শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

কাক বন্ধু

শামীম খান যুবরাজ
  ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

শাকিবদের ঝুলবারান্দার পাশেই শজনে গাছটি তার ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে। শজনে গাছটির আরও দুটো সঙ্গী আছে দু'পাশে। একটি পেঁপে আর অন্যটি কাঁঠাল গাছ। শাকিবের বয়স মাত্র তিন বছর। স্কুলে যেতে হয় না তাকে। সারাদিন বসার রুম, বেডরুম আর ঝুলবারান্দায় খেলাধুলা করে। ওটা শাকিবের খুব প্রিয় জায়গা। সকালে আব্বু যখন অফিসে চলে যান তখন ঝুলবারান্দা সঙ্গী হয় তার। সঙ্গী হয় শজনে, পেঁপে আর কাঁঠাল গাছ। শজনের ডালে হরেক রকম পাখির ওড়াউড়ি সব সময় লেগেই থাকে। টুনটুনি, চড়ুই, বুলবুলি, দোয়েল, শালিকসহ আরও নাম না জানা পাখিরা কিচিরমিচির সুরে গান শুনিয়ে যায় শাকিবকে। শজনের যে ডালটি এক্কেবারে নিচে ডোবার পানি ছুঁইছুঁই করছে, সে ডালটিতে মাঝে মাঝে মাছরাঙারা ঘাপটি মেরে বসে থাকে। ঘাপটি মারা মাছরাঙাদের দেখলে শাকিবও চুপচাপ বসে তাদের মাছ ধরা দেখে। মাছ ধরার পর খুশিতে লেজ উঁচিয়ে টুইট টুইট ডাক দিলে শাকিব আনন্দে হাততালি দেয়। শাকিবের হাততালির শব্দে মাছরাঙা পালিয়ে যায়। তখন মাছরাঙাটির জন্য মন খারাপ করে সে। নিজের বোকামির জন্য মনে মনে নিজেকে বকা দেয়। বর্ষাকালে রিনিঝিনি শব্দে ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো শজনের ডাল ছুঁয়ে ব্যালকনিতে এসে পড়ে। শাকিব ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ঝরেপড়া দেখে। বৃষ্টি পেয়ে শজনে গাছটি যখন আনন্দে ডালপালা নাড়ায় শাকিবের মন খুশিতে ভরে ওঠে তখন।

একদিন সকালে আব্বুকে বিদায় দিয়ে ঝুলবারান্দার দিকে আসতেই কা কা শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ায় সে। কাঁঠাল গাছটির ঘন পাতার আড়াল থেকে একটি কাক কাতর কণ্ঠে অবিরাম ডেকে যাচ্ছে। শাকিব ভালো করে দেখল কাকটির একটি পা নেই। শাকিবকে দেখে অসহায় মায়াবী চাহনিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এক পায়ের কাকটির অসহায় অবস্থা দেখে কষ্ট হয় শাকিবের। দুপুরের পর ঘুম থেকে জেগে শাকিব দেখল কাকটি এখনও যায়নি। ঝিম ধরে বসে আছে কাঁঠাল পাতার আড়ালে।

পরদিন সকালে কাকটির কা কা রবে ঘুম ভাঙল শাকিবের। ঝুলবারান্দায় এসে দেখল কাকটি তার দিকে তাকিয়ে একটানা ডেকে যাচ্ছে। শাকিব বুঝতে পারে কাকটি ক্ষুধার্ত। কিন্তু কীভাবে খাবার দেবে? আম্মুকে ডেকে নিয়ে আসে ঝুলবারান্দায়। আম্মুও আফসোস করলেন অসহায় কাকটির জন্য। সেদিন ছিল আব্বুর অফিস ছুটির দিন। শাকিব আব্বুকে কাকটির কথা জানালে তিনি ঝুলবারান্দায় গিয়ে কাকটিকে দেখলেন। তার ছোট্ট ছেলেটির পাখির প্রতি ভালোবাসা দেখে খুব খুশি হলেন। শাকিবকে কাছে ডেকে বললেন, পাখির প্রতি তোমার ভালোবাসা দেখে আমি মুগ্ধ। আমাদের প্রিয় নবী (স.) পাখিদের খুব ভালোবাসতেন। তোমার এই কাক বন্ধুটিকে খাবারের ব্যাপারে আমি তোমাকে সাহায্য করব।

তারপর বাবা ঝুলবারান্দার পাশে পেঁপে গাছটির ছড়ানো পাতায় কিছু খাবার ছিটিয়ে দিলেন। ক্ষুধার্ত কাকটি শজনে ডালে বসে সেগুলো পেট পুরে খেল। তার মায়াবী চাহনি আর কা কা শব্দে কৃতজ্ঞতা জানাল শাকিবদের। এরপর প্রতিদিন রুটিন করে পেঁপের পাতায় কাকটিকে খাবার দেন শাকিবের আম্মু। শাকিব ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে কাকের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাবারের দৃশ্য দেখে। খাবার দিয়ে কাকটিকে 'বন্ধু কাক' বলে ডাক দিলেই শজনে ডালে এসে খাবার খেয়ে যায়। বন্ধু কাকের সঙ্গে বেশ ভালোই কাটছিল শাকিবের দিনগুলো।

একদিন ঘুম থেকে জেগে ঘরের মধ্যে ফকফকা আলো দেখে অবাক হয়ে যায় শাকিব। ঝুলবারান্দায় গিয়ে দেখে তার প্রিয় শজনে গাছটি নেই। কাঁঠাল আর পেঁপে গাছ দু'টিও রেহাই পায়নি নিষ্ঠুর কুঠারের হাত থেকে। গাছগুলো কেটে ডোবা ভরাট করে এপার্টমেন্ট করার কাজ শুরু করে দেয় ডেভেলপাররা। সকাল থেকেই ইট ভাঙা আর রড কাটার মেশিনের আওয়াজে কান ঝালাপালা।

এখন আর পাখির গানে ঘুম ভাঙে না শাকিবের। তার প্রিয় শজনে গাছটিও নেই। অভিমানী বন্ধু কাকও চলে গেছে তাকে ছেড়ে। এক পা নিয়ে বেচারা কোথায় আছে, কী খাচ্ছে কে জানে! ভাবতে ভাবতে চোখের কোণ ভরে যায় পানিতে শাকিবের।

শাকিবের আব্বু ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বাসা বদল করে নিলেন। আরও বড় ঝুলবারান্দা এখন নতুন বাসাটার। তবুও শাকিবের মনে আনন্দ নেই।

কিছুদিন পর পাশের বাসার রাহাতের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। রাহাত খুব ভালো ছেলে। সমবয়সি খেলার সঙ্গী পেয়ে শাকিব এখন খুশি। ছাদে বসে রাহাতকে তার বন্ধু কাকের গল্প শোনায়। সে অবাক হয়ে শোনে সেসব কথা। শাকিবের পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দেয় রাহাত, তোর বন্ধু কাকের জন্য আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে রে, মন খারাপ করিস না সে নিশ্চয়ই ভালো আছে।

দুই বন্ধুর কথা শুনে কাছে এসে বসলেন শাকিবের আব্বু, জান, কাকরা আমাদের পরম আপনজন, প্রকৃতির বন্ধু। আমাদের প্রতিদিনের ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো খেয়ে ওরা পরিবেশ রক্ষা করছে। পরিষ্কার রাখছে আমাদের আশপাশ।

আব্বুর কথায় শাকিব খুশি হয়ে বলে, তাহলে তো সব কাকেরাই আমার বন্ধু। আকাশের দিকে দু'হাত ছড়িয়ে দেয় শাকিব। চোখ দু'টো বন্ধ করে নেয়। সে দেখতে পায় আকাশে উড়ে বেড়ানো শত শত কাকের মাঝে তার এক পা ওয়ালা বন্ধু কাকটিও উড়ছে আর কা কা শব্দে শাকিবকে ডাকছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে