শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

রাখাল ও ঘোড়া

প্রদীপ সাহা
  ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

সে অনেক দিন আগের কথা। এক গ্রামে বাস করত এক রাখাল। আপন বলতে তার বৃদ্ধা মা ছাড়া আর কেউ ছিল না। সে মেষেরপাল দেখাশুনা করে সংসার চালাত। রাখালটি একজন ভালো

গায়কও ছিল। প্রতিদিন সে গান গাইতে গাইতে মেষেরপাল নিয়ে মাঠে যেত এবং সূর্যাস্তের সময় সেগুলো নিয়ে আসত। মেষেরপাল নিয়ে যতক্ষণ সে মাঠে থাকত, প্রায় সময়ই সে নিজে গান তৈরি করে গাইত এবং অনেকে তার সুন্দর গান শোনার জন্য ভিড় করত। পশুপাখিরাও আনন্দে তার গান শুনতো।

একদিন মেষেরপাল নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে রাখালটি একটি ছোট ঘোড়ার বাচ্চাকে একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। বাচ্চাটি দেখতে খুব সুন্দর ছিল। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে দেখে সে ভাবল, এ অন্ধকার জঙ্গলে এভাবে বাচ্চাটি রেখে গেলে অবশ্যই একে বাঘ-ভালস্নুকে আক্রমণ করবে। বাচ্চাটির জন্য তার খুব মায়া হলো এবং এটিকে কোলে করে বাড়িতে নিয়ে এলো।

ঘোড়ার বাচ্চা কোলে দেখে মা অবাক হলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন- এটি তুমি কোথায় পেয়েছ?

রাখাল তখন ঘোড়ার বাচ্চা পাওয়ার সব ঘটনা মায়ের কাছে খুলে বলল। সে দিন থেকে বাচ্চাটি তাদের বাড়িতে রইল এবং বড় হতে লাগল। সে বাচ্চাটিকে যথেষ্ট আদর করত এবং প্রতিদিনই এর যত্ন নিত। অল্প দিনেই দু'জনের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব ভাব গড়ে উঠল।

এক সময় বাচ্চাটি বড় হয়ে একটি বড় ঘোড়ায় পরিণত হলো। কী করে দ্রম্নত দৌঁড়াতে হয়, তা শিখল। ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেড়াতে রাখালের খুব ভালো লাগত। আর তাই সে মুহূর্তের মধ্যে ঘোড়া নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেত, আবার কিছুক্ষণ পর ফিরে আসত।

ঘোড়াটিও মনের আনন্দে তার বন্ধুকে নিয়ে মনের সুখে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াত।

একদিন সেই দেশের রাজা ঘোড়দৌঁড়ের ব্যবস্থা করলেন এবং ঘোষণা দিলেন, ঘোড়দৌঁড়ে যে জয়ী হবে তাকে পুরস্কার হিসেবে অর্ধেক রাজত্ব এবং রাজকন্যা দেওয়া হবে। গ্রামের অনেকেই রাখালকে বলল- তোমার ঘোড়া খুব দ্রম্নত দৌঁড়াতে পারে। কাজেই তুমিও এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পার এবং জয়ী হয়ে আমাদের গ্রামের সম্মান আনতে পার।

রাখাল জানত, তার ঘোড়া অবশ্যই ভালো দৌঁড়াতে পারে এবং জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও আছে।

কিন্তু সে দৌঁড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য ইচ্ছে করল না। বলল- আমি এভাবে দিনযাপন করেই সুখে আছি। তারপর সে ব্যাপারটি নিয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করল এবং নিজ

গ্রামের সম্মানের কথা ভেবে ঘোড়দৌঁড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে রাজি হলো।

ঘোড়দৌঁড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো। বিভিন্ন দেশের রাজপুত্র এবং অনেক অশ্বারোহীরা তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করতে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এলো। বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য নারী-পুরুষও ছুটে এসেছে এ দৌঁড় দেখতে।

রাখাল বিপুল প্রত্যাশা এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রতিযোগিতায় যোগ দিল। তার পরনে অন্যদের মতো কোনো রাজকীয় বা দামি পোশাক ছিল না। অত্যন্ত সাধারণ পোশাকে তাকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দেখে অনেকে তাকে তিরস্কারও করল। রাখাল কোনোদিকে কর্ণপাত না করে প্রবল বিশ্বাসে প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি হচ্ছিল এবং ঘোড়াটিকে আদর করছিল।

শুরু হলো প্রতিযোগিতা। অন্যসব ঘোড়াকে পেছনে ফেলে রাখালের ঘোড়া যেন বিদু্যৎগতিতে ছুটে চলল। তার এমন আকর্ষণীয় ঘোড়া চালানো এবং জয়ী হওয়া দেখে দর্শকদের সবাই যেমন অবাক হয়েছিল, তেমনি মজাও পাচ্ছিল। অংশগ্রহণকারীরা অনেকেই তার জয়ী হওয়াকে ভীষণভাবে হিংসা করতে লাগল।

রাজা বিজয়ী যুবকটির পরিচয় জিজ্ঞেস করে জানলেন, সে একজন গরিব রাখাল। পরিচয় জানার পর তিনি রেগে গেলেন এবং সামান্য একটা গরিব রাখালের সঙ্গে তার মেয়েকে বিয়ে দিতে কিছুতেই রাজি হলেন না। রাজা তাকে বললেন- তোমার মতো একজন গরিব রাখালের সঙ্গে আমি আমার মেয়ে বিয়ে দিতে পারি না। তুমি তোমার ঘোড়াটা আমাকে দিয়ে দাও। আমি তোমাকে অনেক টাকা দেব।

রাজার এ কথা শুনে রাখাল রেগে গেল এবং বলল- পৃথিবীর সব ধনসম্পদ এনে দিলেও আমি আমার ঘোড়া কাউকে দেব না। আমি আপনার কাছে কিছুই চাই না। এই বলে সে

ঘোড়া চালিয়ে বাড়ি চলে এলো।

রাখালের কথায় রাজা অত্যন্ত অপমান বোধ করলেন। তিনি ভাবলেন, একটা গরিব রাখাল তার আদেশ অমান্য করেছে! এ হতে পারে না! তাই তিনি রাখালের ঘোড়াটি নিয়ে আসার জন্য

তার সিপাহিদের আদেশ দিলেন। রাখাল তখন মাঠে মেষ চড়াচ্ছিল এবং ঘোড়াটি একটু দূরে ঘাস খাচ্ছিল। সিপাহিরা তাকে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে চাবুক মেরে

ঘোড়াটি নিয়ে গেল। গ্রামের কয়েকজন লোক রাখালকে এ অবস্থায় দেখতে পেয়ে ধরাধরি করে তাকে বাড়িতে নিয়ে এলো। বৃদ্ধা মা ছেলের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে এবং সব শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে সুবিচার প্রার্থনা করলেন।

কিছুদিনের মধ্যে রাখালটি সুস্থ হয়ে উঠল। সে সারাক্ষণই শুধু ঘোড়াটির কথা ভাবত।

কিছুই ভালো লাগত না। তার সব সুখ-আনন্দ যেন ঘোড়াটা সঙ্গে নিয়ে গেছে! ওদিকে ঘোড়াটিও সুখী ছিল না। রাজার আস্তাবলের কোনোকিছুই ওর ভালো লাগত না। কারণ ঘোড়াটি রাখালকে প্রচুর ভালোবাসত। তাই প্রায় সময়ই ঘোড়াটি বাড়িতে ফিরে যেতে চাইত এবং পালাতে চেষ্টা করত। কিন্তু সুযোগ না হওয়ায় ইচ্ছে সত্ত্বেও ঘোড়াটি যেতে পারছিল না।

একদিন রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি একটি অনুষ্ঠান দেখার জন্য রাজা এই ঘোড়াটির

পিঠে চড়ে সেখানে যাচ্ছিলেন। তিনি যখন ঘোড়ার ওপর বসে লোকজনের সঙ্গে কথা

বলছিলেন, তখন ঘোড়াটি হঠাৎ সামনের পা দু'টো তুলে রাজাকে পিঠ থেকে ফেলে দিল এবং অত্যন্ত দ্রম্নতগতিতে তার বন্ধুর কাছে আসার উদ্দেশ্যে দৌঁড়াতে আরম্ভ করল। রাজার

লোকরা এ অবস্থা দেখে ঘোড়ার পেছনে পেছনে দৌঁড়াতে লাগল এবং তার দিকে তীর নিক্ষেপ করতে থাকল। বেশ কয়েকটি তীরবিদ্ধ হয়ে ঘোড়াটি ভীষণভাবে আহত হলো। কিন্তু রক্তাক্ত অবস্থায়ই সে তার বন্ধুর বাড়ির দিকে দৌঁড়াতে শুরু করল।

রাত তখন অনেক। রাখাল তার নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছিল এবং স্বপ্ন দেখছিল, তার প্রিয় ঘোড়াটি তারই দিকে ছুটে আসছে। হঠাৎ রাখাল শুনল, তার দরজায় কে যেন শব্দ করছে! তাই সে দ্রম্নত উঠে দরজা খুলল এবং তার প্রাণপ্রিয় ঘোড়াটিকে সত্যি সত্যিই ফিরে আসতে দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ঘোড়াটির রক্তাক্ত আহত শরীরটাকে

দেখে সে চিৎকার করে কেঁদে উঠল।

রাখাল প্রাণপণে ঘোড়াটির সেবাযত্ন করা শুরু করল। কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করার পরও সে ঘোড়াটিকে বাঁচাতে পারল না। তিনদিন পর ঘোড়াটি মরে গেল। ঘোড়ার জন্য সে অনেক কাঁদল। তার দুঃখে গ্রামের অনেকেও তার সঙ্গে কাঁদল। পশুপাখি সব যেন রাখালের এ দুঃখে তাদের স্বরে ডাকতে ভুলে গেল।

দিন-রাত এভাবে কাঁদতে কাঁদতে এ ে সময় রাখাল মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। এক রাতে সে

স্বপ্ন দেখল, ঘোড়াটা তাকে বলছে- ওহে বন্ধু! তুমি যে আমার জন্য মরতে বসেছ! কিন্তু তোমাকে যে বাঁচতে হবে, গান গাইতে হবে! আর তুমি যদি হাসি-খুশি থাকো, আবার নতুন করে গান শুরু কর, তবেই আমি শান্তি পাব।

সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠে রাখাল স্বপ্নে দেখা ঘোড়ার কথাগুলো নিয়ে অনেকক্ষণ ভেবে চলল এবং আবার গান গাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। পরদিন থেকে সে আবার গাইতে শুরু করল। তার

গান যেন আগের চেয়ে আরও বেশি মিষ্টি! সে তার গানে চারপাশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরত। লোকজন সবাই প্রচন্ড আগ্রহে তার গান শুনত। অল্পদিনের মধ্যে সে একজন বড় গায়কে পরিণত হলো এবং তার গুণের কথা বিভিন্ন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল।

ওদিকে সেই রাজার মেয়ে রাখালের ঘোড়দৌঁড়ে জয়ী হওয়ার খবর থেকে শুরু করে বর্তমানে একজন নামকরা গায়ক হওয়ার সমস্ত ঘটনা শুনতে পেয়ে তাকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য রাজার কাছে তার ইচ্ছে ব্যক্ত করল। রাজাও তার সেদিনের সেই ব্যবহারের জন্য মেয়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন।

রাজা পরদিনই রাখালকে অত্যন্ত সমাদরের সঙ্গে রাজপ্রাসাদে ডেকে নিয়ে এলেন। তিনি রাখালের কাছে সেদিন তার খারাপ ব্যবহারের জন্য বারবার দুঃখ প্রকাশ করলেন। তারপর মহা ধুমধামের মধ্য দিয়ে রাখালের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে দিলেন। রাখাল শত আনন্দের মধ্যেও তার

সেই প্রাণপ্রিয় বন্ধু ঘোড়ার জন্য কেঁদে উঠল এবং ঘোড়াটির অনুপ্রেরণা ও অবদানের কথা বারবার স্মরণ করল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে