বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

মানবিক না হয়ে পুরুষ কেন পাশবিক

অরিত্র দাস
  ১৬ মে ২০২২, ০০:০০
মানবিক না হয়ে পুরুষ কেন পাশবিক

বাংলাদেশে উন্নয়নের মহাসড়কে দীপ্র পায়ে হাঁটছে ধর্ষক। ঠিক হাঁটছে না, যেন দৌড়াচ্ছে। কিছুতেই যেন এই দৌড়ের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। একটা সময় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের প্রকোপ ছিল খুব, সন্ত্রাসবাদ হয়ে উঠেছিল শঙ্কিত জীবনের আরেক নাম। এখন সে জায়গাটি দখল করে নিয়েছে ধর্ষণ অর্থাৎ যৌন সন্ত্রাস। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০ জন নারী কিংবা কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে এ দেশে।

দেশে এ বছরের জানুয়ারি মাসে মোট ৭০ জন কন্যাশিশু ও নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার কন্যাশিশুর সংখ্যা ৩৯টি। এছাড়া এ মাসে ১০৬টি কন্যাশিশু ও ১৬৬ জন নারীসহ মোট নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৭২ জন। দেশের ১৩টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে মাসিক জরিপের এই তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। মঙ্গলবার (১ ফেব্রম্নয়ারি) এই প্রতিবেদনের তথ্য গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সিদের কন্যাশিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের বরাত দিয়ে মহিলা পরিষদ বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মোট ২৭২ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন সবচেয়ে বেশি- ৭০ জন। এরপরই রহস্যজনক মৃতু্যর শিকার হয়েছেন ৪৭ জন। এছাড়া জানুয়ারি মাসে হত্যা করা হয়েছে ৪৪ জন নারী ও শিশুকে। ১৮ জন নারী ও শিশুকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে পাঁচ কন্যাশিশুসহ ১০ জনকে। আর এক কন্যাশিশুসহ তিনজন শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন।

'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' সংগঠনটি বলেছে, গত মে মাসের (২০২১) প্রথম ৮ দিনে সারাদেশে ৪১টি শিশুধর্ষণ ও ৩টি শিশু ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। ধর্ষকদের বিষাক্ত ছোবল থেকে বাদ যাচ্ছে না ছেলেশিশুও। কেননা, চলতি বছরের মে মাসের ১ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত অনেকগুলো জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৩৭টি মেয়েশিশু ধর্ষণ এবং ৪টি ছেলেশিশু বলাৎকারের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছিল ৩ জনের ওপর। ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছে ৩টি মেয়েশিশু। আহত হয়েছে ৪১ শিশু। শিশু ধর্ষণের ফলে শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কেন এত ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে? এর একটা কারণ হতে পারে বাংলাদেশে যৌনশিক্ষা সম্পর্কে পাঠ্যবইয়ে বিস্তর আলোচনা নেই, নেই প্রতিটি ধর্ষকের আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিতকরণ। ফলে বিচারহীনতার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা অসহনীয় অবস্থায় উপনীত হয়েছে দিনের পর দিন। অন্য একটি কারণ হতে পারে- প্রকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা, সুশাসন, সুস্থ পরিবেশ, নৈতিকতা ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব, নারী ও পুরুষের মেলামেশায় সংকীর্ণতা, নারীর স্বাধীনতায় মধ্যযুগীয় মানসিকতা পোষণ এবং রাজনৈতিক আধিপত্য। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে বাঙালি যেন মানবিক হওয়ার পরিবর্তে পাশবিক হয়ে উঠেছে। আজ বাংলাদেশে বৃদ্ধের কাছেও শিশু নিরাপদ নয়, আবার একজন তরুণের কাছে বৃদ্ধাও নিরাপদ নয়।

বাংলাদেশে শিশুদের প্রতি সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ২০১৮ সালে ৪৩৩টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সেসময় সারাদেশে ধর্ষণ, যৌননির্যাতন, হত্যা ও শারীরিক নির্যাতনের কারণে মারা গেছে ২৭১টি শিশু। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১০০৬ জন শিশু। অথচ কিছুদিন আগে 'শিশু অধিকার সুরক্ষা ও অগ্রগতি শীর্ষক' সেমিনারের মূলপ্রবন্ধে বলা হয়, চলতি বছরের প্রথম সাড়ে চার মাসেই ৩৪৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮ শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়। প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২২টি এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৮টি। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করে ১০ শিশু। এ ছাড়া ৩৮ শিশু ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। এ সময় ১ হাজার ৪৯০ শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৪৭০ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অধিকাংশ যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ পরিবারের সদস্য, পরিচিত মানুষ, আত্মীয়স্বজন কিংবা প্রতিবেশীদের দ্বারা হয়ে থাকে। পাশাপাশি পুরুষ শিক্ষকের হাতে এই ধরনের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে সাম্প্রতিককালে। সুপরিচিত লেখক, গবেষক এবং সাংবাদিক আফসান চৌধুরী 'ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স' নামের একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশে শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে একসময় এই সংগঠনটিতে কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু ১৯৯৮ সালের দিকে এই কাজ করতে গিয়ে তার মনে পড়ে যায়, শৈশবে তিনি নিজেও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন তাদের পরিবারিক পরিচিতজনের দ্বারা। পরে তিনি সেই বেদনাদায়ক স্মৃতির কথা বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে, আমরা শুনেছি।

বাংলাদেশে সরকারি এক হিসাবে বলা হয়েছে অনলাইনে ৭০ শতাংশের বেশি নারী হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। এমনকি নারীরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করতেও পারেন না। কোনো দল বা সংগঠন বা ব্যক্তির মতের বিরুদ্ধে গেলেই যৌন হয়রানিমূলক বাক্য বা শব্দ তেড়ে আসে। এ ছাড়া ধর্ষণের মাধ্যমে জীবননাশের হুমকিও চলে আসে কখনো কখনো। যৌন হয়রানির শিকার নারীর অবস্থা কতটা ভয়ানক, শোচনীয় এবং প্রকট তা গার্মেন্টশিল্পে চোখ রাখলেই বোঝা যায়। দেশে তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত নারীশ্রমিকদের মধ্যে শতকরা ২২.৪ ভাগ কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া শতকরা ৩৫.৩ ভাগ নারীকর্মী বলেছেন যে, তারা কর্মক্ষেত্রে নারীশ্রমিকের প্রতি যৌন হয়রানির ঘটনা দেখেছেন বা শুনেছেন। অথচ দেশের বৈদেশিক আয়ের ৮০ শতাংশ আসে এই পোশাকশিল্প থেকে এবং এখানে কর্মরতদের মধ্যে শতকরা ৭০ জনই হয় নারী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৪২.৩৩ শতাংশ হচ্ছে 'কামনার দৃষ্টিতে তাকানো'। 'সংবেদনশীল অঙ্গে কোনো কিছু নিক্ষেপ করা' যা শতকরা ৩৪.৯২ এবং সংবেদনশীল অঙ্গের প্রতি লোলুপদৃষ্টিতে তাকানো- যা শতকরা ৩৩.৮৫ ভাগ। কাজ বোঝানোর বা কথা বলার সময় হাত বা শরীর স্পর্শ করা শতকরা ২৮.৫৭ ভাগ। এ ছাড়া আছে বাজে গালি দেয়া, চাকরিচু্যতির হুমকি, অশোভন অঙ্গভঙ্গি, পদোন্নতির কথা বলে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব।

বাংলাদেশের সব পত্রিকার পাতা ধর্ষণের কালিমায় আজ লিপ্ত। আশুলিয়ায় একই পরিবারের তিন নারীকে দীর্ঘদিন ধরে নিজের আস্তানায় ধর্ষণ করে আসছিলেন এক ভন্ড পীর। রাজধানীর গুলশানের কালা চাঁদপুর এলাকার একটি বাসায় এক গারো কিশোরীকে গৃহকর্তা ধর্ষণ করেন। যশোরে একই স্কুলের ৬ ছাত্রীকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে ধর্ষক। বাগানে লিচু খেতে গিয়ে দিনাজপুরের বীরগঞ্জে ষষ্ঠ শ্রেণির এক স্কুল ছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়। ঘর, বাগান, মন্দির, মাদ্রাসা, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজপথ কোথাও নিরাপদে নেই আমাদের মেয়েরা। কুষ্টিয়ায় খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী এক শিক্ষিকাকে ধর্ষণের দায়ে একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শরিফুল ইসলামকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয় কিছুদিন আগে। অন্যদিকে বাসের চালক ও হেলপার কর্তৃক নার্স শাহিনূরকে ধর্ষণের পর তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা। হত্যার পর তাকে কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়া। শুধু তাই নয়- এ দেশের ধর্ষণ উৎসবে মেতে উঠেছে অনুপ্রবেশকারীরাও, মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় এক কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে ভারতীয় এক নাগরিক। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গত ৩১ ডিসেম্বর চার সন্তানের এক জননীকে গণধর্ষণ করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনা মনে করিয়ে দেয় পূর্ণিমা শীল, পারুল কিংবা বগুড়ার সেই মা-মেয়ের কথা। ২০০১ সালের নির্বাচনে বলি হওয়া পূর্ণিমা রানী শীলের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এখনো কানে বাজে পূর্ণিমা রানীর মায়ের আর্তনাদ, 'বাবারা তোমরা একজন একজন করে আসো, আমার মেয়েটা ছোট; ও মরে যাবে।' তবে পূর্ণিমা মরেনি, ওই ঘটনায় লজ্জায় মরে গিয়েছিল রাষ্ট্র। একটি বিষয় খেয়াল করলে দেখা যায়, একের পর এক গণধর্ষণের ঘটনায় পত্রিকায় প্রায়ই উঠে আসছে নোয়খালীর নাম। গণধর্ষণের আখড়া হয়ে উঠেছে যেন নোয়াখালী। অন্যদিকে নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর ইউনিয়নে মাকে গলা কেটে হত্যার পর অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মেয়েকে ধর্ষণ করেছে সামিউল ইসলাম সাগর নামক এক নরপিশাচ। ভাবা যায়- কি ভয়ানক এদের মানসিকতা! এ ছাড়া কুমিলস্নার দেবিদ্বারে এক মাদ্রাসাছাত্রী, হোমনা ও লাকসামে দুই স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে এক মাদ্রাসাছাত্রী। ধর্ষণ নিয়ে লিখতে গেলে কাগজ, কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে তবু ধর্ষণের পরিসংখ্যান কিংবা ধর্ষণ সম্পর্কিত লেখা শেষ হবে না। সেদিন প্রথম আলো পত্রিকায় দেখলাম- নেত্রকোনায় গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসে ৭৯টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৬০টি ধর্ষণ, ৮টি গণধর্ষণ ও ১১টি ধর্ষণের চেষ্টার মামলা। এ ছাড়া এই ছয় মাসে ধর্ষণ, যৌতুকের জন্য নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক ১৫০টি মামলা হয়েছে। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণ। এই বাংলাদেশ চিনতে আমার কষ্ট হয়। এই ধর্ষণ উপত্যকা বাংলাদেশ নয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে