শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুখ লুকিয়ে আর কতদিন?

গাজী আজম হোসেন, বেরোবি
  ০৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

নারীদের জাগরণে, নারীদের উন্নয়নে কাজ করে গেছেন বেগম রোকেয়াসহ অনেক মহীয়সী নারী। জাগরণ ঘটেছে নারীদের, ঘটেছে উন্নয়ন। কিন্তু সভ্যতার এই আধুনিক যুগে এসেও রয়েছে গেছে অনেক কুসংস্কার। ঘুমন্ত রয়ে গেছে অনেক নারী। বর্তমানে নারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এরপরও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নারী স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন নয় অনেক তরুণী। এসব নারীদের ঘুম ভাঙাতে কাজ করে যাচ্ছেন লক্ষ্ণীপুর সদর উপজেলার নন্দনপুর গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে স্নাতক (সম্মান) ও সম্প্রতি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা তরুণী নাদিয়া সুলতানা প্রিয়াংকা। আইন বিভাগে পড়াশোনা করলেও তিনি থেমে থাকেন নি। নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন ন্যাপ্রি এফ.থ্রি (ঘধঢ়ৎবঋ৩)। এই নামেরও রয়েছে রহস্য। ন্যাপ্রি এফ.থ্রি (ঘধঢ়ৎবঋ৩) এই নামটা এসেছে মূলত পিরিয়ড নিয়ে মেয়েদের পূর্বের ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য। এখানে ঘধঢ়" মানে হচ্ছে ঘুম আর "চৎব" মানে হচ্ছে পূর্বে- এভাবেই হয় "ঘধঢ়ৎব"। পূর্বে মেয়েরা পিরিয়ড নিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। পিরিয়ড নিয়ে সচেতন ছিল না। মেয়েদের সেই ঘুমন্ত অবস্থা ভাঙাতে বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ, কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে নাদিয়ারা।

আর ঋ৩ হচ্ছে আমাদের সংগঠনের স্স্নোগান। ত্রিপল এফ ডিফাইন করে- "ঋৎবব ঋৎড়স ঋবহপব" মানে হচ্ছে বেড়াজাল থেকে মুক্তি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে পিরিয়ড নিয়ে সমাজের সকল কুসংস্কার ও প্রতিবন্ধকতা দূর করে মুক্ত করে আনা এই সহজ সুন্দর সমাজকে। সর্বোপরি পিরিয়ড ট্যাবু দূর করা।

একদিন নাদিয়া লঞ্চে ঢাকা থেকে লক্ষ্ণীপুরের গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন। লঞ্চে কয়েকজন নারীর আলাপচারিতা তার কানে আসছিল। পিরিয়ড নিয়ে কথা বলছিলেন তারা। আলাপের একপর্যায়ে তাদের একজন জানতে চাইলেন, আপনার মেয়ে পিরিয়ডের সময় কী ব্যবহার করে? জবাবে অন্যজন বলছিলেন, কাপড়। ন্যাপকিন কেনার সামর্থ্য নেই। কথাটা নাদিয়াকে খুব আঘাত করে। তখন সিদ্ধান্ত নেন, কিছু একটা করতে হবে। বাসায় এসে অনলাইনে ঘাটাঘাটি করে জেনে নিতে লাগলেন পিরিয়ড নিয়ে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। নানান জরিপ ও তথ্য দেখে বিস্মিত হলেন। তখন ঠিক করলেন দরিদ্র তরুণীদের হাতে স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দেবেন। এর জন্য টাকা জমাতে লাগলেন নাদিয়া। পরিচিতদের কাছ থেকে প্রথমে সাড়া না পেলেও পাশে এসে দাঁড়িছিলেন মা।

এরপর ২০২১ সালে ৯ মে আন্তর্জাতিক মা দিবসে মাকে সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করেন। মা দিবসে কাজ শুরু করার কারণ একজন মেয়ের পিরিয়ড বলে দেয় তার মা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন হয়েছে। এরপর মা-মেয়ে দুইজন বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের যৌন স্বাস্থ্য-বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি গরিব মেয়েদের বিনামূল্যে স্যানেটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করেন নিজেদের অর্থায়নে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাদিয়ার কাজ ছড়িয়ে পড়লে অনেকের সাড়া পেয়েছিলেন। অনেকেই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এগিয়ে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সেই সময় ছায়াতল বাংলাদেশ নামে একটি সামাজিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সোহেল রানাও এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে ১০০ প্যাকেট ন্যাপকিন দেন।

নাদিয়া এখন পর্যন্ত লক্ষ্ণীপুরের নন্দনপুর, দালাল বাজার, রায়পুরের ফ্যাক্টরি, চাঁদপুর লঞ্চঘাট এলাকা, কয়লাঘাট এলাকা, ঢাকার রায়েরবাজার, হাজারীবাগ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট চা-বাগান, মৌলভীবাজার চা-বাগানে এই কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এই মাসেই ময়মনসিংহ ও সাতক্ষীরায় তিনি কার্যক্রম নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।

তবে এ কাজ করতে গিয়ে নাদিয়াকে নানান কথাও শুনতে হয়েছে। একবার এক জায়গায় ন্যাপকিন বিতরণ করতে গেলে কিছু লোক তাদের রীতিমতো আক্রমণাত্মক কথা বলতে শুরু করেন। কেউ বলেন, আপনারা এসব কী নিয়ে আসছেন, আমাদের মেয়েদের লজ্জা ভাঙাতে আসছেন। প্রতিনিয়ত এ ধরনের কথা শুনেও থেকে থাকেননি নাদিয়া। কাজ করে গেছে আপনগতিতে।

নাদিয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা; একদিন তিনি ন্যাপকিন তৈরির কারখানা দিবেন। সেখান থেকে কম দামে পিছিয়ে পড়া নারীদের ন্যাপকিন দিবেন। পাশাপাশি বয়সন্ধিকাল নিয়ে একটি বই লেখবেন। যেখানে ছেলে এবং মেয়ের উভয়ই বিস্তারিত লেখা থাকবে। বিভিন্ন স্কুলে সেমিনার করে শিক্ষার্থীদের হাতে এই বই তুলে দিবেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে