শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ছায়ামূর্তি ও রবীন্দ্রভক্ত বালক

আকিব শিকদার
  ০৩ মে ২০২৪, ০০:০০
ছায়ামূর্তি ও রবীন্দ্রভক্ত বালক

পড়ার টেবিলে বসে আবিদ তার নতুন কেনা চকচকে চটি খাতাটায় কী যেন লিখছিল। হাতের কলমটার পেছনে ময়ূরের পালক লাগানো, আগেকার দিনে কবি সাহিত্যিকদের কলমে যেমন থাকত। রাত তখন ১২টা, সাড়ে ১২টা। যত লেখে, তার চেয়ে বেশি ভাবে। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমের রাজ্যের পরীরা আবিদের চোখের পাতা বন্ধ করে দিয়ে গেল, তা সে বুঝতে পারেনি। তারপর কী হলো? হঠাৎ বিদু্যৎ চলে গেল। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। টেবিলের ধবধবে সাদা খাতাটা থেকে শুরু করে নিজের গায়ের গোলাপি শার্ট, ঘন অন্ধকারে ঢাকা পরল সব। এমন সময় গভীর নির্জনতা ভেঙে মানুষের পায়ের আওয়াজের মতো একটা খসখস শব্দ শোনা গেল। মনে হয় শব্দটা দক্ষিণ দেওয়ালের জানালার ভাঙা কাঁচের ফাঁক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে। ভয়ে আবিদের গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় আবিদ জানতে চাইল- 'কে? কে ওখানে?'

একটা অদৃশ্য কণ্ঠ জবাব দিল- 'আমি, আমি তোর অতিথি।'

আবিদ বলল, 'আমার অতিথি! কী চান আমার কাছে? আমার ভীষণ ভয় করছে।'

অদৃশ্য কণ্ঠ অভয় দিয়ে বলল, 'ভয় পাস নে।'

এবার ঘরের দক্ষিণ কুনে ঝাপসা আলো দেখা গেল এবং অদৃশ্য কণ্ঠ অনেকটা মানুষের আবছায়ার মতো রূপ ধারণ করল। আবিদ দেখতে পেল লোকটার লম্বা লম্বা চুল ঘাড় পর্যন্ত ঝুলন্ত, গায়ে ঢিলেঢালা জামা। ধূসর রঙা একটা বড় চাদরে সারা শরীর ঢাকা। আবিদ ছায়ামূর্তি দেখে আরও বেশি ভয় পেয়ে চিৎকার করতে লাগল- 'আপনার পায়ে পড়ি, আমাকে মারবেন না, মারবেন না, দয়া করে ছেড়ে দিন। আমি বাঁচতে চাই, মরতে চাই না।'

ছায়ামূর্তিটা বলল, 'কী সব বলছিস? স্থির হ... শান্ত হ...'

আবিদ বলল, 'আপনি আমার কাছে যা চাইবেন, তাই দেব। তবু আমাকে ছেড়ে দিন, আমাকে ছেড়ে দিন। আমার ক্রিকেট ব্যাট, আমার ফুটবল, আমার লাটাই-ঘুড়ি, আমার গল্পের বই- যা চাইবেন তাই দেব। তবু আমার জীবন নিয়ে খেলা করবেন না।'

ছায়ামূর্তি একটু গভীর হয়ে বলল, 'চুপ কর। তোর জীবন নিয়ে খেলা করলাম কই!'

আবিদ ভীত স্বরে একটানা বলেই যাচ্ছে- 'আমার টুপি, আমার চশমা, আমার নতুন কেনা পাম-সু, সোনালি ফিতার হাত ঘড়ি; কোনটা চাই- আপনার? এই নিন, এই নিন। এই যে হাত ঘড়ি, ওই যে টুপি, চশমা। পাম-সুগুলো খাটের নিচেই আছে। নিয়ে যান, সব নিয়ে যান, তবু আমাকে মুক্তি দিন।'

ছায়ামূর্তি বলল, 'কী সব আবোল তাবোল বলছিস! এসব দিয়ে আমি কী করব! আগে বল এতক্ষণ কী লিখছিলি?'

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আবিদ বলল-, 'না, না, ও কিছু না, ও কিছু না। অংক করছিলাম। যা কঠিন বীজগণিত, সঙ্গে ইংরেজি স্যারের অনেক পড়া। লিখতে লিখতে হাত ব্যথা করে। খাতাতে এসবই লিখছিলাম।'

ছায়ামূর্তি রাগের স্বরে শাসালো- 'মিথ্যে বলিস! তাও আবার আমার সঙ্গে! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা...'

আবিদ মাথা নিচু করে মিনমিন করল- 'না, না। আপনার সঙ্গে মিথ্যা বলব না। এখনই দেখাচ্ছি। এই দেখুন, এই দেখুন কবিতা লিখছিলাম। আমার পাঠ্য বইয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আছে। তার কবিতা পড়লেই কেমন জানি মাথায় ভাব চলে আসে। কবি হতে ইচ্ছে করে। পড়ালেখা ফেলে কবিতা লিখি। কবিতা লেখা কি অপরাধ? আমাকে ক্ষমা করবেন।'

ছায়ামূর্তি কৌতূহলী ভঙ্গিমায় জানতে চাইল- 'কবিতা লিখিস! লিখতে পারিস? না অন্যদের নকল করিস?'

আবিদ বলল, 'মিথ্যা বলার অভ্যাস আমার আছে, তবে কবিতা নকল করার অভ্যাস নেই। তাছাড়া কবিতা নকল করলে সেটা নকল হয় না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এই নকল বিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।'

ছায়ামূর্তি বলল, 'কী বললি! রবীন্দ্রনাথ নকল করতেন?'

আবিদ বলল, 'হুম, করতেন। তবে হুবহু নকল নয়। অনেক বিদেশি গানের সুর নকল করে তিনি গান লিখেছেন। এমনকি অনেক বাউল গানের সুরও নকল করেছেন তিনি। আমি রবীন্দ্রনাথের ভীষণ ভক্ত। রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, একটাও বাদ দেইনি পড়া থেকে। লাঠি লজেন্সের মতো চুষে খেয়েছি সব। ওই দেখুন আমার আলমারিতে রবীন্দ্রনাথের কত্তো বই।'

ছায়ামূর্তি আলমারির দিকে তাকিয়ে বলল, 'হুম, দেখলাম।'

আবিদ আবার এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগল- 'এই দেখুন আমার কলম-খাতা, আমার লেখা কবিতা, আমার হাতে আঁকা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি। দেখলেই বুঝবেন আমি রবীন্দ্রনাথকে কত ভালোবাসি।'

ছায়ামূর্তি একটু মুচকি হাসলো- 'কলমের মাঝে এটা কী গুঁজে রেখেছিস?'

'এটা ময়ূরপাখির পালক। রবীন্দ্রনাথ পাখির পালক যুক্ত কলম দিয়ে লেখতেন। আমিও তার মতো হতে চাই। এই দেখুন আমার খাতার পাতায় পাতায় আতরের ঘ্রাণ। এটা তারই অনুকরণে আমি করেছি।'

ছায়ামূর্তি হুঁ হুঁ করা শব্দে হাসল।

আবিদ বলেই চলছে- 'এই যে দেখুন খাতার ভেতর গোলাপ ফুলের শুকনো পাপড়ি। রবীন্দ্রনাথও নাকি এমন করতেন। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় রঙ ছিল নীল। নীল রংটা আমারও প্রিয়। দেখছেন না প্রতিটা কবিতাই নীল কালিতে লেখা?'

ছায়ামূর্তি অট্টহাসি হেসে বলল, 'বুঝলাম।'

আবিদ বলল, 'আজকালকার লেখকরা কী সব লিখে, পড়ে স্বাদ পাই না। আমি চাই, রবীন্দ্রনাথের মতো লেখক হতে। যাতে পাঠক আমার বই পড়ে আত্মহারা হয়। কিন্তু মা-বাবা আমাকে কবিতা লিখতে দেয় না। বলে লেখাপড়া কর গে- যা। অথচ আমি চাই, রবীন্দ্রনাথ হতে।'

ছায়ামূর্তি বলল, 'লিখে যা, লিখে যা। দেখিস একদিন...'

আবিদ জানতে চাইল, 'রবীন্দ্রনাথ হতে গেলে কী করতে হবে? তার লেখা গানগুলো আমার খুব প্রিয়। আমি কি তার মতো গান লিখতে পারব?'

ছায়ামূর্তি এবার আবিদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উলটো আবিদকেই প্রশ্ন করল- 'জানিস আমি কে?'

আবিদ ভয়ে ভয়ে বলল, 'না, আমি জানতে চাই না।'

ছায়ামূর্তি রাগের স্বরে বলল, 'কী, জানতে চাস না আমি কে?'

আবিদ বলল, 'অবশ্যই জানতে চাই। জানতে চাই। আপনি নিশ্চয়ই আমার আত্মীয়। আমার কাছের আত্মীয়। আমাকে মারবেন না। আমাকে ছেড়ে দিন।'

ছায়ামূর্তি বলল, 'আমি রবীন্দ্রনাথের আত্মা। তুই আমার আত্মীয়ই বটে। যারা আমাকে এত বেশি ভালোবাসে, আমি তাদের আত্মীয় ছাড়া আর কী হবো বল?'

আবিদ ছায়ামূর্তির দিকে একটু ভালো করে তাকিয়ে বলল, 'রবীন্দ্রনাথের আত্মা!'

ছায়ামূর্তি বলল, 'হ্যা, আমি রবীন্দ্রনাথের আত্মা। যারা আমাকে ভালোবাসে, আমাকে গুরু বলে মান্য করে, আমার পথ অনুসরণ করে, আমি তাদের কাছে এমন করেই ধরা দেই।'

আবিদ হাতের কাছে যেন চাঁদ পেল, 'গুরু, আপনি আমার গুরু। আপনাকে চোখের সামনে পেয়ে আজ আমার জীবন ধন্য। এই যে দেখুন দেয়ালে আপনার ছবি টানিয়ে রেখেছি। ফুলের মালা দিয়ে ঘিরে রেখেছি আপনার ছবি। আপনাকে এমন করে কাছে পাব, ভাবিনি কোনো দিন। আপনাকে কাছ পেয়ে আপনার এই শিষ্যের জীবন আলোকিত হলো। আপনার পায়ে চুমু খেয়ে আমার ঠোঁট দুটিকে ধন্য করতে চাই। আপনার পদধূলি মাথায় নিয়ে মাথার সঞ্চিত জ্ঞান ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ করতে চাই। নিজেকে ফুলের পাপড়ির মতো খন্ড খন্ড করে আপনার পদতলে সায়িত হতে চাই। আমাকে সুযোগ দিন গুরু, আমাকে সুযোগ দিন।'

ছায়ামূর্তি একটু সরে গিয়ে বলল, 'এই, কী করছিস? কী করছিস?'

আবিদ ছায়ামূর্তির দিকে একটু ঝুঁকে বলল, 'গুরু, আপনি সরে যাবেন না, আপনি সরে যাবেন না। আমি আপনাকে যেতে দেব না। আপনার কাছ থেকে লেখালেখির কৌশলটা না শেখা পর্যন্ত আপনাকে ছুটি দেব না। মায়ের হাতের এক কাপ গরম চা খাওয়ার আগে আপনাকে ছাড়ব না। কার সাধ্য আপনাকে আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। গুরু, আপনি যাবেন না।'

ছায়ামূর্তি ছাদের দিকে মুখ রেখে হুঁ হুঁ করে হাসছে।

আবিদ বলল, 'গুরু, আপনি কোথায়? কোথায় আপনার পবিত্র পা? আপনার পা দু'টিকে স্পর্শ করতে দিন। আপনার পা দুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরতে দিন। আপনার পা দু'টিকে ঠোঁটে চুম্বন করতে দিন। গুরু, ও গুরু, কোথায় আপনি?'

এমন সময় খট করে ঘরের দরজা খুলে গেল এবং আবিদের মা ঘরে প্রবেশ করলেন।

'আবিদ! এই আবিদ! ঘরে লাইট জ্বালিয়ে টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিস? ওঠ, ওঠ। রাত অনেক হয়েছে, এবার বিছানায় শুতে যা।'

মায়ের ডাকে আবিদের ঘুম ভাঙল। সদ্য ঘুম ভাঙা লাল লাল চোখে আবিদ দেখতে পেল টেবিলের ওপর খাতা, কলম, চশমা, সব ঠিকঠাক আছে; এমনকি খাতায় লেখা অসমাপ্ত কবিতাটাও তেমনি অসমাপ্তই আছে; কেবল ঘরের দক্ষিণ কোনায় রবীন্দ্রনাথের ছায়ামূর্তি অনুপস্থিত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে