রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

হেমন্তের হাওয়ায় ইবির ইতিহাস পরিবার

আবু তালহা আকাশ
  ০৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

কবি সুফিয়া কামালের ভাষায়, 'সবুজ পাতার খামের ভেতর, হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে, কোন পাথারের ওপার থেকে, আনল ডেকে হেমন্তকে?' ঠিক তাই শিশিরসিক্ত, কুয়াশাচ্ছন্ন মিষ্টি রোদের ঝলকানিতে ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলাদেশে হেমন্তকালের আগমন ঘটে! আর এই ঋতুর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি প্রাণে শরতের কাশফুলের মতো দুঃখ-কষ্ট ঝরে গিয়ে কামিনি, শিউলি, গন্ধরাজ ফুলের মতো নব প্রাণের উন্মেষ ঘটে।

ঠিক তেমনিভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সব বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও শরতের শেষে হেমন্তের প্রথম দিনে নব প্রাণ সঞ্চার হয়! বাংলার ঐতিহ্য অবলোকন করলে আমরা দেখতে পাই একসময় হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। যেখানে সেই উৎসবে নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হতো। বাঙালির সেই ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করে ইবির ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগেও 'হিস্টোরিয়ান গেটটুগেদার' শিরোনামে আয়োজন করা হয় হেমন্তকে বরণ ও আনন্দ উৎসবের।

আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল একটু ভিন্ন রকমের! প্রথমত তিন দিনব্যাপী 'আন্তঃসেশন ফুটবল টুর্নামেন্ট'র আয়োজন করা হয়। যেখানে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত সর্বমোট ছয়টি টিম গঠিত হয়। একদল খেলোয়াড় মাঠে ফুটবল খেলায় ব্যস্ত, অন্যদিকে আরেকদল মূল আয়োজনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কাজে! দফায় দফায় চলতে থাকে মিটিং! আয়োজনে কি কি রাখা যায়, কীভাবে করলে জমকালো হবে, কি কি খাবার থাকবে, অনুষ্ঠানে কতগুলো পর্ব থাকবে, সেখানে কে কোন দায়িত্ব পালন করবে, ক্যাম্পাসের কোন স্থানে আয়োজন করা হবে ইত্যাদি নানাবিধ জল্পনা-কল্পনা এবং সব ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি।

অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। হেমন্তের প্রথম দিন তথা বাংলা কার্তিক মাসের এক তারিখ। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিন সকাল থেকেই সব শিক্ষাবর্ষের ছেলেমেয়েরা টিএসসির প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হতে শুরু করে। একে একে আসতে থাকে ডেকোরেশনের জিনিসপত্র, রান্না করার হাঁড়ি-পাতিলসহ আয়োজনের সব উপকরণ। একদল মাঠে ফাইনাল খেলা নিয়ে ছোটাছুটি করছে, যেখানে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২২ শিক্ষাবর্ষের মধ্যে ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। অন্য দল রান্নার কাজে সবকিছু ঠিকঠাক করে গোছানোতে ব্যস্ত। আরেকদল অনুষ্ঠান এরিয়া ডেকোরেশনের কাজে। কেউবা ব্যস্ত সময় পার করছে সেলফি তোলায়!

অতঃপর ফাইনাল খেলায় বিজয়ী হয় ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ। রানার্সআপ হয় ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ। আনন্দ মিছিলে মুখরিত হয় পুরো এরিয়া। এরপরে শুরু হয় মূল আয়োজন....

উপস্থিত অধিকাংশ মেয়েরা বাঙালি মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি এবং ছেলেরা পাঞ্জাবি পরে। সব শিক্ষাবর্ষের দুই শতাধিক ছেলেমেয়ে সবাই ভাতৃত্বের বন্ধনে মিলিত হয়ে উচ্ছ্বসিত হয়। দেখতে দেখতে হেমন্তের সূর্য তখন ঠিক মাথার উপরে। পাশেই রান্না হতে থাকা বিরিয়ানি আর রোস্টের গন্ধে তখন আচ্ছন্ন চারদিক। আয়োজনের সিডিউল অনুযায়ী তখন খাবার খাওয়ার কথা থাকলেও রান্না পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় সবাই ক্ষুধার্ত থাকা সত্ত্বেও পরবর্তী পর্ব সবার জন্য খেলাধুলার আয়োজন শুরু করা হয়। সব মেয়েদের জন্য 'বালিশ খেলা' এবং ছেলেদের জন্য 'পাখি উড়ে, হাতি উড়ে' খেলা শুরু করা হয়। অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ও আনন্দঘন পরিবেশে দুটি খেলা শেষ হয়।

এরপরে শুরু হয় সবার একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ। ক্ষুধার্ত পেটে সুস্বাদু খাবার খেয়ে সবাই তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে থাকে। পারভেজ, কবির, রাসেল, তালহা, আনাস, নাইম, সাদিক, সাওন, রানাসহ আরও অনেকে সবাইকে খাওয়ানোর কাজ সম্পন্ন করে। ৩০ মিনিটের বিরতি শেষে শুরু হয় ফটোসেশন পর্ব। সব শিক্ষাবর্ষ মিলে গ্রম্নপ ছবি, সঙ্গে বিভাগ নিয়ে স্স্নোগান। যেন এক স্বর্গীয় শান্তি, আনন্দ, উদ্দীপনা সবার মনে। তারপরে শিক্ষাবর্ষ ভিত্তিক ছবি তোলা শেষে অনুষ্ঠানের সর্বশেষ পর্ব সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় এসে উপস্থিত হই আমরা। দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আগে যেমন হেমন্তকে বরণ করে নেওয়া হতো ঠিক তেমনিভাবে গান, কবিতা, কৌতুকসহ নানা রকমের সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা মঞ্চস্থ করার মধ্য দিয়ে এক পৈশাচিক আনন্দঘন মুহূর্ত পার করে সবাই।

মূলত এর মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের ইতি টানার কথা থাকলেও শহর থেকে ক্যাম্পাস বাস না আসা অবধি মেয়েরা হলে প্রবেশ করতে পারবে না! তাই মূল আয়োজন শেষে সবাই মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে 'মৃতু্যঞ্জয়ী মুজিব' মু্যরাল পাদদেশে আবারো স্মৃতি মধুর আড্ডায় লিপ্ত হই সবাই। এখানে কে সিনিয়র, কে জুনিয়র এই ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক সুরে সুর মিলিয়ে ভাতৃত্বের বন্ধনে মিলিত হই। এতে নিজেদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কের যেমন উন্নতি ঘটে তেমনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার হৃদয়ে এক অনন্য স্থান করে নেয় এই উৎসবটি। কিছু সময়ের জন্য আমার মনে হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি বছর অতিক্রম করে ফেললেও প্রথম বর্ষে ফিরে গিয়েছি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন ছোটগল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, 'শেষ হয়েও হইল না শেষ'। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের আমাদের এই আয়োজনটিও তেমনি আমাদের কাছে ছিল, 'আনন্দ উদযাপন শেষ হয়েও হইল না শেষ'! উপস্থিত সবার স্মৃতিতে অমলিন কার্তিকের এই প্রথম দিনটি!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে