শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিবেকের মামলা এবং একটি আত্মার মৃতু্যদন্ড

মো. খশরু আহসান
  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের গেট দিয়ে বের হয়ে কিছুদূর এগিয়ে হাতের বামে কাঁচাবাজার। কিছুটা খোলামেলা পরিবেশ। সবকিছুর দামও গতানুগতিক কম। বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি হয়েছে। আগে পাঁচ টাকার এক কাপ চা হতো। এখন হয় না। সাত থেকে আট টাকা না হলে লজ্জায় পড়তে হয়। প্রতিটি সিগারেটের দাম বেড়েছে প্রায় দুই থেকে তিন টাকা। একটা অদ্ভুত ব্যাপার, এই পৃথিবীতে সবকিছুর দাম কমানোর জন্য আন্দোলন সংগ্রাম হলেও সিগারেটের দাম কমানোর জন্য কোনো আন্দোলন হয় না। অথচ এটাই হওয়া উচিত ছিল। একজন বেকার ছেলে রিকশা ভাড়ার টাকা বাঁচিয়ে একটা সিগারেট আর একটা চা দিয়ে সকালের নাস্তা সাড়বে অথচ তার দামও বেড়ে যাবে- এইটা কোনো যৌক্তিক ব্যাপার হতে পারে না। তার চেয়েও জরুরি বিষয় হলো, বাজারে মানুষের দাম বৃদ্ধি পায় না। গাণিতিক কিম্বা জ্যামিতিক, যে কোনো হারে কমতেই থাকে। আমার দীর্ঘ বক্তব্য শেষ না করেই থামতে হলো। অবনীতা আমার দিকে তাকালে আমি কথা বলতে পারি না। সপ্তাহখানেকের সাজানো গোছানো কথা অগোছালো হয়ে যায়।

অবনীতার হাতে চায়ের কাপ। কড়া লিকারের টকটকে চা। মেয়েরা কড়া চা সহ্য করতে পারে না, খায় হালকা চা। অবনীতা তার উলটো। সে খাবে কড়া লিকারের চা। চিনি ছাড়া। সম্ভবত জগতের সব শক্ত মন মানসিকতার মেয়েরাই কড়া লিকারের চা পছন্দ করে কিনা। কাপের শেষ চুমুক দিয়ে অবনীতা রাজ্জাক মামাকে আরেক কাপ চা দিতে বলল। আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমি এই মুহূর্তে তার সামনে এসে বিশাল অন্যায় করে ফেলেছি। চাঁদের মতো অসহ্য সুন্দর চোখদুটো বাঁকা করে অবনীতা বলল, তোমার কি এতটুকুও বিরক্ত লাগে না এত কথা বলতে? অবনীতা আরেক কাপ চা হাতে নিতে নিতে বলল, এই যে দেশ নিয়ে এত চিন্তা তোমার। কী লাভ! তুমি কি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি উনার সহকারী যে তোমার এত ভাবতে হবে? আমি বললাম, কোনোটাই না। একজন সাধারণ মানুষ। অবনীতা, তুমি খুব প্রয়োজনীয় একটা তথ্য জানো না। সংবিধানের তৃতীয় পরিচ্ছেদের ৩৯ নম্বর ধারায় আমাদের বাকস্বাধীনতার কথা বলা আছে। অবশ্যই এবং আজই তোমার এই পরিচ্ছেদের সব ধারা উপধারা পড়া উচিত। বাস্তবজীবনে কাজে দেবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ সংবিধান সম্পর্কে ধারণা রাখে না। সংসদ সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন দক্ষ সাংসদ ছাড়া অধিকাংশই খাপছাড়া ধরনের কথা বার্তা বলে। সরকারি দলের সদস্য হয়েও সরকারকেই বিপদে ফেলে দেওয়ার মতো বক্তব্য দেয়। একদল বলে অমুক তারিখের পর দেশ চলবে তাদের নেত্রীর কথায়। আরেক দল বলে, অমুক তারিখ থেকে দেশের অলি গলি থাকবে তাদের দখলে। এই যে দেশ চলবে, নেত্রীর কথায়, অর্থাৎ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা এক দলের। অলি গলি দখল, অর্থাৎ আরেক দলেরও পালটা হুংকার, এই দুইয়ের কোনোটাই জনগণের জন্য স্বস্তির খবর না। দুই দলই ভাবছে তাদের দখল দখল খেলা জনগণের জন্য। সত্যি বলতে এই দুইটি প্রেক্ষাপটের কোনোটিই জনগণের জন্য না, নিজেদের জন্য। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও দখলদারিত্বের রাজনীতি চলবে, এ কথা মানা যায় না। অথচ সংবিধান বলছে, জনগণ সব ক্ষমতার উৎস। আরও শুনো। দেশের সব রাজনৈতিক দলেরই দাবি, দেশের জনগণ তাদের সঙ্গে আছে। অথচ সাধারণ মানুষ দু'বেলা ভালোভাবে খেতেও পারছে না বাজার ব্যবস্থার অস্থিরতার কারণে। কি অদ্ভুত, তাই না?

অবনীতার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে এই মুহূর্তে চরম পর্যায়ের বিরক্ত হচ্ছে। অবনীতা বলল, তোমাকে প্রমাণ করতে হবে না। তুমি নিশ্চয়ই বিরোধী দলের দলনেতা না। আমি আশ্চর্য হলাম। অধিকাংশ বুদ্ধিমতী মেয়েরাই দেশ নিয়ে ভাবতে চায় না। তারা ভাবে সংসার জীবন নিয়ে। একদল মেয়েরা আবার খুব সচেতন। মেয়েরা মনের দিক থেকে নরম স্বভাবের হয়। তারা ভালোবাসাকে যত্ন করে পুষে রাখে। সময়মতো সুবাস ছড়ায়। আমি বললাম, অবশ্যই করতে হবে। যারা রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করতে হলে সেই সমালোচনার পেছনে শক্ত যুক্তি থাকা চাই। তা না হলে দেখবে একদিন থানা থেকে আমার কল লিস্টের তৃতীয় নাম্বারে ফোন করে বলা হবে, ম্যাম আপনাকে একটু গুলশান থানায় আসতে হবে। খশরু সাহেবকে আমরা নিয়ে এসেছি। উনি প্রমাণ ছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তুমিই বল, রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ হতে চাওয়া কোনো মানুষকে বাকের ভাইয়ের মতো থানায় আটকে রাখা হয়েছে; সেটা কি তোমার ভালো লাগবে? না। অবনীতার এক কথায় উত্তর। এত বড় ধরনের একটি আলাপচারিতার প্রতিত্তর হঁ্যা কিম্বা না হওয়া উচিত না। অথচ অবনীতার উত্তর এমনই হয়। খাপছাড়া। আপেক্ষিক তত্ত্ব কিম্বা বিগ ব্যাং তত্ত্বের বিশাল ইতিহাস অবনীতাকে শোনালেও সে তার ফিরতি অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলবে, হুম। এ এক ভয়ানক রোগ। হঠাৎ করে কারো খারাপ খবর শুনলেও এই ধরনের মানুষ বলবে হুম। ভালো খবরেও যে এরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তা না। সেক্ষেত্রেও একই উত্তর। আচ্ছা। এই ধরনের মানুষ সমাজে অত্যন্ত রসকষহীন তিক্ত মানুষ হিসেবে পরিচিত। এদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, দিনের কোনো নির্দিষ্ট সময়ে এরা খুব সুন্দর করে কথা বলে।

\হঅবনীতা চা খেয়েই চলেছে। আমার কথার দিকে মনযোগ নেই। এই পৃথিবীতে যার কথা শোনার মানুষ নেই, সে বড়সড় ধরনের অভাগাদের কাতারে। আমার নিজেকেও এখন এই কাতারের বলেই মনে হচ্ছে। কারণ অবনীতার দৃষ্টি আটকে আছে একটু সামনের দিকে বসা একটি কালো রংয়ের কাকের দিকে। অবনীতার ধারণা, পশুপাখির মধ্যেও চাহিদা আছে। কাকের মধ্যে নেই। কাক নির্ভেজাল প্রাণী। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কবি সাহিত্যিকরা কখনো এই প্রাণীকে নিয়ে সচরাচর কবিতাও লিখে না। কুকুরের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। নেজ নাড়াতে নাড়াতে এরা মানুষের পাশে এসে বসে। মানুষের মমতার স্পর্শ চায়। সমস্যা হলো, দেশি কুকুরগুলোর আভিজাত্য এই দেশে নেই। মানুষ পরম যত্নে বিদেশি কুকুরকে পোষে। দেশি কুকুরগুলো অবহেলিত। মানুষ রাস্তায় বিপদে পড়লে অন্য মানুষ তাকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে যায় না। মোবাইলে ভিডিও করে। এই দেশ এরকম কিছু ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত।

মনে হলো অবনীতা খুব মনযোগ দিয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে। করলও তাই। তোমার কল লিস্টের তৃতীয় নাম্বার কেন আমারই হবে? ঠিক বুঝিনি।

অবনীতার অনেকগুলো অভ্যাসের মধ্যে এটি একটি। যখন বলব তখন জিজ্ঞেস করবে না। দশ নাম্বার গল্প বলার সময় এক নাম্বার গল্পের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করবে। আমি হাসলাম। বললাম, একটা সিগারেট ধরালে তোমার সমস্যা হবে?

অবনীতা হাসলো। ভয়ানক সুন্দর সেই হাসি। চন্দ্রগ্রহণের মতো। চাঁদকে তার কথিত কলঙ্ক গিলে খেয়ে ফেলছে অথচ মানুষ খুব আগ্রহ নিয়ে তা উপভোগ করছে। কি ভয়ানক কথা! আমি সিগারেট ধরালাম। শ্রোতা যখন খুব মনযোগ দিয়ে কথা শুনতে চায় তখন বক্তা হিসেবে অতিরিক্ত সাবধানতার প্রয়োজন পড়ে। আমি বললাম, আমার কল লিস্টের প্রথম ব্যক্তি আমার বাবা। দ্বিতীয় ব্যক্তি মা। নিয়ম অনুযায়ী তোমার নাম্বার তৃতীয় অবস্থানে থাকে। অবনীতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। 'তুমি কি এই জীবনে কখনোই গুরুত্ব দিয়ে আমার কথা শুনবে না?' অবনীতা বলল। আমি হেসে উঠলাম। বললাম, গত রাতে খুবই গুরুত্ব দিয়ে একটি কথা ভাবলাম। 'কি কথা?' 'আমি যদি আলাদীনের প্রদ্বীপ হাতে পাই কখনো, তাহলে প্রথমে কি চাইব জানো?' 'কি?' ' সিগারেটের ধোঁয়া।'

\হ'পৃথিবীতে এতকিছু থাকতে ধোঁয়া হতে চাইবে কেন?'

\হ'আমার প্রচন্ড ইচ্ছে করে ধোঁয়ার মতো প্রখর অবস্থাতেও ধীরে ধীরে বাতাসের সঙ্গে মিশে যেতে।'

\হ' তোমার এসব খাপছাড়া কথা শোনার ইচ্ছে কিম্বা আগ্রহ কোনোটাই আমার নেই। আমি উঠছি।'

অবনীতা চলে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে মানুষের স্রোতে মিশে গেলও। আমার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ধোঁয়াগুলো আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর মিশে যাচ্ছে বাতাসে। অবনীতা কখনোই পেছনে ফিরে তাকাবে না জেনেও আমি অপেক্ষা করি। একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকি। বুদ্ধিমতী মেয়েরা কখনোই পেছনে ফিরে তাকায় না। কোনো অনিশ্চিত জীবনের দিকে পেছন ফিরে তাকানোর কোনো মানে হয় না, তা তারা জানে। পেছন ফিরে তাকিয়ে মায়া বাড়িয়ে অবনীতারা পিছুটান তৈরি করতে নারাজ।

\হএকশত বসন্ত চলে গিয়েছে। অবনীতা ফিরে আসেনি। অন্ধকার আর আলো এক হয়ে নিজেদের নতুন রূপ দিয়েছে। হয়েছে সাগরের জল। ঢেউয়ের মাঝে থাকা বিন্দু বিন্দু কণা। বঙ্গোপসাগরের গহিন তলদেশে তাদের বসবাস।

\হঅবনীতা জানো? তোমার মায়ায় জড়িয়ে পড়ার অপরাধে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আমার বিবেক আমার আত্মার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। মামলার বাদী আমারই বিবেক এবং বিবাদী আমার আত্মা। আমি বুঝতে পারলাম, অপরাধের বিধান অনুযায়ী আমার ভয়াবহ শাস্তি হবে। অতএব, বিবাদী হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নির্দ্বিধায় আমার আত্মার অপরাধ স্বীকার না করার মতো নির্লজ্জ আমি নই। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম, আমার আত্মার পক্ষের কোনো উকিল কোর্টে দাঁড়াচ্ছে না। অতএব, আত্মাকেই লড়তে হবে এমন মানসিক প্রস্তুতি আমি নিয়ে ফেললাম। বিচারক আমার কথা শোনার অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন। আমি আরও লক্ষ্য করলাম, অসংখ্য দর্শক আমার পক্ষের যুক্তি শোনার অপেক্ষা করছে। সম্ভবত বিচার ব্যবস্থার ইতিহাস এ এক অনবদ্য মামলার সাক্ষী হতে চলেছে।

আমার মায়া দিয়ে আঁকা ছবি এতটাও সহজলভ্য নয় যে, তা আমি খুব সহজেই প্রকাশ করে তার মান কমিয়ে দেব। তোমার অবয়ব আমার ক্যানভাসের অত্যন্ত মূল্যবান। দেশের সংবিধানে এমন আইন ও শাস্তির বিধান থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এক কোটি বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং জীবনের সমস্ত মায়ার সমান অহেতুক অর্থদন্ড। সশ্রম কারাদন্ড হলে সে বিধান মানতে আমি নারাজই হব।

অতঃপর বিচারক মামলার রায় ঘোষণা করলেন। ১৩১ পাতার সেই রায়ের সারসংক্ষেপ হলো এই যে, আমার মৃত্যদন্ড কার্যকর হলে শাস্তি হিসেবে তা কিছুটা কম হয়ে যায়। অতএব, আমার স্বাভাবিক মৃতু্য হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তোমার মায়ার পরিমাণ যতটুকু বৃদ্ধি পাবে তা- প্রতিদিন আমাকে একবার করে প্রচন্ড যন্ত্রণা দেবে এবং তা হত্যার সমপরিমাণ হিসেবেই বিবেচনা হবে। রায়ের সারমর্ম হলো, আমার দেহ বেঁচে থাকবে, তবে ফাঁসি হবে আমার আত্মার। রাষ্ট্রপতির কাছে আমার ফাঁসি না হওয়ার জন্য আমি অনুরোধ করলাম না। অনুরোধ করলাম আমার দেহের মৃতু্যর জন্য। তিনি আমার কথা রাখলেন না। প্রেম কিম্বা ভালোবাসায় জড়ানোর অপরাধের ক্ষমা হতে পারে। মায়ায় জড়ানো অপরাধের কোনো ক্ষমা হয় না।

অবনীতা, তোমার মিথ্যে মায়ায় জড়িয়ে পড়ার অপরাধে আমার আত্মার মৃতু্য হলো। ভয়াবহ সেই মৃতু্য। দেহের মৃতু্য হয় একবার। আত্মার মৃতু্য একবার হয় না, হয় লক্ষ্য কোটিবার। এই মৃতু্য হতেই থাকে। হতেই থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে