শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অদ্বৈত মলস্নবর্মণ ও তিতাস একটি নদীর নাম

আশরাফ উদ্‌দীন আহ্‌মদ
  ১০ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ব্রাত্যজীবন ও প্রান্তিক মানুষের উপাখ্যান অদ্বৈত মলস্নবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম' বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা- সেই সঙ্গে অনুধাবনের সুস্থ মেলবন্ধন আর নির্মল জীবনবোধের আখ্যান এই উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা কালজয়ী সাহিত্যিক সৃষ্টি করেছেন পুরনো আঙ্গিক ভেঙে নতুন কাঠামোর এই জীবনাখ্যান। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান অদ্বৈত মলস্নবর্মণ; যেহেতু ধীবর বা জেলে সম্প্রদায়ের মালে গোষ্ঠীর ভেতর থেকে এসেছেন; আর তাই, তিতাসপাড়ের সেই সমস্ত নিরন্ন দরিদ্র মানুষের প্রত্যাহিক জীবনের চাওয়া-পাওয়া ভাব-ভালোবাসার আকুলতা নিয়ে উপন্যাসটি সাজিয়েছেন। মাছধরার পেশার মানুষ অত্যন্ত সরল এবং সহজ, তাদের জীবনধারা মানুষের প্রতি মানুষের যে বিশ্বাস বা অন্তরঙ্গতা তা তাদের জীবনবৈশিষ্ঠ্যের একটা অংশ। অন্ত্যজ-ব্রাত্য বা দলিত শ্রেণি থেকে একটু একটু উঠে আসা সাহিত্যিক অদ্বৈত মলস্নবর্মণের রচনাসম্ভারের নদী আর নদীর প্রকৃতি এবং সে সঙ্গে নদীর ওপর নির্ভরশীল জলদাসদের আবহমানকাল ধরে চিরায়ত জীবনের টুকরো টুকরো ছবিগুলো সাহিত্যিকের কলমে উঠে এসে সাবলীলভাবে মায়াবী স্পর্শে।

বাংলাদেশ যেহেতু নদী প্রধান দেশ, সেখানে নদীর ওপর সাহিত্য সৃষ্টি হবে, এটাই প্রকৃত স্বাভাবিক। নদী এবং মানুষ এখানে কতটা সম্পৃক্ত তা পাঠক অনুভব করবে। বাংলাদেশের মানুষ আবহমানকাল ধরেই নদীর ওপর নির্ভরশীল, নদীই যেন প্রাণ এবং বেঁচে থাকার আশ্রয়। আর তাই নদী নিয়ে সাহিত্য হয়েছে, নদী এবং নদীপাড়ের মানুষগুলো সাহিত্যে একেকজন প্রধান চরিত্রে উঠে এসেছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হাঁসুলিবাঁকের উপকথা', 'কালিন্দী', বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ইছামতি', মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি', কমল কুমার মজুমদারের 'অন্তর্জলী যাত্রা', অমরেন্দ্রনাথ ঘোষের 'চরকাশেম', নারায়ণ গঙ্গোপ্যাধ্যায়ের 'মহানন্দা', আব্দুল জব্বারের 'ইলিশমারির চর', প্রমথনাথ বিশীর 'পদ্মা', অমিয়ভূষণ মজুমদারের 'গড়শ্রীখন্ড', কাজী আবদুল ওদুদের 'নদীবক্ষে', সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ'র 'কাঁদো নদী কাঁদো', মনোজ বসুর 'জলজঙ্গল', হুমায়ুন কবীরের 'নদী ও নারী', আবু ইসহাকের 'পদ্মার পলিদ্বীপ', দেবেশ রায়ের 'তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত' ও 'তিস্তাপূরাণ', আবু জাফর শামসুদ্দীনের 'পদ্মা মেঘনা যমুনা', সরোজকুমার রায়চৌধুরীর 'ময়ূরাক্ষী', সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের 'তৃণভূমি', সমরেশ বসুর 'গঙ্গা', শহীদুলস্নাহ কায়সারের 'সারেং বউ', প্রফুলস্ন রায়ের 'কেয়াপাতার নৌকা' প্রভৃতি উপন্যাসে এ সমস্ত অঞ্চলের মানুষের দৃশ্যমান ছবিটা এসেছে সত্য; কিন্তু 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে মানুষ-প্রকৃতি-নদী এবং নদীপাড়ের মানুষের এসেছে একেবারে ভিন্ন ধারায়। শুধু দেখা বা শোনা অথবা বাকি কিছু অভিজ্ঞতার ফসল নয়, বলা অপেক্ষা রাখে না পুরোটাই জীবনযুদ্ধের সচিত্র ছবি। যার ভেতর দিয়ে অদ্বৈত মলস্নবর্মণকে প্রত্যক্ষভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। ধীবর সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে উঠে আসা একজন মানুষ যেভাবে তার জীবনের ইতিহাস বলতে পারে তা হয়তো পৃথিবীর আর কেউই জানে না। ঠিক তেমনি বাংলার ধীবর প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের গল্প-স্বপ্ন-ভালোবাসা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তিতাসের শরীরের বাঁকে বাঁকে। এখানে তিতাস শুধু একটি নদী নয়। একটা জলজ্যান্ত কিংবদন্তি একটা বৃহৎ মহাজগৎ। যে মহাজগতের নাগপাশ মানুষ পায় না, কিন্তু তিতাসকে পায়। সে কারণে দুঃখ ছাড়ে না, কষ্ট শুধু দগ্ধ করে প্রতিনিয়ত। তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তিতাসের বুক জুড়ে যে তরঙ্গমালা বা স্বপ্নরাজি প্রবাহিত হচ্ছে নিরন্তর, যে ব্রাত্যজীবন তিতাসকে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে, করেছে আরো বেগবান, দিয়েছে ঘর সামলানোর মূলমন্ত্র।

মাছমারাদের জীবনের স্বপ্নগুলো খুবই ক্ষণস্থায়ী, সে কারণে স্বয়ং অদ্বৈত মলস্নবর্মণ বলেছেন, 'তাদের জীবনের বাঁকে বাঁকে অপার রহস্য। তারপরও তারা মনে করে মৃতু্য তা তো অনিবার্য, চিরসজীব একটি মৃতু্যই যেন তাদের ভবিতব্যে লিপিবদ্ধ'। বাইরের জীবনে তারা মূলত সৎ, সততার সঙ্গে জীবনের অংক মিলায়। এই মাছধরার জলের মধ্যে ঝিনুকের মতো জীবনের যে অন্ধকার দিশাকে খুঁজে যায়, তার নাম কি বলব, আমরা প্রকৃতপক্ষে মাটি ও মানুষের গল্প লিখি বা পড়তে ভালোবাসি, কিন্তু মাছধরার জীবনের বাকি অংশ জীবনের উত্তাপে সিদ্ধ হয়। আঘাতে-আঘাতে শেখে বেঁচে থাকার করুণগাথা ইতিহাস। মাটি বা চেনাজানা প্রকৃতি থেকে ওরা দীর্ঘকাল দূরে এবং জলেই জীবনের একটা অর্থ খুঁজে ফেরে বলেই ওদের জীবন বড় গোলমেলে, কোথাও তা মিলতে পারে না। নদী-সাগরের স্রোতরাশির মতো উজানে ভেসে যায়, ভাসতে-ভাসতে হয়ত কখনো মনের মানুষের দেখা মেলে কিংবা সবই মরিচিকা। এভাবেই তাদের জীবনে স্বপ্ন কদাচিৎ ধরা দেয় অথবা পেছনে চলে যায়। তারপরও তারা মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায় এবং বাঁচে। এভাবেই তারা বংশ পরম্পরা মেছো মানুষ হয়ে জীবন অতিবাহিত করে। সেখানে হয়তো কাব্য করার কোনো সুযোগ নেই- কারণ জীবনই তাদের ওমন খাপছাড়া গোলমেলে। কোনো হিসাবই শেষ অবধি মেলে না। তবে মেলাতে তারা চায় কিন্তু পরিশেষে একটা মূল্য অন্ধকার গহবরে উপস্থিত হয়। গঙ্গা এবং মানুষ একে অপরের অতি কাছের স্বজন। গঙ্গার ওপর নির্ভর করে মানুষের বর্তমান জীবন। গঙ্গায় মানুষকে সভ্যতার শিখরে অধিষ্ঠিত করেছে, সেই গঙ্গা তারপর পদ্মা আমাদের জীবনসাহিত্যে ওতপ্রোতভাবে নিবিড় হয়ে জড়িয়ে আছে।

তিতাসের বাঁকে বাঁকে কত সুধা যেমন উঠে এসেছে শিল্পীর কলমে, তেমনি নদীপাড়ের মানুষের জীবনযাপন এবং বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিয়ে তারাশঙ্করের হাঁসুলি বাঁকের উপকথায় পাঠক নতুন একটা সম্প্রদায়ের সন্ধান পেয়ে যায়। কাহাররা সম্প্রদায়ের এই বিকাশ এবং নদী তীরবর্তী মানুষের জীবনযাপনই দেখানো হয়েছে এই উপন্যাসটিতে। তিতাসের সঙ্গে কোথাও কোথাও মিল হলেও কোথায় একটা অমিলের সুর বেজে ওঠে। তা হলো অদ্বৈত মলস্নবর্মণ একজন প্রত্যক্ষদর্শী শিল্পী-জীবনশিল্পী। তার কলম সত্যের কথা বলেছে, সত্যকেই উদঘাটন করেছে জীবনভর। আর সে কারণে তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি অন্য আর দশটি কাহিনী থেকে ভিন্নতা প্রকাশ পায়। স্বাতন্ত্র্যতা উপন্যাসটিকে করেছে উজ্জ্বল নক্ষত্র। নদীপাড়ের মাছধরাদের জীবনের কষ্ট ও জীবনের অলিগলির গল্পটিকে একান্ত নিজের মতো করে উপন্যাসের আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন জীবনশিল্পী অদ্বৈত মলস্নবর্মণ। কঠিন বাস্তবতাকে সাজিয়ে তুলেছেন, সেখানের ভাষার কোনো অহেতুক কচকচানি বা ঘনঘটা বর্ণনা করেননি এবং সেখানেই তার মোক্ষম স্বাতন্ত্র্যতা বজায় থেকেছে। ধীবর বা মাছধরাদের গল্পে কাব্যিকতা দিয়ে নয়, যুক্তি দিয়ে কষ্ট-যন্ত্রণার দৃশ্যপট দিয়ে নির্মিত করেছেন উপন্যাসটি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে