বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্প-সাহিত্যে বঙ্গবন্ধু

মোশারফ হোসেন
  ১৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শিল্প-সাহিত্যে বঙ্গবন্ধু

হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের একজন অনন্য মহানায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীনতার সিংহপুরুষ। নশ্বর এই পৃথিবীতে স্বীয় কর্মে অবিনশ্বর বিশ্বাসে অটল, দৃঢ়-প্রত্যয়ী, অনুকরণীয় আদর্শ, মুক্তির দিশারী, সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, জাতিকে এক সুতোয় গাঁথার সুনিপুণ কারিগর, বাংলার জনপ্রিয় সংগ্রামী নেতা। শত বছরের আলোক বিভায় উজ্জ্বল নক্ষত্র যিনি পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার সোনালী সূর্য উপহারস্বরূপ দিয়েছেন বাংলা নামক স্বর্গ। সংগ্রামী চেতনার স্ফুলিঙ্গ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান নেতা সৃষ্টিশীল রূপবাদী জাতির কান্ডারি, জাতি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা দিশাহারা জনতার বিশ্রামের সুশীতল আশ্রয়স্থল, ইতিহাসের অনিবার্যতায় উজ্জ্বল-অনন্য এক মানবিক মূল্যবোধের বটবৃক্ষ। যার সৌরভে-গৌরবে-মুগ্ধতায় আনন্দে বাঁচার সঠিক নির্দেশনায় মাথা উঁচু করে বাঁচবার আস্থা-বিশ্বাসে জাতির মানচিত্রে অভু্যদয় ঘটল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাঁথা দু'টি নাম। যার যোগ্য নেতৃত্বে, মাধুর্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল নিরন্তর সম্মুখে পথ চলার উচ্ছ্বাসের মিলিত ঝংকার মানবমুক্তির উজ্জ্বল অধ্যায়ের নাম শেখ মুজিব। ব্যক্তি মুজিব ত্যাগের মহিমায় বলীয়ান, অকৃত্রিম কীর্তিগাঁথার অনন্য উদাহরণ। আদর্শিক ব্যাপ্তির সীমা-পরিসীমা নেই। তার মনন দক্ষতার শৈল্পিক নির্মিতিতে জীবন জিজ্ঞাসায় চিরন্তন আলোক শিখায় বর্ণিল বিচ্ছুরণ ধারায় উদ্ভাসিত হওয়ার পেছনে বইয়ের বিরাট অবদান রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছোট সময় থেকে খেলাধুলা গান, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং বিশ্বসম্পর্কে ধ্যান-ধারণা বইপত্র-পত্রিকাসহ বিচিত্র পাঠ্যাভ্যাস, বিভিন্ন ফুল-ফলাদির গাছ-গাছালি লাগানো, কবুতর পালন তথা প্রকৃতির প্রতি সদয় হওয়ার ব্যাপারে তাগিদ দিতেন। সৃজনশীল কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। পারিবারিক পরিমন্ডলেই তিনি পরিশীলিত শিল্পচেতনাবোধের বাস্তবতার নান্দনিক রূপায়ন, ভাষা সাহিত্য চারু-কারু-সুর-সংগীত, নন্দনতত্ত্ব, নৃত্যকলা, শিল্পকলা-কৌশলের আয়ত্তকরণ, গভীর উপলব্ধি অভিজ্ঞতা, মননশীলতা-প্রখরতার স্বাক্ষর রেখেছেন নানা সময়ে নানাভাবে। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, 'আমি খেলাধুলা করতাম, ফুটবল, ভলি ও হকি। আমার একটা দল ছিল। কেউ কিছু বললে গান গাইতাম।' কাজী আব্দুল হামিদ (এমএসসি) বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক ছিলেন। তিনি খাঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন। শেখ মুজিবকে ঐ শিক্ষক দেশপ্রেমের মূল শিক্ষা-দীশক্ষায় উদ্দীপ্ত করে তোলেন। কবিতা-গদ্য ও ইতিহাস এমনকি নজরুল-রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়াতেন পারিবারিক পরিবেষ্টনে। বঙ্গবন্ধুর পিতা দক্ষ মেধাবী শিক্ষক রেখে ছেলেকে ভালোভাবে পড়াশুনা করার উপযুক্ত পরিবেশ দিয়েছিলেন মেধা বিকাশের জন্য। নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে প্রধান শিক্ষক রসরঞ্জন সেনগুপ্তের বাড়িতে যেয়ে পড়ার ব্যাপারে পিতার নির্দেশ ছিল বিশেষ করে ইংরেজি-অংক বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে। বাবা সদাই চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন দক্ষ-সুদূরপ্রসারী, প্রগতিশীল, বিশ্বজনীন চিন্তার মানুষ হিসেবে ছেলের বিবেক জাগ্রত হোক। জ্ঞান পিপাসুবোদ্ধা, মনোজগতের দীপ্তমান আলোর বিচ্ছুরণ, সৃজনী কল্পনার প্রাণরসের প্রতিফলন ঘটানো যায় কীভাবে। সচেনতার মনোলোকে কীভাবে নির্মিত হবে বুদ্ধিদীপ্ততা-স্মৃতিশক্তির প্রখরতা-প্রাজ্ঞতা, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের স্বচ্ছজ্ঞান। সেই চিন্তা থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতিবিষয়ক সাময়িকী বই, বিভিন্ন ধরনের পত্রপত্রিকা, আনন্দ বাজার, বসুমতী, আজাদ, মোহাম্মাদী ও সওগাত পত্রিকা বঙ্গবন্ধুর পড়ার সুযোগ হয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর নিষ্ঠাবান ও সতর্ক পাঠক হয়ে ওঠেন। সময়ের ব্যবধানে স্বমহিমায় স্থিতু হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। শিক্ষাজীবনের বাইরে বিচিত্র বইয়ের সঙ্গে সখ্যতা ছিল অপরিমেয়। পুরোটা জীবন বইবান্ধব ও বইপ্রেমী, শৈল্পিক সচেতনতা, অনুসন্ধানী লেখনির তেজদীপ্ততা, লেখনির দক্ষতা-পরিপক্কতা, কাব্যময়তার নদীর স্রোতধারার মতো নৈপুণ্যের বিচিত্রতার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথপরিক্রমা পাড়ি দিয়েছেন পরম ধৈর্য সহনশীলতার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপদিমস্তক সৃষ্টিশীল সাহিত্যানুরাগী-সাহিত্যানুসারী। সেটির প্রমাণ মেলে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন লেখক, গবেষক, সাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাস-কবিতা, রাজনীতির বিজয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিভিন্ন বিচিত্র বইয়ের সংগ্রহ সমাহারে। বঙ্গবন্ধু নজরুল-রবীন্দ্রনাথ, ডি.এল রায়, শরৎ, শেলী রাসেলের কবিতা, উপন্যাস, গান, মুগ্ধতায় বিস্ময় হয়ে পড়তেন। শিল্প সাহিত্যের অবিমিশ্রিত আনন্দ অনুভব করতেন এবং বিভিন্ন সময় ভাষণ-বক্তৃতা-আলোচনা-বিবৃতি-বিস্তারে, সাক্ষাৎকারে তটজলদি কবিতা-গদ্য-সংলাপ, উদ্ধৃতি দিতে পারতেন। এতে তার সৃজনী কল্পনার প্রাণরসের আত্মপ্রকাশের বুদ্ধিদীপ্ততার বিকাশ দেখতে পাই। নজরুল-রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে তিনি শক্তি-সাহস মনোবল পেতেন। আব্বাসউদ্দিন, আব্দুল আলীমের বৈচিত্র্যপূর্ণ সুরের মূর্ছনায়-শৈল্পিক উপস্থাপনায় বিমোহিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবিনাশী দেশপ্রেমের বন্দনাসংগীত 'আমার সোনার বাংলা' গানটিকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জাতীয় সংগীত করার কথা ভেবে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সিরাজ-উদ-দৌলা নাটকের সংলাপ, শরীয়তুলস্নাহ, তিতুমীর, সূর্যসেনের প্রসঙ্গ টেনে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধৃতি দিতে পারতেন। শিল্পসাহিত্যে অনুরক্ত, পান্ডিত্য, মমত্ববোধ সবই ছিল তার মধ্যে। তার পাঠ পরিক্রমা ও অধ্যয়ন পরিধির সীমা দীর্ঘ-বৈচিত্র্যময়-বিস্ময়কর। রাজনৈতিক জীবন, জেল-জুলুম জীবন, পলাতক জীবন এমনকি সফর জীবনেও বন্ধু সঙ্গী-সাথী ছিল বই। তার পারিবারিক পাঠাগারের কথা বিদেশি সাংবাদিকরাও জ্ঞাত ছিলেন। তিনি যখন রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতেন ব্যাগের মধ্যে বই থাকত। শোবার বিছানাতেও বই থাকত। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' থেকে জানা যায়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়ও মৃতু্যর প্রহর গোনার অবস্থায়ও সংবাদপত্র ও বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতেন। রাজনীতির কবি, বাঙালির জাতিসত্তার প্রাণপুরুষ, দরদর্শী, চিরবন্ধু, সত্যের আলোকবর্তিকার প্রোজ্জ্বল শিখা শেখ মুজিব। তিনি শওকত ওসমানের জাহান্নাম হতে বিদায় এবং ড. নীলিমা ইব্রাহিমের অসংখ্য বই পড়েছেন। এডগার স্নো রচিত বই 'রেড চায়না', ফরাসি লেখক এমিল জোলা রচিত ' তেরোস রেকুইন' উপন্যাসটি বঙ্গবন্ধু জেলখানায় পড়েছেন। ১৯৪০-এর দশকের শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধু লীগ অফিসে রাত কাটানোর সময় সারা রাত বই পড়তেন। বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীতে লিখেছেন, 'আমার কাছে ভারতবর্ষের একটা ম্যাপ থাকত। আর হাবিবুলস্নাহ বাহার সাহেবের 'পাকিস্তান' নামক এবং মুজিবুর রহমান খাঁ সাহেবেরও 'পাকিস্তান' নামে একটি বিস্তৃত বই লিখেছিলেন এই দু'টি বই আমার প্রায় মুখস্থের মতো ছিল' (পৃ. ২২-২৩)। উপমহাদেশের রাজনীতি বহু তথ্য-উপাত্ত 'মিশন উইথ মাউন্ট ব্যাটেন' নামক গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে অবগত হয়েছেন। আত্মজীবনীতে উলেস্নখ করেছেন ১৯৫০ সালে নিরাপত্তা বন্দি অবস্থায় তিনি নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াত করতেন এবং কোরআন শরীফের বাংলা ইংরেজি অনুবাদ পড়তেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী (১৬৯-১৮০ পৃ.) বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর পড়া বই এবং পারিবারিক লাইব্রেরিতে স্থান পাওয়া রক্ষিত বই সম্পর্কে। তিনি লিখেছেন, '১৯৪৯ সাল থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছে, কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল, যা সবসময় আব্বার কাছে থাকত। জেলখানার বই বেশির ভাগই জেলের লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন, কিন্তু আমার মায়ের অনুরোধে রবীন্দ্র, শরৎ, নজরুল রচনাবলি জর্জ বার্নাডশ', রাসেল, পিবি শেলী ও জন কীটসহ কয়েকখানা বই আব্বা কখনো দিতেন না।' বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানা স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, 'বাসায় মাঝে মধ্যে আব্বা একটা গান গাইতেন। তিনি আরম্ভ করলে আমরাও ধরতাম।' 'দুনিয়ার মজদুর ভাইসব আয় এক মিছিলে দাঁড়া, নয়া জামানার ডাক এসেছে একসাথে দে সাড়া।' ১৯৫২ সালে চীন সফর কালে ও বঙ্গবন্ধু পিকিংয়ের রাস্তায় এবং পাবলিক লাইব্রেরিতে বই খুঁজছেন। পাঠক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি আলোকচিত্র পাওয়া যায়। একটিতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুকে তার ব্যক্তিগত পাঠাগারে। অন্য আলোকচিত্রে দেখা যায়, তাকে আল-বেরুনীর 'ভারত তত্ত্ব' বইটি নিবিষ্ট মনে পড়াকালীন অবস্থায়। তৃতীয় আলোকচিত্রে দেখা যায়, স্যান্ডো গেঞ্জি পড়া অবস্থায় একটি বই পড়তে। বঙ্গবন্ধু জেলখানায় বন্দি অবস্থায় লিখিত চিঠি এবং 'কারাগারের রোজনামচায়' লিখিত একটি মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৯৫১ সালে ১২ সেপ্টেম্বর তারিখে 'ইত্তেফাক' সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কাছে লেখেন, 'আমি জেলখানায় ভর্তি হয়েছি। চিকিৎসার চেষ্টা খুব হইতেছে...। আমার জন্য কিছুই পাঠাবেন না। আমার কোনো কিছুর দরকার নেই। নতুন চীনের বইপত্রিকা যদি পাওয়া যায় তবে আমাকে পাঠাবেন।' \হআপনার ছোট ভাই \হমুজিব বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের অক্টোবরের জেল থেকে মাও সেতুঙের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে চীন সফর করেন। এই সময়ের ওপর ভিত্তি করে রচনায় করেন গুরুত্বপূর্ণ বই 'আমার দেখা নয়া চীন।' 'কারাগারের রোজনামচা' লিখেছেন, 'আজ আর খবরের কাগজ আসবে না। মিলাদুন্নবীর জন্য বন্ধ। দিন কাটানো খুব কষ্টকর হবে। আমি তো একাকি আছি। বই আর কাগজই আমার বন্ধু।' এখান থেকেই খুব স্পষ্ট, খুব সহজেই অনুমেয় যে তার চেতনায় বই এবং পত্র-পত্রিকায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু রচিত বইয়ের বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গি, ঘটনার উপস্থাপনায়, ঐতিহাসিকতায়, শৈল্পিক মননে, গভীর পর্যবেক্ষণে সত্য তথ্যের পরিস্ফুটন। এটি নির্বাচিত বিশ্ব মানের অমূল্য সম্পদ। তাকে দিয়েছে মহৎ-মেধাবী লেখকের অভিধা, অম্স্নান সূর্যের বিচ্ছুরিত নান্দনিক রশ্মি। এটি বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সাহিত্যের ইতিহাসের অমরকীর্তি, সোনালী স্বাক্ষর। আর এতে প্রেরণা, পরামর্শ পুরো সাহস জুগিয়েছেন মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা। তিনি সত্যি কালজয়ী বঙ্গবন্ধুর নিরন্তর প্রেরণার তীর্থ ভূমি। বঙ্গবন্ধু আবুল ফজলকে চিঠি লেখেন, ১৭-১১-৬৯ইং ফোন : ২৪২৫৬১৩৭৭ \হধানমন্ডি \হআবাসিক এলাকা \হরোড নং- ৩, ঢাকা।

জনাব অধ্যাপক সাহেব,

‘সম্প্রতি ইত্তেফাকে প্রকাশিত আপনার প্রবন্ধ ‘শক্ত কেন্দ্র কেন ও কার জন্য’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। আপনার সাবলীল লেখনির নিঃসৃত সৃজনশীল এই প্রবন্ধটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে অধিক সংখ্যক মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারলে নির্যাতিত মানুষের পরম কল্যাণে সাধিত হবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস। প্রবন্ধটি আমি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করতে মনস্থির করেছি। আপনার অনুমতি পেলে কৃতার্থ হব।’

ইতি

আপনার ¯েœহের

শেখ মুজিব

জনাব অধ্যাপক,

আপনার মত জ্ঞানী-গুণী এবং দেশপ্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে পারলে খুবই আনন্দিত হতাম। আবার যখন চট্টগ্রামে যাব, সাহিত্যনিকেতনে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে দেখা করব। আপনার লেখা রাজধানী বের হলেই ‘শক্ত কেন্দ্রের সঙ্গে’ এক করে পুস্তিকাকারে বের করার চেষ্টা করব।

বঙ্গবন্ধু রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২) ‘কারাগারের রোজনামচা’ (২০১৭) ‘আমার দেখা নয়া চীন’ (২০২০)। তার চিঠিপত্র, ডায়েরি, বক্তৃতা, ভাষণ, লেখক, গবেষক, অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী এবং নিকটাত্মীয়দের সূত্রে তার বইপড়া ও বইপ্রীতি বই সংক্রান্ত বিষয়ে জানা যায়। ছাত্রজীবনে, রাজনৈতিক জীবনে, রাষ্ট্রনায়ক থাকাকালীন সময়ে তিনি অসংখ্য বইপুস্তক পত্র-পত্রিকা পড়েছেন। ব্যক্তিগত পারিবারিক দলীয় পর্যায়ে পাঠাগার স্থাপন করেছেন। এক কথায়, বই ছিল তার পরম আত্মার আত্মীয়। তার রচিত বইয়ের বিষয়বস্তু তার লেখনির প্রকাশভঙ্গিমায়, ঘটনার উপস্থাপনায় সত্য ও সমৃদ্ধ তথ্যের ঐতিহাসিকতায়, শৈল্পিক-মননে গভীর পর্যবেক্ষণে কল্যাণ ভাবনার বিষয়টি ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ তথা বিশ্বমানের নির্বাচিত অমূল্য সম্পদ বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছে মহালেখকের স্বীকৃতি। আগামী প্রজন্মের পাঠকরা পাবেন অ¤øান সূর্যের বিচ্ছুরিত নান্দনিকতার উজ্জ্বল রশ্মিতে আলোকিত হবে এবং সোনার মানুষ হিসেবে সোনার বাংলায় তথা সমগ্র বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তার এই তিনটি বই জেলবন্দি অবস্থায় ১৯৫৪ এবং ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে রচিত। তাকে লিখতে উৎসাহ জুগিয়েছে নিরন্তর প্রেরণা দিয়েছেন তারই সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা।

১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি পূর্বপাকিস্তান সংগীত শিল্পী সমাজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের গণমুখী সংস্কৃতিকে বিকাশিত করার উদ্দেশ্যে সাহিত্যসংগীত, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পীদের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখকে প্রতিফলিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুপ্তশক্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাক্সক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি। আপনারা ভালোবাসা ও শান্তির অনেক গান গেয়েছেন। আজ বস্তির নিঃস্ব-সর্বহারা মানুষের জন্য গান রচনার দিন এসেছে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতো বিপ্লবী গান গাইতে হবে। মানুষের মনে প্রেরণা জোগাতে হবে। যদি এতে বাধা আসে সেই বাধা মুক্তির জন্য ৭ কোটি বাঙালি এগিয়ে আসবে। সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে যে দুর্নীতির শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে লেখনির মাধ্যমে তার মুখোশ খুলে দিতে হবে।’ তার অভিমত ছিল জনগণই সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত কর্ম সৃষ্টি করতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার ভাষণ সচেতন শিল্পী-সাহিত্যিকদেরকে উদ্বেলিত করেছিল।

সাংবাদিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মধুর। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকতায় ‘এস্টেট ভ‚মিকা’ সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন। তার জীবন থেকে জানা যায় যে, দেশপ্রেমিক, প্রতিভাবান, সাহসী ও কর্মঠ প্রগতিশীল সাংবাদিকদের সঙ্গে সু-সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। তরুণ সাংবাদিকদের তিনি খুব পছন্দ করতেন। ‘ইত্তেফাকের’ প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক ছিল প্রধান রাজনৈতিক উপদেষ্টা। এবি এম মূসা, এম আর আখতার মুকুল ও ফয়েজ আহমেদ প্রমুখ সাংবাদিকদের সঙ্গে সখ্যতা ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ঘনিষ্ঠজনদের বিচিত্র সব নামে ডাকতেন। সাংবাদিক মূসাকে বঙ্গবন্ধু নাম দিয়েছিলেন বিপদ, ফয়েজ আহ্মদকে ডাকতেন আপদ এবং আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীকে ডাকতেন মুসিবত! আলজেরিয়া যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিল গাফ্ফার চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী কাছে ফরেন অফিস থেকে চিঠি এলো লুঙ্গি ও মেছওয়াক নিতে পারবেন না, তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন। আলাপের ফাঁকে সুযোগ মতো বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আমার যাওয়ায় একটা অসুবিধা আছে। তখন বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন কি অসুবিধা? ‘আপনার ফরেন অফিসার নির্দেশনা দিয়েছেন লুঙ্গি নেওয়া যাবে না, কিন্তু লুঙ্গি ছাড়া আমি তো ঘুমাতে পারি না। কি করি?’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আরে, নিবি নিবি! আমিও তো লুঙ্গি নিমু’! গাফ্ফার চৌধুরী আলজেরিয়ায় গিয়ে দেখলেন, সত্যি সত্যি হোটেলে লুঙ্গি পড়েছেন বঙ্গবন্ধু!

যে ভাষণগুলো পুরো দুনিয়া পরিবর্তন করেছে তার মধ্যে একটি হলো ৭ই মার্চের ভাষণ। এটি শুধুমাত্র একটি ভাষণ নয়। এটি একটি আবৃতিযোগ্য শ্রেষ্ঠ কবিতাÑ যা শিহরণ জাগায়। বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে এত সাহিত্য কোথাও রচিত হয়নি। এটি রাজনৈতিক মহাকাব্যিক ভাষণ। এই ভাষণের প্রতিটি বাক্য, শব্দ পারশীলিত, বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় শব্দ চয়ন, লোকজ, লোকায়ত শব্দের ব্যবহার, উচ্চারণশৈলী, কণ্ঠের ওঠা-নামা, আঞ্চলিক ভাষাগত সারল্য, বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুনিপুণ ভঙ্গিমায় জাত অভিনেতার মতো, তর্জনীর পরাক্রম অসামান্য ভাষিক স্বাতন্ত্র্যের কীর্তিগাঁথা আজ অমর-অক্ষয়-অমলিন। ইতিহাসের সোনালী অক্ষরে অনন্য উজ্জ্বল। অনন্য বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। তাই তো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর সাড়ে ১৮ মিনিটের ভাষণটি আন্তর্জাতিক পরামর্শক কমিটি ১৩০টি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দলিল-নথি ও বক্তৃতার মধ্যে ৭৮টি বিষয়কে নির্বাচিত করে। এর মধ্যে ৭ই মার্চের ভাষণের অবস্থান ৪৮তম। বিশ্বের সেরা ভাষণের মধ্যে ৭ই মার্চের ভাষণের অবস্থান ৪১ তম।

নেলসন মেন্ডেলা বলেছেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণ ছিল স্বাধীনতার মূল দলিল। গ্রামবাংলার কম শিক্ষিত বা নিরক্ষর জনগণের মনের ও মুখের ভাষা। শুধুমাত্র শহরের মানুষের জন্য উচ্চারণ করেননি।’

শিল্প-সাহিত্যের এবং সাহিত্যিকদের প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা ভালোবাসা। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের লেখক হওয়া সত্তে¡ও কবি ফররুখকে ব্যাগ ভর্তি টাকা পাঠিয়েছেন লেখক মাহবুব তালুকদারের মাধ্যমে।

যুদ্ধোত্তর দেশে শিল্পী কমল দাশগুপ্তকে রেডিওতে, পল্লীকবি জসিমউদ্দীনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। মহাদেব সাহা, হুমায়ূন কবির, আবুল হাসান এদের সুচিকিৎসার জন্য বার্লিন, মস্কো, লন্ডন পাঠান। দাউদ হায়দারকে নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। তাই দাউদ হায়দার বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘তুমি আছো বলে অমোঘ পুরস্কার নিয়ে বেঁচে আছে কবি ও কবিতার দাউদ হায়দার।’

নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দ্র মজুমদার ‘জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে ইত্তেফাকে স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে, ‘১৯৭৪ সালে বন্যার সময় থিয়েটার থেকে ‘এখন দুঃসময়’ অভিনয় করে ২/৩ হাজার টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দিতে গেলে খুশি হয়ে আমাদের অফিস লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করেন।’

১৯৭৪ সালে জেলখানা থেকে মুক্তি দিয়ে ম্যাট্রিক পাস কবি আল মাহমুদকে শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক পদে নিয়োজিত করেন। কাজী নজরুলকে জতীয় কবি স্বীকৃতি এবং স্থায়ীভাবে থাকার সুব্যবস্থা করেন। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় ফতেহ লোহানী ‘আছিয়া’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রæয়ারি বাংলা একাডেমিতে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বহু দেশি-বিদেশি কবি-সাহিত্যিক আসেন ওই সম্মেলনে। তিনি সম্মেলন উদ্বোধনকালে বলেছিলেন, ‘আমরা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিক থেকে দরিদ্র নই। আমাদের ভাষার দু’হাজার বছরের একটি গৌরব ইতিহাস আছে। আমাদের সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিজ বৈশিষ্ট্যে ভাস্কর।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন রামপুরা নতুন ভবন পরিদর্শনের সময়ে তরুণ প্রযোজক আব্দুল আল মামুনকে নাটক কেমন চলছে জিজ্ঞেস করতেÑ সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তারই সদ্দিচ্ছায় সমস্যা নিরসনে নাটক থেকে প্রমোদকর ওঠে যায়। এটি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধু আপদমস্তক সাহিত্য-শিল্পমনা ছিলেন।

স্বাধীনতা চিরায়ত অর্থ ‘চিরঞ্জীব মুজিব’ শিল্প-শিক্ষা-সাহিত্য, কবিতা-উপন্যাসে, ভাষণে অর্থাৎ সংস্কৃতির ব্যাপ্তিতে মুজিব মিশে আছে প্রাণে-প্রাণে-গানে-গানে-¯েøাগানে বাঙালির হৃদমন্দিরে। মুজিব মেধা-মননে শৌর্যে-বির্যে অনুপম এবং চিরন্তন। তাই তো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাÐের খবরটি যখন বেতারে ঘোষণা করা হয়, তখন বিশিষ্ট লেখক আবু জাফর শামসুদ্দিন তার ডায়রিতে লিখেছিলেন, ‘মৃত বঙ্গবন্ধু, জীবন্ত বঙ্গবন্ধুর চেয়েও শক্তিশালী হয়ে আবিভর্‚ত হবেন।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে