান সময়ের পথশিশুরা মানবেতর জীবন-যাপন করে শুধুমাত্র দু'বেলা দু'মুঠো ডাল-ভাত খাওয়ার জন্য নয়, আবার ছাদহীন খোলা আকাশের নিচে, রেললাইন ও রাস্তার পাশে আনন্দে সময় কাটানোর জন্যও নয়, ইচ্ছে করে বা কোনো স্বপ্ন পূরণের জন্যও নয়, বরং তারা এই মানবেতর জীবন-যাপন করে বিভিন্ন অপরাধীচক্রের চাপের কারণে অথবা রাজনৈতিক কোনো দলের প্রয়োজনে। অথচ পথশিশুরাও তো মানুষ, তাদেরও তো জীবন আছে, জীবনের ইচ্ছে ও স্বপ্ন আছে। তাদেরও তো স্বাধীন ও সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার আছে। তাই পথশিশুদের এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের তথ্য সমৃদ্ধ সুচিন্তিত মতামত তুলে ধরেছেন ইবনে আ. করিম
নতুনধারা
  ০৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

পথশিশুদের আশ্রয়স্থল হোক মাতৃক্রোড়ে

হাসান মাহমুদ শুভ

এমবিবিএস (২য় বর্ষ), ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে 'বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।' বন্যেরা আজ বনে সুন্দর থাকলেও হাজারো শিশুর আশ্রয়স্থল মাতৃক্রোড়ে হয় না! তাদের আশ্রয়স্থল হয় ওভারব্রিজের নিচে, রাস্তার ধারে, খোলা আকাশে নিচে, ট্রেন লাইনে, লঞ্চ টার্মিনালের কাছে ময়লা-আবর্জনায় কিংবা বাস-স্টেশনে। অথচ কোনো শিশুই পথশিশু হয়ে জন্মায় না। জন্মের সময় প্রতিটি শিশুই তার অধিকার নিয়ে জন্মায়। আমরা কি তাদের সেই প্রাপ্য অধিকারটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছি? মোটেই না!

পরিবেশ-পরিস্থিতি, পারিবারিক অস্বচ্ছতা ও রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার কারণে ক্রমশ পথশিশুদের পরিসংখ্যান দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। একদিক থেকে মানবতা এবং মনুষ্যত্ব হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে পথশিশুদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের ভিতরের সুপ্ত মানবতাবোধ এবং মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে হবে। পথশিশুদের অধিকার আদায়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। সমাজের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি ও সচেতন নাগরিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা সরকারি-বেসরকারি সংগঠনগুলোকেও পথশিশুদের জন্য টেকসই বাসস্থান নির্মাণসহ যাবতীয় অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

পথশিশুরাও ক্ষুধামুক্ত থাকুক

হযরত আলী

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সৃষ্টিরা আজ উলস্নসিত, বৃষ্টিরা দেখ ঝরছে অবারিত। আর কিছু মন আজো খুব ব্যথিত। কারণ আমাদের আশপাশের পথশিশুদের কত প্রাণ যে করছে ক্রন্দন! আজ প্রতিটি পথশিশুরা রাস্তার পাশে অনাহারে হাহাকার করছে, শহরের অলিগলি আর রেল লাইনের পাশে অগণিত মানব ফুল অযত্ন, অরক্ষিতভাবে পড়ে আছে। আর আজ সমাজের বিত্তশালীরা ডুবে আছে ভোগ বিলাসের মাতলামিতে। ফলে মনে হচ্ছে, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন, শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। কারণ, আমাদের সমাজপতিরা আর এগিয়ে আসছে না ক্ষুধামুক্ত একটি বাংলাদেশ গড়তে।

হে তরুণ! তোমাকে আর আমাকেই এর হাল ধরতে হবে। যেন এই পথশিশুদের অভিশাপ ও আর্তনাদের ফল আমাদের আগামী প্রজন্মকে পোহাতে না হয়, আর তাদের সেই হাহাকার আর আর্তনাদে পৃথিবীর বুকে যেন নেমে না আসে কঠিন কোনো পরীক্ষা (মহামারি)।

তাই সরকারি সহায়তায় বা তরুণ সমাজের ছোট্ট কাঁধের শক্তিতে এ জাতির প্রতিটি পথশিশু যেন ক্ষুধামুক্ত হয়। আর চির কাঙ্ক্ষিত ক্ষুধামুক্ত একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হয়। যেখানে কোনো মানবতা আর পায়ে নিষ্পেষিত হবে না। আর কোনো পথশিশুও মানবেতর জীবন-যাপন করবে না। সবাই সবার অধিকার পাবে। সবার প্রচেষ্টায় এই স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণ হোক।

দেশ থেকে মুছে যাক পথশিশু নামক শব্দটি

হুসাইন আহমদ

ইসলামি আইন গবেষণা বিভাগ দ্বিতীয় বর্ষ, দারুস-সুন্নাহ, টাংগাইল।

শিশু আর পথশিশু শব্দ দুটি আলাদা মনে হলেও শিশু আর পথশিশু কিন্তু একই। শিশু আর পথশিশুর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ আছে বলে আমরা অনেকেই মনে করি না। যদিও তারা রাস্তায় জীবন-যাপন করার কারণে পরিচিত হয় পথশিশু নামে। আসলে মানুষের মানবতা এবং মনুষ্যত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। যার ফলে আমাদের দেশে পথশিশুর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। এর মূলে রয়েছে অজ্ঞতা, দরিদ্রতা, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। এক শ্রেণির অশিক্ষিত ও দরিদ্র মানুষ অপরিকল্পিতভাবে সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর ওদের পরিত্যাগ করে। এভাবেই বাড়তে থাকে অবহেলিত পথশিশুর সংখ্যা। এসব পিতা-মাতা সন্তানদের মারধর করে রোজগার করার জন্য। তখন থেকেই শুরু হয় তাদের অবহেলিত কষ্টের জীবন। পথশিশুদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওই কচি, কোমল মুখগুলো পরিচিত হয় নতুন অনেক অসহনীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে। পথশিশুদের মধ্যে কঠিন বাস্তবতা এমনভাবে জায়গা করে নেয় যে, একসময় তারাই হয়ে ওঠে নেশাখোর, ছিনতাইকারী, চোর ইত্যাদি। আজ ছোট ছোট বাচ্চারা রাস্তায় পত্রিকা বিক্রি করে, ফুল বিক্রি করে কিংবা কিছু খাবে বলে টাকা চায়। তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? যে বয়সে তাদের হাতে থাকা উচিত বই-খাতা, সে বয়সে তাদের হাতে থাকে পস্নাস্টিকের বস্তা। রাস্তায় রাস্তায় তারা পস্নাস্টিক খোঁজে। কি নির্মম বেদনাময় দৃশ্য!

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমান বাংলাদেশে পথশিশুদের ৫১ ভাগই 'অশ্লীল কথার শিকার' হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় মেয়েশিশু। ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আর মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এছাড়া অপরাধীচক্রগুলো স্বার্থের জন্য তাদের মাদকসহ নানা অবৈধ ব্যবসায় কাজে লাগায়। তারা আসলে অপরাধী নয়। তারা অপরাধের শিকার হয়। এসব পথশিশুদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন খাদ্য এবং বাসস্থান। তারপর তাদের প্রয়োজন ভালো গাইড লাইন। এসব শিশুরা যদি গাইড লাইনের ভিতর দিয়ে না যায়, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত অন্ধকার।

অতঃপর, পথশিশুদের থাকা-খাওয়া এবং পড়াশোনার মাধ্যমে অন্যান্য বাচ্চাদের মতো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করার সুযোগ করে দিন। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে দিন। ভালো গাইড লাইন দিন। তাদের ইচ্ছে ও স্বপ্নকে পূরণ করার সুযোগ করে দিন। তাহলেই একদিন পথশিশু নামক কোনো নাম শিশুর সঙ্গে যুক্ত হবে না। দেশ থেকে মুছে যাবে পথশিশু নামক শব্দটি। আর তারাও ফিরে পাবে স্বাভাবিক জীবন। শিশু থাকবে শিশুর মতোই। আর একসময় তারাই সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়বে ও মানব বাগানের ফুল হয়ে সুভাস ছড়াবে।

পথশিশুদের অধিকার নিশ্চিত হোক

আবু জোবায়ের

শিক্ষার্থী, দাওয়াহ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

আমাদের সমাজে বা আশপাশে পথশিশু ও নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ বসবাস করে। এই পথশিশুদের কেউ কেউ জীবন-যাপন করে রাস্তায়, পার্কে ফুল বিক্রি করে। আবার শহরের আবর্জনার স্তূপ থেকে বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করে বা রাস্তায় রাস্তায় পত্রিকা বিক্রি করে। তাদের অধিকাংশের মাথা গোঁজার জায়গা কোনো ছাদহীন জায়গা বা রাস্তার ধারে, রেল লাইনের পাশে। এই পথশিশু ও নিম্ন আয়ের মানুষ আজ মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমান বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা নিয়ে যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে কেউ কেউ বলেন তাদের সংখ্যা ২১ লাখ। আবার কেউ কেউ বলেন ২৪ লাখ। তাদের মধ্যে ৫০ হাজার শিশু আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় থাকে।

তাই আমাদের উচিত সরকারি, বেসরকারি, সাংগঠনিক বা ব্যক্তি উদ্যোগে হলেও এই পথশিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করা। তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন করার ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া। সবাই মিলে পথশিশুদের একটি সুন্দর জীবন উপহার দেওয়া? তারাও যেন একজন মানুষ হিসেবে এই সমাজে বাঁচতে পারে। আর এই অধিকারগুলোর বাস্তবায়ন ঘটুক- এটাই প্রত্যাশা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে