শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

গুপ্ত প্রণয়িনী

সারোয়ার কবীর
  ৩০ জুলাই ২০২১, ০০:০০

কিছুদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলী আকবরের স্ত্রী আমার অফিসে ফোন করে তার বাসায় যেতে বলেছেন। সেই যে কুলখানির পর স্বামীবাগের ওই বাসা থেকে এসেছি- যাব যাব করেও আর যাওয়া হয়নি নানা ঝামেলায়। লিপি ভাবির ফোন পেয়ে ঠিক করলাম, অফিস ছুটির পর আজ যাব। আমি সচিবালয়ের চাকুরে। আমার অফিস থেকে স্বামীবাগ আর কতদূর! রিকশা নিয়েছিলাম জিপিও মোড় থেকে। কিন্তু গুলিস্তান মোড় পেরোতেই অনড় জ্যাম দেখে রিকশা ছেড়ে দেই।

এখন হেমন্তের শেষ দিক। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই ঠান্ডা টের পাওয়া যায়। ভাবলাম আর কে মিশন রোডের ডানপাশে এক গলির ভেতর আকবরদের বাড়ির দূরত্ব যেটুকু- তাতে হেঁটেই যাওয়া যায়। আবার কিছু দূর গিয়ে রাস্তা ফাঁকা পেলে রিকশা নিতে পারি। বঙ্গভবনের সামনে পার্কের মাঝখানে রাস্তা পেরিয়ে টয়েনবি সার্কুলার রোডে এসে দেখি, রাস্তা ফাঁকা নেই। অফিস ফেরত ভিড় এখন। বঙ্গভবনের উঁচু দেয়াল ঘেঁষা ফুটপাত মাড়িয়ে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব মোড় পর্যন্ত এসে রাস্তা পেরিয়ে রিকশা নেই। দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই আমার প্রয়াত বন্ধু আলী আকবরদের বাড়ির সামনে। ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাস্তার লাইট পোস্টের আলো জ্বলে ওঠেছে। আমি গেটের পাসে কলিং বেল টিপতেই লিপি নিজে এসে গেট খুলে দেন। মুখটা কেমন থমথমে। ভাবলাম, স্বামীর শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

আমাকে ড্রইং রুমে বসিয়ে লিপি ভেতরে গেল। দেয়ালে আলী আকবরের একটা এফোর সাইজের ছবি ফ্রেমে বাঁধানো। এমনভাবে ফটোটা তোলা হয়েছে, মনে হলো- আমাকে দেখে আকবর হাসছে। মনই খারাপ হয়ে গেল। আমরা সেই স্কুল জীবনের বন্ধু। কত স্মৃতি আছে ওকে জড়িয়ে। এত তাড়াতাড়ি বিদায় নেবে কখনো ধারণা করতে পারিনি।

লিপি ট্রেতে করে চা-বিস্কুট নিয়ে ফিরল। বাড়িতে শোকের ছায়া পুরোপুরি কাটেনি- এ অবস্থায় আপ্যায়ন অস্বস্তিকর মনে হওয়াতে বললাম- ভাবি, কেন এই ঝামেলা করতে গেলেন?

- কেন, আপনার বন্ধু না থাকতে পারে, আমরা তো এখনো আছি।

- ছেলেমেয়েরা কোথায়?

- দোতলায়। আমার ননদের ফ্ল্যাটে গেছে।

চা-বিস্কুট খেতে খেতেই বললাম- আপনি ফোন না করলেও আগামী শুক্রবার ঠিকই আসতাম।

- হঁ্যা তাই। একটা বিশেষ ব্যাপারে আপনাকে ডেকে আনলাম।

- বিশেষ ব্যাপার মানে?

আমার প্রশ্নের মুখে লিপির মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। পরক্ষণে বলল- আমি তো জানি, আপনি ওর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

- তাতে সন্দেহ আছে! সেই স্কুল লাইফ থেকে আমাদের বন্ধুত্ব।

- সেটা আমিও জানি। আপনার কথা ও খুব বলতো। তাইতো ডেকেছি।

- তাহলে বলে ফেলুন ভাবি, কী করতে হবে?

- আপনি তো ওর সবকিছু জানেন।

- সব কিছু না হলে অনেকটাই জানি।

- আচ্ছা, ওর সঙ্গে কারো- মানে কোনো মহিলার সম্পর্ক ছিল?

প্রশ্নটা শুনে আমি তাজ্জব। বলে কী! এমন কিছু ঘটলে তো আলী আকবর নিশ্চয় আমাকে বলতো। উঠতি বয়সে আমারই এক আত্মীয়ার প্রতি বেশ দুর্বল ছিল। একটা প্রেমপত্র লিখে আমার হাতে ধরিয়ে বলেছিল- এই চিঠিটা ঝর্ণাকে দিয়ে আয়। বন্ধুত্বের খাতিরে সেটা করতে গিয়ে পারিবারিক ফ্যাসাদ পোহাতে হয়েছিল। ঝর্ণা এখন স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় থাকে। ওই ঘটনার পর ওর সঙ্গে আকবরের কোনো সম্পর্ক আর গড়ে ওঠেনি। আমাদের বন্ধুত্বও থাকে অটুট। আমি বললাম- না তো, সে রকম কিছু হলে আমি তো জানতাম।

- একটু দাঁড়ান। বলেই লিপি ভেতরের রুমে চলে যায়। আমার কানে স্টিলের আলমারি খোলার শব্দ এলো। একটু পর লিপি ফিরে আসে। ওর হাতে মেরুন রঙের বুক সাইজের একটা ডায়েরি। মনে পড়ল, বছর কয়েক আগে ডায়েরিটা আমিই গিফট করেছিলাম।

- ভাই, আপনাকে বিশ্বাস করি দেখে ডায়েরিটা দিলাম। বাসায় গিয়ে দেখবেন। একটা রিকোয়েস্ট- কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না। ডায়েরি দেখে শুধু আমাকে জানাবেন- মহিলাটি কে?

আমি ডায়েরির কয়েক পাতা উল্টেপাল্টে দেখলাম। এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করলাম না, শুধু বললাম- ঠিক আছে ভাবি, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আগে আমি ডায়েরিটা পড়ি, তারপর দেখি কী করা যায়।

- হঁ্যা, ভাই সেটাই করুন।

২,

আমার স্ত্রীও সরকারি চাকুরে। তার পোস্টিং এখন চাঁদপুরে। ওখানে কোয়ার্টার আছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের লঞ্চ ধরে ঢাকায় চলে আসে। আবার রোববার সকালে চলে যায়। জরুরি কাজ থাকলে শনিবার বিকালের লঞ্চ ধরে। সদরঘাটের কাছেই লক্ষ্ণীবাজারে আমাদের বাসা। স্ত্রী না থাকায় রাতে খেয়ে দেয়ে শোবার ঘরেই আলী আকবরের ডায়েরি খুললাম। ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০ সালের পৃষ্ঠায় লেখা আছে :

"মাত্র দুই ফুটের ব্যবধান। কয়েক দিন ধরে ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য মনটা ছটফট করছে। কিন্তু সুযোগ আর হচ্ছে না। একে তো কাজের চাপ, তারপর ওর ব্যস্ততা দেখে দ্বিধা ঝেড়ে উঠতে পারি না। মাঝে মাঝে দৃষ্টি বিনিময়। ও কী আঁচ করতে পারে, আমার মনের ব্যাকুলতা।"

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১০ :

"ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলাম। মাত্র দুয়েকটি বাক্য। তাতেই যেন কেলস্নাফতে। শুধু চোখাচোখি নয়, সেই সঙ্গে মুচকি হাসি- যা কুপোকাত করার জন্য যথেষ্ট।"

৫ অক্টোবর, ২০১০ :

"গিফট না দিতে পারার ব্যর্থতা রাতের জ্যোৎস্নাকেও যে এতটা ম্স্নান করে দিতে পারে, কখনো ভাবিনি। ওর অনুপস্থিতি আমার মনে আশঙ্কা জাগাচ্ছে।"

৭ অক্টোবর, ২০১০ :

"তার আকস্মিক বিদায় আমার কাছে এতটাই গুরুতর যে, প্রায় নির্বাক হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।"

১০ অক্টোবর, ২০১০ :

"সে আমাকে মনে রেখেছে। ওর বান্ধবী স্থানীয় আমার এক কলিগের কাছ থেকে কথাটা জানতে পেরে খুব ভালো লাগে। এমন কি ঘরে ফেরার পর রাতের অনেকটা বিনিদ্র কেটেছে নানা ভাবনা আর কল্পনায়। মনে হচ্ছিল, উঠতি বয়সে যেন ফিরে গেছি।"

১২ অক্টোবর, ২০১০ :

"ভালো আছো, সুখে আছো- জানতে পেরে খুশিই হলাম। আমার কথা কী ভাবো?"

২৪ অক্টোবর, ২০১০ :

"তোমার অনুপস্থিতিতে গোটা কর্মস্থল জুড়ে কেমন হাহাকার। নিরানন্দময় পরিবেশ। ভালো লাগছে না। সুযোগ পেলে চলে যাব অন্য কোথাও।"

৩০ নভেম্বর, ২০১০ :

"কতদিন দেখা নেই। তবে তোমার বান্ধবীর মুখে শুনতে পাই, ভালো যাচ্ছে দিনকাল। উপরন্ত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছি ফেসবুকে তোমার হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখে। ভাবছি লাইক দেব। কিন্তু দ্বিধায় জড়িয়ে যাচ্ছি।"

১০ ডিসেম্বর, ২০১০ :

" ক্যান্টিনে বসলেই তোমার স্মৃতি প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে যেন ফাঁকা চেয়ারটায় স্থির হয়ে যায়। মনে হয় তুমি বসে আছ, আগের মতোই।"

৩১ ডিসেম্বর, ২০১০ :

"হঠাৎ দেখা হয়ে গেল, কথাও হলো। হলুদ বসনে আগাম বসন্তের আমেজ। তোমার মুখে ক্লান্তি মাখা ভাবটা নেই একেবারে। সতেজ ফর্সা মুখটাই বলে দেয়, সুখে আছো। দোয়া চাইল। শুধু দোয়া কেন, আরো কিছু চাইলেও দিতে রাজি।"

নাহ, ডায়েরির আর কোথাও কিছু লেখা নেই। বাদবাকি পৃষ্ঠা ফাঁকা। ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক। তবে আমার ধারণা, ওদের সম্পর্কটা ডায়রিতে উলিস্নখিত বাক্যগুলোতে সীমিত নয়। আরও বিস্তৃত। প্রয়াত বন্ধুর ওপর একটু অভিমানও হলো, ওর জীবনে এমন একটা কান্ড ঘটেছে, অথচ বন্ধু হয়েও আমাকে কিছুই জানায়নি। পরক্ষণে ভাবলাম, সবার জীবনেই এমন গোপনীয় কিছু থাকে- তা আরেকজনকে বলা অসম্ভব। আমার জীবনেও তো এমন অনেক কিছুই আছে- যা আলী আকবর জানত না।

৩,

বড় বিশ্বাস করে লিপি তার প্রয়াত স্বামীর ডায়েরি তুলে দিয়েছে আমার হাতে। জানতে চেয়েছে, মহিলাটি কে? আমাকেও প্রবল কৌতূহল পেয়ে বসেছে। জীবনে গোয়েন্দাগিরির সুযোগ পাইনি। এবার যেন পেয়ে গেলাম। তাই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে পা বাড়ালাম।

আলী আকবরের ব্যাংকের চাকরি বেশি দিনের নয়। পাঁচ-ছয় বছর হয়েছিল মাত্র। ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগে যোগদানের আগে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিল। ডায়েরির পাতায় যে সময়কার ঘটনা সে উলেস্নখ আছে, তখন একটি দৈনিকে কর্মরত ছিল। ওদের অফিস ছিল সেই তেজগাঁও শিল্প এলাকায়। যদিও পরে অন্য একটি দৈনিকে চলে যায়। সেখান থেকেই ব্যাংকে ঢোকে। তেজগাঁওয়ের ওই অফিসে আমি বেশ কয়েকবার গেছি। ওখানে কর্মরত কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আলী আকবরের মাধ্যমে। তাদের মধ্যে রায়হানের নামটাই জানা আছে। সরকারি চাকুরে হওয়ায় বিশেষ সুবাদে এই যে সপ্তাহে দুদিন ছুটি পাই। শুক্রবার আর শনিবার। শুক্রবারের জুমার নামাজ ছাড়াও অন্যান্য কাজ থাকে। তাই ঠিক করলাম শনিবারেই যাব। গিয়ে রায়হানের খোঁজ করব। এই তো গেল ফেব্রম্নয়ারি মাসেও বাংলা একাডেমির বইমেলায় রায়হানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আলী আকবর তখনো জীবিত। আমার কাছে ওর খোঁজ নিয়েছিল এবং মন্তব্য করেছিল, পেশা পাল্টে বেঁচে গেছে। সাংবাদিকতায় এখন আর সুনাম নেই, তার চেয়েও সমস্যা হলো চাকরির অনিশ্চয়তা। কিন্তু রায়হান এখন এই পত্রিকার আছে না আকবরের মতোই ঠিকানা বদল করেছে- কে জানে। তবে যাওয়ার আগে ফোন করে নিশ্চিত হবো। রায়হানকে পেলে ও নিশ্চয় এমন কোনো ক্লু দিতে হবে, যা থেকে আমার প্রয়াত বন্ধুর- কী বলব গুপ্ত প্রণয়িনী! তার একটা হদিস পেতে সক্ষম হবো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে