রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর চোখে একুশে বইমেলা

পহেলা ফ্রেব্রম্নয়ারি থেকে চলছে আমাদের প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা। মেলার প্রতিটি স্টলে নতুন নতুন বই শোভা পাচ্ছে। পুরুষ লেখকদের পাশাপাশি নারীদেরও বই প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন জনসংখ্যা নারী-পুরুষ প্রায় সমান সমান। কিন্তু সে হিসাবে নারী লেখকদের সংখ্যা কম। নারী লেখকদের প্রকাশকরা কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে তা আমাদের ভেবে দেখতে হচ্ছে। সমাজ কীভাবে নারী লেখকদের দেখছে এবং তাদের লেখালেখিতে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, এ বিষয়ে কথা বলেছেন বেশ কজন নারী লেখক। তাদের কথা গ্রন্থনা করেছেন- জ্যোতিষ সমাদ্দার বাবু
নতুনধারা
  ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

লেখক লেখকই নারী-পুরুষ

প্রভেদ থাকবে না

নূর কামরুন নাহার

কবি ও কথাশিল্পী

লেখক লেখকই তার নারী-পুরুষ কোনো বিভাজন নেই। তবু চিহ্নিত করার জন্য আমাদের নারী লেখক এই শব্দবন্ধের প্রতি নির্ভর করতে হয়। নারী লিখছেন, দেশি-বিদেশি পুরস্কারও অর্জন করছেন। এক সময় নারীর নিজের কথা প্রকাশের সুযোগ ছিল না, সমাজের নানা বাধা ছিল। নারী সমাজের বাধা এবং নিজের ভেতরের বাধাকে অতিক্রম করেছে এটাই সবচেয়ে বড় বিষয়। এবারের মেলায়ও অনেক নারী লেখকের বই প্রকাশিত হয়েছে, আরো হবে। বইমেলায় প্রতি বছরই নারী লেখকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক যে অধিকসংখ্যক নারী লেখার জগতে প্রবেশ করছেন। তবে লেখক হওয়ার প্রস্ততি ছাড়াই অনেকে বই বের করছেন। মানসম্পন্ন বই প্রকাশ হচ্ছে না। এটি শুধু নারীর জন্য নয়, সব লেখকের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য। অধিকসংখ্যক লেখক বা অধিক সংখ্যক বই নয়, আমাদের লক্ষ্য মানসম্পন্ন বই প্রকাশ। অনেক পাঠ প্রয়োজন যেমন সমসাময়িক লেখকের, তেমনি ধ্রম্নপদী গ্রন্থগুলো। মেলা বিস্তৃত পরিসরে বড় জায়গায় হচ্ছে, পরিবেশও নারীবান্ধব। তবে বইমেলা অন্য মেলার মতো প্রর্দশনী আর দর্শনার্থীর মেলা নয়। এটা সৃজনশীলতা ও মননশীলতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই মেলায় বই প্রকাশের ক্ষেত্রে অবশ্যই গুণ ও মান দেখা প্রয়োজন। তবেই লেখক মূল্যায়িত হবেন, পাঠক ভালো বই খুঁজে নিতে পারবেন। মননশীল জাতি গঠনের জন্য বই এবং বইমেলার ভূমিকাও যথাযথ মর্যাদা পাবে।

নারীরাও সৃজনশীল লেখা লিখতে পারেন

নাহিদা আশরাফী

কবি ও সম্পাদক

সৃষ্টিশীল কাজে যারা আত্মনিমগ্ন থাকেন তাদের কাজকে আমি একজন লেখক ও প্রকাশক হিসেবে সৃষ্টিশীল মানুষের কাজ বলেই জেনে ও মেনে এসেছি। তবু মূল্যায়নের জায়গায় দাঁড়িয়ে যদি আমাকে প্রশ্ন করা হয় এই সমাজব্যবস্থায় কাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় তখন বাধ্য হয়েই মুদ্রার এক পিঠ বড় বেশি দৃশ্যমান হয়। জলধি বরাবরই নতুন লিখতে আসা নারীদের অধিক মাত্রায় মূল্যায়ন করে। জলধির পঞ্চাশ শতাংশ বই নারীদের। স্বমহিমায় সাহিত্যে জায়গা করে নেয়া নারী লেখক যেমন রয়েছে তেমনি প্রথম প্রকাশিত বইয়ের লেখকও রয়েছে। এবারের বইমেলায় নারী লেখকদের গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাসের পাশাপাশি বেশ কিছু গবেষণাধর্মী বইও প্রকাশ পেয়েছে। মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন হলে নারী এমন সৃজনশীল কাজে আরো বেশি এগিয়ে যেতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। লেখক নারী বা পুরুষ হতে পারে। কিন্তু নারীকে লেখিকা বলা হবে এ শব্দের সঙ্গে আমি একমত হতে পারি না। লেখার তো কোনো লিঙ্গ থাকতে পারে না। সমাজ থেকে এ ধরনের বৈষম্যমূলক শব্দ দূর হওয়া প্রয়োজন।

নারী লেখকদের পারিবারিক বাধা

অতিক্রম করতে হবে

সুরমা আক্তার

কবি

একুশে বইমেলা বাংলা একাডেমি ছাড়িয়ে এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। একই সঙ্গে বেড়েছে লেখক এবং পাঠকের সংখ্যা। তুলনামূলকভাবে নারী লেখকদের সংখ্যা সেই হারে বাড়েনি। অনেকের মতে বইমেলায় ২৫ শতাংশের বেশি বই হবে না নারী লেখকদের। বাকি ৭৫ শতাংশ বই হলো পুরুষ লেখকদের। হাতে গোনা কিছু নারী লেখকদের বই চললেও বেশিরভাগ নারী লেখকরা পিছিয়ে আছেন প্রচারের অভাবে। আমাদের সমাজে পুরুষ লেখকদের প্রচারের ক্ষেত্রটা অনেক সহজ, কিন্তু নারী লেখকদের অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তাই তারা প্রচার বিমুখ থাকেন। নারীদের লেখা এতটা কম হওয়ার বড়ো কারণ- পারিবারিক ও সামাজিক বাধা। আমি পারিবারিক সাপোর্ট পাই, কিন্তু সবাই তা পায় না। একুশ শতকে এসেও মেয়েরা নামমাত্র স্বাধীন। এখনো মেয়েরা নিজের মতো করে চলতে পারে না, বলতে পারে না, এমনকি নিজের মত প্রকাশ করার স্বাধীনতাও পায় না। অনেক নারী লেখক আছেন যাদের লুকিয়ে লুকিয়ে লিখতে হয়, বইও বের করতে হয় লুকিয়ে। পরিবারের কোনো সাহায্য তারা পায় না। পরিবার কোনোভাবে যদি জেনে যায় তাহলে সংসারে শুরু হয় চরম অশান্তি। সেই অশান্তি অনেকের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের দিকেও চলে যায়। এমন প্রতিকূলতার মধ্যে নারী লেখকরা কীভাবে তাদের প্রচার করবেন। এজন্যই নারী লেখকদের সংখ্যা কম। এই সমাজ এবং পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে নারী লেখকদের সংখ্যা এমনই থাকবে। আমি আশাবাদী তারাও যাতে আমাদের মতো সুন্দর পরিবেশ পান তাদের প্রকাশ করতে। এতে নারী লেখকদের সংখ্যাও বাড়বে এবং তাদের প্রচারও খুব সুন্দরভাবে সবার সামনে আসবে।

একুশে বইমেলায় নারী লেখকদের

অবদান অনস্বীকার্য

ফারজানা ইয়াসমিন

কবি

সারাবছর অপেক্ষায় থাকেন কবি ও লেখকরা অমর একুশে বইমেলার জন্য। তার সঙ্গে প্রকাশকরা বইয়ের ঘ্রাণে ভরিয়ে তোলেন প্রাণের বইমেলা। বর্তমানে পুরুষ কবি ও লেখকদের সঙ্গে নারী কবি ও লেখকদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। কিন্তু নারীদের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সেটা পারিবারিক ও আর্থিক দুটো দিক থেকেই। প্রকাশকরা নতুন কবি ও লেখকদের বই প্রকাশে আগ্রহী কম থাকায় নারী কবি ও লেখকদের বই প্রকাশ করতে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তবুও পুরুষ লেখকদের পাশাপাশি নারী লেখকরাও এগিয়ে চলছে। বইমেলায় তাদের অবদান অনস্বীকার্য। নারী লেখকরা সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরছেন তাদের গল্প ও কবিতায়।

বাংলা বইয়ের প্রতি সবার আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে অমর একুশে বইমেলার আনন্দঘন পরিবেশ ছোট বড় সবাইকে আকর্ষণ করে। পুরুষ কবিদের সঙ্গে নারী কবিদের বই প্রকাশেও যেন প্রকাশরা আগ্রহী হন সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। নারীরা অনেক প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিয়ে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেছেন।

এভাবেই আলোকিত হোক বাংলা সাহিত্য জগৎ অমর একুশে বইমেলার প্রাঙ্গণ। শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছেই নয়। সারা পৃথিবীতে যেন বাংলা সাহিত্য ও অমর একুশে বইমেলার গুরুত্ব ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রক্ত দিয়ে ভাষা শহীদরা এনেছেন আমাদের এই গর্বের অর্জন বাংলা ভাষা। অমর একুশে বইমেলা যেন তারই রেখাপাত করে। বাংলা সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করতে নারী ও পুরুষ কবি এবং লেখকদের সাহিত্য চর্চায় উভয়কেই মনোনিবেশ করতে হবে। যেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বের বুকে আরও প্রসারিত হতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে