বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলায় আইন ও বিচারকাজ প্রচলনের বিরুদ্ধের যুক্তিগুলো কতটা গ্রহণযোগ্য?

হাতেগোনা অল্প কিছু আইন বাদে এ দেশের সব আইন ইংরেজিতে তৈরি। দেশের সব জায়গায় বাংলাকে প্রচলন করতে হলে আইনগুলো বাংলাতে হওয়া জরুরি। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। একই সঙ্গে দেশে আইন শিক্ষাও বাংলায় চালু করা জরুরি। এটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। একটি বড় সংখ্যাই আইনের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বিচারক ও আইনজীবীরা মনে করেন যে আইন পুরোপুরি বাংলা শেখা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে তাদের কিছু যুক্তিও আছে। বাংলায় আইন শিক্ষা, আইন প্রণয়ন, বিচারকাজ পরিচালনার সমস্যা, চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা নিয়ে দুই পর্বের আলোচনার আজ ছাপা হলো শেষ পর্ব। লিখেছেন তালহা মুহাম্মদ
নতুনধারা
  ০৮ মার্চ ২০২২, ০০:০০
বাংলায় আইন ও বিচারকাজ প্রচলনের বিরুদ্ধের যুক্তিগুলো কতটা গ্রহণযোগ্য?

বাংলায় আইনের প্রচলনের বিপক্ষে কিছু আপত্তি উত্থাপন করা হয়। যেমন-

১. অনেক ইংরেজি শব্দের বাংলা পরিভাষা নাই।

-এই অভিযোগ সত্য। কিন্তু এটা শুধু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই না পৃথিবীর সব ক্ষেত্রেই সত্য। অনেক বাংলা শব্দ আছে যেগুলোর ইংরেজি শব্দ নেই। যেমন- বাংলাভাষায় দাদা এবং নানা দুইটি আলাদা শব্দ। অথচ এই দুইটার একটামাত্র ইংরেজি শব্দ এৎধহফভধঃযবৎ। ইংরেজিতে উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টনের সময় দাদা ও নানা আলাদা ব্যক্তিকে একই শব্দ (এৎধহফভধঃযবৎ) দ্বারা প্রকাশ করলে সমস্যা দেখা যায়। নতুন শব্দের মাধ্যমে তারা এই সমস্যার সমাধান করেছে। দাদার ইংরেজি ঞৎঁব এৎধহফভধঃযবৎ এবং নানার ইংরেজি ঋধষংব এৎধহফভধঃযবৎ করেছে। সুতরাং যেসব ইংরেজি শব্দের বাংলা পরিভাষা নেই তার বাংলা পরিভাষা তৈরি করতে হবে।

২. বাংলায় আইন পড়া ইংরেজির তুলনায় কঠিন।

-জন্মের পরে যদি কেউ তার চাচাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখে তাহলে হঠাৎ করে নিজের পিতাকে আব্বা বলে ডাকতে সংকোচ বোধ হবেই। অথচ ইংরেজিতে যাদের ভালো দক্ষতা নেই তারা বাংলায় খুব সহজেই আইন পড়তে পারেন। এমন অনেককে দেখেছি, যারা বাংলায় আইন পড়ে বুঝেছেন এবং ইংরেজিতে পরীক্ষা দিয়েছেন।

ইংরেজিতে আমরা আইনের যে বিশেষ শব্দগুলো শিখেছি তার বাংলা অর্থ না জেনে বাংলায় আইন পড়তে গেলে কষ্ট হবেই। কেউ ইংরেজিতে ৎবং লঁফরপধঃধ-এর সংজ্ঞা জানে, কিন্তু এর বাংলা অর্থ 'দোবারা দোষ' এটা না জেনে বাংলায় আইনের বই খুলে পড়লে তা না বোঝাটাই স্বাভাবিক। বাংলায় আইন পড়ার আগে আপনাকে ইংরেজির প্রতি আলগা পিরিতি ত্যাগ করতে হবে। অনার্স-মাস্টার্সে ইংরেজিতে আইন পড়ে এখন বাংলাতেও আইন বুঝি। আরো অনেকেই বোঝে। সুতরাং আপনি নিজের মানদন্ডে সবাইকে মাপতে পারেন না।

৩. আইনগুলোর অনুবাদ অত্যন্ত দুঃসাধ্য কাজ।

- আইনের অনুবাদের কাজ দুঃসাধ্য, কিন্তু অসাধ্য নয়। দিনে দিনে বাংলা ভাষায় আমাদের দক্ষতা এত নিচে নেমেছে যে শুধু আইন নয়, যে কোনো কিছুর অনুবাদ করতে গেলে আমাদের হাত চলে না, কেউ যেন ভেতর থেকে গলা চেপে ধরে এবং মাথা কাজ করে না। দুঃসাধ্য বলে আমরা প্রয়োজনীয় কোনে কিছু ফেলে রাখি না। আইনগুলোর অনুবাদ দুঃসাধ্য হতে পারে কিন্তু অসম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিখ্যাত একজন আইন বিশেষজ্ঞ এবং বিচারক গাজী শামছুর রহমান তার 'বিচারক জীবনের স্মৃতিচারণ' গ্রন্থে উলেস্নখ করেন, 'আইন বাংলাভাষার ব্যবহারের প্রচলন না থাকায় ভাষ্য প্রণয়নের সময় পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। তবুও বলব, এই সমস্ত বাধা অনতিক্রম্য নহে'।

গাজী শামছুর রহমান মৌলিক আইনগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন এবং তার ভাষ্যও বাংলা লিখেছেন। বিচারপতি হামিদুল হক তার 'বিচার প্রক্রিয়া' নামের বইতে ফোরজারি ও দেওয়ানি মামলার প্রক্রিয়া খুব সুন্দর করে বাংলায় আলোচনা করেছেন। এরপরেও বলবেন এসব দুঃসাধ্য কাজ?

৪. আইনের অনেক বিদেশি বই ইংরেজিতে লেখা। বিদেশি রায়ের ওপর উচ্চ আদালতের রায় নির্ভর করে।

-আদালতে বাংলাভাষা চালু করার অর্থ এই নয় যে, আদালতের চত্বর থেকে ইংরেজিকে নিষিদ্ধ করতে হবে। যদি কোন আইনজীবী মনে করে তার বিদেশে আইন কিংবা মামলার সাহায্যের দরকার তাহলে সে ইংরেজি শিখবে। প্রয়োজনে তারা ইংরেজিতে পড়বে। কিন্তু আইন বাংলা চালু করায় তো কোনো সমস্যা না। যারা বাংলার পক্ষে কথা বলেন তারা ইংরেজি পারেন না বিষয়টা এরকম না। আপনি সারাদিন ইংরেজি আইন পড়েন কোনো সমস্যা নেই। ইংরেজি শিখলে তো আর কেউ বাংলা ভুলে যায় না। কিন্তু কোনো জাতি যদি তাদের প্রাত্যহিক জীবনে ভিন্ন ভাষার চর্চা করে তাহলে তাদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাবে। এ দেশে আইনগুলো বাংলায় হবে এবং কোর্টের কার্যক্রমও বাংলায় চলবে- এটাই দাবি। এর বাহিরে কেউ নিজের ইচ্ছায় মান্দারিন ভাষায় আইন শিখলেও কেন সমস্যা হওয়ার কথা না।

৫. আশপাশের দেশ কেন তাদের মাতৃভাষায় আইন করছে না।

-এই কথা দ্বারা সাধারণত ভারতকেই নির্দেশ করা হয়। ভারতে একক কোনো ভাষার আধিপত্য নেই। অনেক বড় দেশ, শত রকমের ভাষা। দেখা যাচ্ছে, ভারতের যে কোনো একটি ভাষায় আইন চালু করা হলে তা অন্য ভাষাভাষী লোকজনের কাছে তা বিদেশি ভাষার মতোই হবে। কিন্তু আমাদের দেশে বাংলাভাষাই প্রধান। আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে একমাত্র চাকমাদের ভাষার বর্ণমালা আছে। তাছাড়া আইনে এরকম বলা আছে যে, আদালত চাইলে তারা নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করতে পারবে। এই ভাষার দ্বারা সাধারণত স্থানীয় ভাষাকেই নির্দেশ করে।

৬. উচ্চ শিক্ষায় যদি বাংলা চালু করতে হয় তাহলে অন্যান্য বিভাগগুলোতে কেন ইংরেজিতে চালু হচ্ছে না। শুধু আইন বিভাগের সঙ্গেই কেন এত ঠেলাঠেলি? -প্রথমত, আমি মনে করি, দেশের আইন শিক্ষায় কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি এবং বাংলা দুটোই চালু রাখার দরকার আছে। কেউ ইংরেজিতে আইন পড়েছে বলেই যে বাংলায় আইন লিখতে কিংবা বুঝতে পারব না- বিষয়টা এরকম কখনই না। এ দেশে আইনগুলো বাংলায় হচ্ছে না কিংবা কোর্টের কার্যক্রম বাংলায় হচ্ছে না সেটা কেবল আমাদের সদিচ্ছার অভাবে।

আইন শিক্ষায় শতভাগ ইংরেজিকরণ করলে তখন আইন বিভাগে উচ্চশিক্ষা বলতে কিছু থাকবে না, শুধু জরুরি আইনগুলোই শেখা হবে। রাশিয়া, চায়না, ফ্রান্স ও জার্মানদের জ্ঞানের জগতে যতটা তাদের নিজস্ব সৃষ্টি রয়েছে আমাদের ততটা নেই। কাজেই তাদের মতো হওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব না। আইনের একটা বিষয়ে এত এত সাহিত্য রয়েছে যে, আপনি সেগুলো অনুবাদ করবেন তো দূরের কথা, গণনা করেই শেষ করতে পারবেন না। কিন্তু সেই জ্ঞান অর্জন করা আমাদের দরকার। আইন শিক্ষা পুরোপুরি বাংলায় করতে গেলে তখন সেটা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

দ্বিতীয়ত, আইন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যতটা মিশে আসে অন্য বিভাগগুলো ততটা মিশে নেই। বিজ্ঞানের বিষয়গুলো বাংলায় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কাজী মোতাহের হোসেন এ বিষয়ে অনেক কাজও করেছিলেন।

আইনকে বাংলায় করার ক্ষেত্রে আমাদের যে বাধা তা যত সহজে আমরা অতিক্রম করতে পারব, অন্যান্য বিভাগগুলোতে সেই কাজ ততসহজে পারা যাবে না। গত একশ' বছরে যেহেতু এ উদ্যোগ নেয়া হয়নি, এখন তা তদনগদ করতে গেলে আমরা আগানোর চেয়ে পিছিয়ে যাব বেশি। হঠাৎ করে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল এবং বিজ্ঞানের বিষয়গুলো বাংলায় চালু করতে গেলে পতন অনিবার্য হয়ে পড়বে। দীর্ঘদিনে যেই সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তা দূর করতেও সময় লাগাটা স্বাভাবিক।

রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে বাংলা চালু না হওয়ার পেছনে সমস্যা কোনো জায়গায়? একক কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান এজন্য দায়ী সম্পূর্ণ দায়ী নয়। রাষ্ট্রের সব সফলতার কৃতিত্ব সরকার দাবি করে এজন্য আমরাও রাষ্ট্রের সব ব্যর্থতার দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। দুটোই একচেটিয়া সমস্যায় ভারাক্রান্ত। বাংলা একাডেমির অনেকটা দায় রয়েছে। বাংলা একাডেমি নিয়ে বললে অনেক কথাই বলার আছে। প্রমথ চৌধুরীর একটা কথা এখানে প্রাসঙ্গিক। তিনি তার প্রবন্ধ সংগ্রহ বইতে বলেছেন, যে জাতি মনে বড় নয়, সে জাতি জ্ঞানেও বড় নয়।

মনের দিক দিয়ে আমরা ছোট রয়ে গেছি। প্রচলিত প্রথার সংস্কারে আমাদের ভয় হয়। ইংরেজিকে বাদ দিয়ে বাংলার ওপরে নির্ভরশীল হওয়ার মতো আত্মবিশ্বাস আমরা তৈরি করতে পারিনি। এটাই মূল সমস্যা।

আশার দিক হলো- বর্তমানে অনেক আইন বাংলাভাষাতেই প্রণীত হচ্ছে। ডিএলআর খুঁজলে বেশ কিছু মামলার রায় বাংলাতে পাওয়া যায়। সহকারী জজ/জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট নিয়োগ পরীক্ষায় আইনের বিষয়গুলো বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষায় উত্তর লেখার সুযোগ থাকে। আমার জানা মতে সেই পরীক্ষায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই বাংলাভাষাতেই উত্তর করে। যদি বাংলায় সম্ভব না হয় তাহলে কীভাবে তারা বাংলায় প্রশ্নগুলোর উত্তর লেখেন? কিছু বিচারক কীভাবে বাংলায় রায় লেখেন?

ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর আমরা অতিক্রম করেছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও পালন করেছি। অথচ এখনও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে আমাদের যুক্তিতর্ক করতে হয়।

\হলেখক : শিক্ষানবীশ আইনজীবী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে