শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

লোকসংস্কৃতির উজ্জ্বল পুরোধা শামসুজ্জামান খান

সাইফুজ্জামান
  ২৩ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০
লোকসংস্কৃতির উজ্জ্বল পুরোধা শামসুজ্জামান খান

শামসুজ্জামান খান ফোকলোর বিদ, গবেষক ও প্রশাসক। তিনি শেকড়সন্ধানী গবেষক ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন অনুরাগী হিসেবে তার অন্তরগত চেতনা, রাষ্ট্র চিন্তা ও উন্নয়নমূলক ভাবনা ছিল তার গবেষণার প্রধান বিষয়। লোক সংস্কৃতির বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ, গ্রাম বাংলার সাহিত্য নিয়ে বিস্তর কাজ করেছেন। মীর মশাররফ হোসেনসহ অসংখ্য সাহিত্যিকদের নিয়ে তিনি কাজ করেছেন।

শামসুজ্জামান খানের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৯ ডিসেম্বর, মানিকগঞ্জ। অসংখ্য রচনার কৃতী স্রষ্টা। উইকিপিডিয়া থেকে জানা গেছে বাংলাদেশের লোকজ গ্রন্থমালা সিরিজে ৬৪ জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং ১৪৪ খন্ডে বাংলাদেশের গ্রন্থমালা সম্পাদনার বিশেষ কাজটি তিনি সম্পন্ন করেন। বাংলা একাডেমি, বাংলা শিল্পকলা একাডেমি ও জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক হিসেবে প্রশাসক হিসেবে তিনি সফল ছিলেন। শামসুজ্জামান খান জাতীয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি ও বাংলা একাডেমির সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করেন।

পারিবারিকভাবে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী চিন্তার অধিকারী। তার পিতা এমআর খান ছিলেন বিদ্বান। অনুবাদক হিসেবে খ্যাতিমান। দুই বছর বয়সে শামসুজ্জামান খান পিতৃহারা হন। মা ও দাদির তত্ত্বাবধানে তার শৈশব, কৈশোরের পাঠ ও মানস গড়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়ার সময় তিনি একঝাঁক শিক্ষক ও তরুণ বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় লেখালেখিতে আত্ম নিয়োগ করেন। তিনি ১৯৬৩ সালে অনার্স ও ১৯৬৪ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

শামসুজ্জামান খান ১৯৬৪ সালে হরগঙ্গা কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক ও পরে একই বছর জগন্নাথ কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও

প্রশাসনে তার একাধিক অভিজ্ঞতা ছিল। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যুক্ত হন।

বাংলা একাডেমির ফোকলো বিভাগের যাত্রাকালে তিনি যোগ দেন। পরে তার নিত্য-নতুন পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করেন। তিনি যখন বাংলা একাডেমির চাকরিতে যোগদান করেন তখন ছিলেন একঝাঁক তরুণ তুর্কী। রশীদ হায়দার, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, সেলিনা হোসেন। উত্তরাধিকার নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা ঘিরে তরুণদের আগ্রহ। প্রথম থেকে শামসুজ্জামান খান ছিলেন সিরিয়াস ধরনের গবেষক। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু রচিত 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' 'কারাগারের রোজনামচা' সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন সাংবাদিক বেবী মওদুদের সাথে। 'আমার দেখা নয়াচীন' গ্রন্থ সম্পাদনাও তার অবদান রয়েছে। শামসুজ্জামান খানের জ্ঞানভান্ডার ছিল সমৃদ্ধ। তাকে চলন্ত বিশ্বকোষ হিসেবে সবাই সমীহ করত। অসম্ভব স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। অচেনা শব্দ দিয়ে তিনি যে রচনা সৃষ্টি করতেন তা সহজে হৃদয়ে গেঁথে যেত। তার পরিচিত জগৎ ছিল বিস্তৃত। তরুণ থেকে শুরু করে প্রবীণ পর্যন্ত সবার খবর রাখতেন তিনি। তার সেলফোন থেকে কিংবা সরকারি ফোন থেকে তার কথামালা তরুণদের আলোড়িত করত।

আফ্রিকা ভ্রমণকালে একবার তিনি মৃদু হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে হৃদযন্ত্রের চিকিৎসার জন্য তার বাইপাস সার্জারি করা হয়।

শামসুজ্জামান খান ২০০৯ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। তিন দফা তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। শামসুজ্জামান খান অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮৭) কালুশাহ পুরস্কার (১৯৮৭), দীনেশচন্দ্র সেন ফোকলোর পুরস্কার (১৯৯৪), আবদুর রব চৌধুরী স্মৃতি গবেষণা পুরস্কার (১৯৯৮), দেওয়ান গোলাম মোর্তজা পুরস্কার (১৯৯৯) শহীদ সোহরাওয়ার্দী জাতীয়

গবেষণা পুরস্কার (২০০১) মীর মশাররফ হোসেন স্বর্ণপদক (২০০৪), তিনি বাংলা একাডেমি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। শামসুজ্জামান খান ২০১৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। আমি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি সেই প্রতিষ্ঠানে শামসুজ্জামান খান চার বছর মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পেয়েছি তার অপার স্নেহ ও ভালোবাসা। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী ব্যস্ত মানুষ। মন্ত্রী, আমলা, সাহিত্যিক, উঁচুস্তর, মধ্যস্তরের নানান মানুষের সঙ্গে তার ব্যবহার, আতিথেয়তা ছিল মুগ্ধ করার মতো। প্রশাসনিকভাবে থেকেও সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখে কীভাবে লিন থাকা যায় প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন শামসুজ্জামান খান।

কিছু সময় সাহিত্যিকদের সঙ্গে সময় কাটানো তার কাজের অংশ ছিল। স্নেহ করতেন। পরামর্শ দিতেন নতুন কিছু পড়ার।

শুধু পাঠ, গবেষণা, তত্ত্ব তালাশ কীভাবে একেকজন মানুষকে মানবিক ও সৃজনী করে তুলতে পারে তা মূর্ত প্রতীক ছিলেন শামসুজ্জামান খান। তিনি ছিলেন পরোপকারী। কিন্তু কখনো ভুলে যাননি যাদের জন্য কিছু করছেন তারা তাকে নতুন অভিজ্ঞতার সন্ধান দিতে পারেন। কিছু না পাওয়ার আশা নিয়ে অকাতরে কল্যাণ করে গেছেন তিনি। তার কোনো অনুতাপ ছিল না।

বাংলা একাডেমি ছিল তার ধ্যান, জ্ঞান ও আরাধনা। বাংলা একাডেমি সম্প্রসারণে তিনি নিরন্তর কাজ করেছেন। এর মধ্যে যেমন ছিল অবকাঠামো উন্নয়ন পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগ, গবেষণা স্তর বর্ধনে তার নিষ্ঠা, তদারকি ও মনোযোগ তাকে ইতিহাসে স্মরণীয় করে রাখবে। তার প্রিয়জনরা চাইতেন তিনি একটি নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠুন। তিনি বলতেন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করা বাকী। মৌলবাদীরা সক্রিয়। বাংলা নববর্ষ, বাংলা পঞ্জিকা, নববর্ষের ইতিহাস, বাঙালির আত্মপ্রকাশ ও পরিচয়ে শামসুজ্জামান খান নিরন্তর কাজ করেছেন। তার চলে যাওয়ার দিন ১ বৈশাখ ১৪২৮ (২০২১ সালের ১৪ এপ্রিল) একজন অভিভাবক প্রকৃত অর্থে নির্লোভ, নিরহংকারী ও পরোপকারী শামসুজ্জামান খান বেঁচে থাকবেন স্মরণে, স্মৃতিতে পাঠে। তার অসংখ্য লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো গ্রন্থাবদ্ধ করা জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে