সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বই আলোচনা ছিঁড়ে যাওয়া নদীর টুকরোগুলো

মো. আবদুল হাই আলহাদী
  ১০ মে ২০২৪, ০০:০০
বই আলোচনা ছিঁড়ে যাওয়া নদীর টুকরোগুলো

আধুনিক বাংলা কবিতায় আবেগ উচ্ছ্বাসের কালের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা সন্নিবদ্ধ রেখে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে কাব্যচর্চা করে যাচ্ছেন যিনি, তিনি আশির দশকের কবি মেহেদী ইকবাল। রাশিয়ায় পড়ালেখা করার মুযোগে সমকালীন বিশ্ব রাজনীতি ও কবিতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করেন। পেশায় চিকিৎসক হলেও ব্যস্ততার আবেষ্টনী ভেঙে বিচরণ করেন কবিতার মায়াজাল তৈরির রোমাঞ্চের জগতে। মার্কসীয় চেতনার অনুসারী কবি কল্পনা অনুকরণের অথবা বানোয়াট আর্তযন্ত্রণার ক্ষয়ের জগতে নিজেকে বন্দি করেননি। বরং একান্ত অভিজ্ঞতাপ্রসূত নিজ অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তার কবিতায়। ফলে পরাবাস্তব অন্ধকারের চিত্র তার কবিতায় মেলে না, মেলে মানুষের বহুমাত্রিক চিন্তা চেতনা ও জীবনাচরণের চিত্রকল্প।

আধুনিক কবিতায় যেখানে অনেক কবিদের আবেগ উচ্ছ্বাস প্রলেপ ফেলেছে কবিতার দেহে-আস্তরণ ফেলেছে চর্মে, সেখানে কবি মেহেদী ইকবালের কবিতায় নিজের কাল, মুক্তিযুদ্ধ, সমাজ ও পেছনের বয়ান, জীবন ও জীবিকা, নতুনের আহ্বান, বিজ্ঞান ও প্রেম-ভালোবাসার মতো নানা জাতের মানুষী বোধ বা আবেগ আর মুক্তির অভিপ্রায় এক চমৎকার শৈল্পিক ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। কবির প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ছিঁড়ে যাওয়া নদীর টুকরোগুলো। ৪৮ পৃষ্ঠার এ কাব্যগ্রন্থে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের নানামুখী চিন্তা-চেতনার ৪২টি কবিতা রয়েছে। বিচিত্র প্রবণতার এই কবিতাগুলোর অনেক কবিতাই অসাধারণ সংবেদী হয়ে উঠেছে। কাব্যের বেশকিছু কবিতায় কবির রোমাঞ্চবোধ প্রকট। যেমন-

তেতে ওঠা জলে রোদ্দুরে

প্রতিটি মাছের ভেতরে জাগে ওড়ার স্বপ্ন।

মাছেরা কেন যে ওড়ার স্বপ্ন দ্যাখে!

তাহলে এই ব্যাখ্যা সন্দেহাতীত

পাখির পূর্বপুরুষরা এককালে ছিল জলাশয়ে।

(মাছের স্বপ্ন, পাখির পূর্বপুরুষ)

অথবা,

হৃৎপিন্ডে পাথরের ঢেউ

মাঝরাতে কেঁপে উঠি হিম

আকাশে উড়ছে ঘুড়ি

গুচ্ছগুচ্ছ যুবতীর ডিম।

(পাথরের ঢেউ)

অথবা

একচক্ষু বেড়াল

কিংবা জ্যোৎস্নার তন্তুতে

ঝুলে থাকা মাকড়সা

চারপাশে যাচ্ছে উড়ে

দীর্ঘশ্বাস কড়া লিকারের।

(ভাগ্যরেখা)

এ নৈরাশ্য ও হতাশা থেকে মুক্তির স্বপ্ন আছে, আহ্বান আছে অনেক কবিতায়। কবির অন্তরাত্মা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে অন্যায়-অবিচার আর মানুষরূপী অমানুষের আধিপত্যের সংসারে পূর্ণ সমাজ+সভ্যতা দেখে। তাই এই নষ্টদের ধ্বংস কামনায় কবির আহবান-

আগুন, হে আমার ঊর্ধ্বমুখী শিখা

লালানডে যাওয়ার আগে পুড়িয়ে যাও নষ্ট গেরস্তালি।

(লালানডেগামী বুভুক্ষু শিখার প্রতি)

অথবা

এ ও এক ধরনের অন্ধতা, সার্জন, বিলম্বে সমূহ ক্ষতি

অভিজ্ঞ তোমার হাতে অস্ত্রোপচার প্রত্যাশিত আজ।

(প্রত্যাশিত অস্ত্রোপচার)

বাঙালির জাগরণ, বাঙালির স্বাধীন হয়ে ওঠার মূলমন্ত্র ও প্রেরণা থেকে যেন বিচু্যতির একটা অন্ধকার গ্রাস করছে আমাদের। নানা অবান্তর যুক্তিতর্ক কাজের মূল প্রেরণাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এমন অহেতুক অবান্তর প্রসঙ্গ এড়িয়ে সময়ের কাজ সময়ে করাটাই যৌক্তিক। একই সঙ্গে কবি দেখতে পান শোষকের দলকে-যারা গুড়ের গন্ধে পিঁপড়ের মতো ছুটে আসে, যারা আমাদের সমাজের সর্বভূক, সর্বগ্রাসী। তারপরও প্রেরণার কথা কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের একটি অসাধারণ কবিতা 'নতুন ভোরের স্বপ্নে তবু আমরা বাঁচি।' কবি যেন আশার আলো দেখতে পান। যেমন-

মেঘেদের পা আছে কি নেই, এই তর্ক থাক

থাকলে তার সংখ্যা নিয়ে বাঁধবেই বিপত্তি

বরং স্মৃতির গুড় দিয়ে রুটিগুলো খাওয়া যেতে পারে।

(নতুন ভোরের স্বপ্নে তবু আমরা বাঁচি)

কবি লেখকরা সমাজ-দেশ-ভাষার ঊর্ধ্বে, আবার তারা সমাজের, দেশের, সব মানুষের। ফলে সমাজ- দেশ-ভাষা-মানুষ-মানবতা যাই বলা হোক না কেন, এসবের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থাকে। আর এই দায়বদ্ধতার পরোক্ষ কাজ আছে কবির অনেক কবিতাতেই। ফলে তার কবিতায় আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ ব্যক্তিক সম্পর্কের নিজ অন্তরের সৎ অনুভূতিগুলো প্রকাশ পেয়েছে। এ হচ্ছে একজন প্রকৃত কবির অভিজ্ঞতায় বেঁচে থাকার দায়। আর বেঁচে থাকলে কবিদের এটুকু দায় গ্রহণ না করে উপায় নেই।

বর্তমান সময়ের অনেক কবির মধ্যে যে বালসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি থাকে-বিশেষ করে প্রেমের কবিতা দিয়ে কবিতার হাতেখড়ির প্রবণতা, মেহেদী ইকবালের কবিতায় তা একেবারেই অনুপস্থিত বলা যায়, বরং উপস্থিত রয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তী এদেশের সমাজব্যবস্থায় ঘূণধরা, পচে যাওয়া, নষ্ট হওয়া মানবতার অনিঃশেষ হতাশার বাণী এবং একইসঙ্গে জ্বলেছে যেন আশার আলোকমশাল। প্রচলিত অধিকাংশ কবিতায় যেখানে দেখা যায় কিশোর-কিশোরীর উচ্ছ্বাসে ভরা প্রেম-অভিসার, হাঁস হয়ে জলে সাঁতার কাটা, মেঘ হয়ে আকাশে ওড়া বা নিতান্তই রোমান্টিক কোনো বিষয়, সেখানে মেহেদী ইকবালের কবিতায় দেখা যায় প্রতিদিনের বেঁচে থাকার ভেতরে একটু একটু করে উন্মোচন আর আস্বাদনের মধ্যে যে মানব-মানবীর প্রেম, আঁধার বিনাশি আলোর যে প্রবাহ এবং একই সঙ্গে সভ্যতার অস্তিবাচকতার বাইরের কদর্য যেদিক তার শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ। এমন সব কবিতার মধ্যে সহজেই চোখ বুলিয়ে নেওয়ার মতো কিছু কবিতা হলো : প্রতিশোধ, গস্নাসভর্তি তরল ঠোঁট, ময়দা বিষয়ক, পাখি ভেবে, বনভোজন, ফিনিক্সের ডানা, ভোজ ইত্যাদি।

কবিতার বিষয়বস্তুতে যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে, তেমনি বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় কবিতায় বিচিত্রসব উপমার ব্যবহারে। অনেক কবিতাতেই অতিন্দ্রীয় চেতনায় কবি যেন তৈরি করেছেন অসাধারণ এক মায়াজাল। অভিনব সব উপমা ও চিত্রকল্পের ব্যবহার দেখে পাঠকমাত্রই মুগ্ধ হবেন। প্রসঙ্গত তার কয়েকটি উপমা ও চিত্রকল্পের ব্যবহার এখানে উলেস্নখ না করলেই নয়-

কি হবে একবিংশ শতকে? কী আর হবে!

যা হবার তা হবে, আপাতত তরল ঠোঁট

নাকি রোদের মুন্ডু? গিলে খাব পরম উলস্নাসে।

(গস্নাসভর্তি তরল ঠোঁট)

বৃষ্টি এলো আমার হৃদয়ের দুই পাড় ছুঁয়ে

বিসমিলস্নাহ খাঁ'র সানাইয়ের মতো করুণ সুরে বৃষ্টি এলো।

(বৃষ্টি)

আমরা চাঁদের উরু ভেবে জড়িয়ে ধরি ভাঙা টেবিলের পায়া।

(চাঁদের উরু)

ঘুমগুলো উড়ে যাচ্ছে ঠোঁটে নিয়ে ভ্যানগগের ব্রাশ।

(ছিঁড়ে যাওয়া নদীর টুকরোগুলো)

একাকীত্ব, হতাশা, চারদিকের নানা অসঙ্গতি আর জীবনের করুণতম সন্ধিক্ষণের অসাধারণ সব চিত্রকল্প তার কাব্যে বাঙ্‌ময় হয়ে উঠেছে। কবি যখন বলেন-

আমরা সবাই তুলসীপাতা

ধুয়ে মুছে সাফসুতরো

যত দোষ ওই ঘড়িটার।

য্যানো ঘড়িটির বারোটা বাজতে নেই!

(ঘড়ি)

তখন অন্তঃগোপনে দগ্ধ হওয়ার বেদনার দায় অন্যের ওপর তিনি চাপাতে চান না। এমন দায় এড়িয়ে চলা থেকে মুক্তির আহ্বান দেখা যায় অনেক কবিতায়-

এখন আমি স্বপ্নে দেখি ময়দার স্তুপ

ময়দা, শুধু ময়দা, তৈলাক্ত এবং মসৃণ

রুটির জন্য প্রস্তুত অনিন্দ্য সব পিন্ড।

মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় সবকিছু ছেড়ে দিয়ে

কাজ নিই রেস্তোরাঁয়। আর সমস্তদিন

ডুবে থাকি অদ্ভুত জগতে ময়দার।

(ময়দা বিষয়ক)

অথবা,

য্যানো জ্যোৎস্নার ঠিক নিচে আবছা অন্ধকারে

বিষাক্ত ডিমের কুসুম। য্যানো আমাদের অজান্তে চুঁইয়ে পড়া

সর্বনাশ ঢুকে যাচ্ছে সভ্যতার খানাখন্দে।

কী যে ভালো হতো যদি তুমি বাড়িয়ে দিতে প্রসারিত হাত

নতুন বছরে প্রসারিত হাতের বড় বেশি প্রয়োজন।

(কী যে ভালো হতো)

তার কবিতাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ দিক এই যে, তিনি উপমা, রূপক, চিত্রকল্প বা অলংকারের সন্ধানে বিদেশি সংস্কৃতি বা কাব্য ঐতিহ্যের যেমন দ্বারস্থ হননি, তেমনি অন্য কবিদের অন্ধ অনুকরণও করেননি। যা ভেবেছেন, যা করেছেন যেন একান্ত নিজের মতো করেই। ফলে নিজের সমাজ, নিজের পরিবেশ-ধর্ম-অভিজ্ঞতা ইত্যাদির অংশবিশেষ থেকেই বাছাই করা তার উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্র ও চিত্রকল্প। নিতান্তই প্রচলিত সাধারণ শব্দের ব্যবহারে তিনি যেমন ব্যঞ্জনা তৈরি করেছেন, তেমনি বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহৃত অনেক শব্দের ব্যবহারে কবিতায় ভিন্নতা এনেছেন। অনেক প্রাণিজ শব্দের ব্যবহার-মাছ, শুঁয়োপোকা, মৌমাছি, ঘাসফড়িং, বাঘ, সারমেয়, কেঁচো, ব্যাঙ, মাকড়শা, পিঁপড়া, কচ্ছপ, উঁই, বিষপিঁপড়ে, মাছি, টিকটিকি, কুকুর, হাঙড়, শুশুক, শকুন ইত্যাদি যেমন দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহৃত নিকোটিন, প্যারাবোলা, কোষ, ক্লোন, স্নায়ু, প্যারানোইড, ফসিল, হেলুসিনেশন, পস্নাসেন্টা, ক্লোরোফিল, সার্জন, অস্ত্রোপচার ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার। বিচিত্র ব্যঞ্জনায় এ ধরনের শব্দের প্রয়োগ তার কবিতা রচনায় বহুমুখী বিষয়বস্তুরই প্রতিফলন।

বর্তমান সময়ে বাংলা কবিতায় যে বহুমাত্রিকতা আর নানারকমের নিরীক্ষা চলছে- সেখানে 'ছিঁড়ে যাওয়া নদীর টুকরোগুলো 'কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতাই পাঠকের কাছে শিল্পোত্তীর্ণ সৃষ্টি হিসেবে ভিন্ন ধারার কাব্য উদ্দীপনার জায়গা হয়ে উঠতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে