রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসক নন্দিতা এখন সাহসী পুলিশ অফিসার

আবুল হোসেন
  ১২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

এমবিবিএস পাস করা নন্দিতা মালাকার পুলিশে চাকরি করেও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। একজন নারী হয়েও পুরুষের সমানতালে নিষ্ঠা ও সাহসিকতার সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে তিনি গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (সদর ও অর্থ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোপূর্বে তিনি গাজীপুর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবেও সদর দপ্তর, সদর সার্কেল ও ডিবিতে দায়িত্ব পালন করেছেন।

নন্দিতা জানান, নিজ পরিবার সামলানো ছাড়াও পেশাগত দায়িত্ব পালনে তিনি অত্যন্ত সচেতন। এ ক্ষেত্রে তিনি লিঙ্গ বৈষম্য মানতে নারাজ। একজন পুরুষ দিন-রাত যেসব দায়িত্ব পালন করে কর্মক্ষেত্রে তিনিও তা পালন করতে সদা প্রস্তুত থাকেন। দিন হোক রাত হোক, অফিসে হোক, কিংবা অফিসের বাইরে যেখানেই তাকে দায়িত্ব দেয়া হোক তিনি সুস্থ থাকা পর্যন্ত ওই দায়িত্ব পালনে 'না' বলতে রাজি নন। তিনি বলেন, নারী বলে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমাকে ছোট করে দেখা হোক, অনুকম্পা, অনুগ্রহ করা হোক তা আমার জন্য খুবই অপছন্দের বিষয়। অফিসের বাইরেও আন্দোলন/সংগ্রাম বিক্ষোভসহ যে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখেন তিনি। ক্ষেত্রবিশেষে তিনি পুলিশ পেশায়ও আগের চিকিৎসা পেশার অভিজ্ঞতা কাজে লাগান।

কেন এমবিবিএস পড়লেন

নন্দিতা বলেন, আমাদের দেশে অধিকাংশ মা-বাবাই চান মেধাবী সন্তানরা এ পেশায় আসুক। আমার বেলাও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মায়ের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিতেই কঠোর প্রস্তুতি নিয়ে এমবিবিএস পরীক্ষা দেই এবং চান্স পেয়ে ভর্তিও হই। এর আগে তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ২০০৫ সালে দিনাজপুর সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসা পেশায় নিযুক্ত হন নন্দিতা। রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের মাঝপথে তিনি পুলিশের পেশায় যুক্ত হন।

কীভাবে পুলিশের পেশায় নন্দিতা

তিনি বলেন, এক ভাই এক বোনের মধ্যে নন্দিতা হলেন বড়। তার ছোটভাই এবং স্বামীও চিকিৎসক। ডাক্তারি পেশাকে আমি অশ্রদ্ধা করি না। কিন্তু পুলিশ পেশায় থেকে নিজের ও পরিবারসহ সমাজের মানুষকে যেভাবে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হয় তা একজন ডাক্তারের পক্ষে দেয়া সম্ভব হয় না। ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম অন্যায়ের প্রতিবাদী। পুলিশ মানুষকে সাহসী করে তোলে, বিপদে পড়া মানুষকে উপকার করতে পারে, রক্ষা করতে পারে। নিজের ইচ্ছা এবং বাবার ইচ্ছাও ছিল যাতে আমি নারী হিসেবে প্রচলিত পেশার বাইরে গিয়ে ব্যতিক্রমী, সাহসী কোনো পেশায় নিজেকে সাবলম্বী করে তুলি। এজন্য বাবা শ্রদ্ধেয় ইন্দিরা গান্ধী, মার্গারেট থ্যাচার, বেগম রোকেয়াদের বই পড়ার জন্য তাকে এনে দিতেন- যাতে তাদের জীবনী পড়ে অনুপ্রাণিত হই। তাদের সংগ্রামী জীবন আর নেতৃত্ব গুণ আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। যা আমাকে পুলিশ পেশায় অনুপ্রাণিত করেছে। এ ক্ষেত্রে আমার বাবা ও স্বামীর অনেক অবদান রয়েছে। তাদের ইচ্ছা পূরণে আমি ৩০তম বিসিএস পরীক্ষায় পুলিশকে ১ম চয়েচ রেখে পরীক্ষা দেই এবং শেষে চান্স মিলে। বিভিন্ন জেলায় ও পরিবেশে কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করি। পরে পদোন্নতি হয়ে আজকের কর্মস্থলে আছি।

স্বামী-সন্তান পরিবারের সদস্য

আমার স্বামী ঢাকার মহাখালীতে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। আমাদের দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে বিএএফ শাহীন কলেজে ঢাকায় একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। আর ছোট ছেলে গাজীপুরে একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে। আমার স্বামী, শাশুড়ি, দুই ছেলে ও গৃহ কর্মে সহায়তাকারীসহ ৬ সদস্যের পরিবার রয়েছে আমাদের।

কীভাবে পরিবার সামলান

নন্দিতা বলেন, এমনিতেই আমাদের পুলিশের চাকরি ২৪ ঘণ্টার চাকরি। এর মাঝেই পরিবারকেও সময় দিতে হয়। প্রতিদিন না পারলেও বাচ্চাদের প্রয়োজনে পড়া দেখিয়ে দেয়া, বাসার কাজগুলো গৃহকর্মীর সহায়তায় গোছানো। এসব কাজে স্বামীও তাকে নানা কাজে সহায়তা করেন। ছুটির দিন সব সময় থাকে না। তারপরেও যেদিন থাকে সেদিন বাসায় সময় দিয়ে গোছানোর কাজ করা হয়। এজন্য অনেক সময় সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা, নিজের জন্য সময় দেয়া প্রায়ই হয়ে ওঠে না। এ পেশায় বিপদ আছে জেনেই সামনে এগোতে হয়। এটা একটা চ্যালেঞ্জিং পেশা। পরিবার ও পেশার সমন্বয় করতে গিয়ে নিজের জন্য সময় বের করতে পারাটা কঠিন হয়ে যায়।

গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর জেলায়। বাবা ঢাকা জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও কর্মসূত্রে দিনাজপুরে গিয়ে সেখানেই স্থায়ী হন। দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও দিনাজপুর সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে ২০০৫ সালে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসা পেশায় নিযুক্ত হই। রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের মাঝপথে ছিলাম যখন পুলিশ পেশায় যুক্ত হই।

পুলিশে প্রথম কর্মস্থল

৩০তম বিসিএসে চাকরি লাভের পর কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে ২০১৪ সালে নন্দিতার সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে চাকরি শুরু হয় ঢাকার স্পেশাল ব্রাঞ্চের পাসপোর্ট বিভাগে। পরে সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে ইমিগ্রেশন শাখা, গাজীপুর জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং সর্বশেষ গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ উপ-কমিশনার হিসেবে কাজ করছেন।

পুলিশের চাকরি ক্ষেত্রে চিকিৎসক পেশার প্রয়োগ

মহাসড়কে ট্রাফিক ডিউটি ও গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ঠেকাতে গিয়ে অনেকবার বিপদসংকুল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে। অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে গিয়ে অনেক সময় বারবার ব্যর্থ হতে হয়। ধৈর্য না হারিয়ে আরো অধিক কৌশলী হয়ে কাজ শেষ করতে হয়। গত বছর পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন ঠেকাতে প্রস্তুত নিতে গিয়ে গাড়ির ভেতরে সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণে কয়েক পুলিশ মারাত্মক জখম হন। এ সময় গুরুতর আহতাবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়াসহ অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসকদের সাহায্য করেছেন তিনি। এছাড়াও বিভিন্ন অসুখে সহকর্মীদের চিকিৎসা সেবা দেন বলেন নন্দিতা।

পুলিশ পেশা আত্মবিশ্বাসী করে তোলে

পুলিশ পেশায় গিয়ে আইন বিষয়ে জানা, গাড়ি ও অস্ত্র চালনা ছাড়াও ঘোড়ায় চড়াসহ যে বিষয়গুলো একজন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হিসেবে কল্পনার বাইরে ছিল। হাতে কলমে শিক্ষাদান, সাহসী ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করে নিজেকে একজন দক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাহিনী থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছি। নেতৃত্বগুণের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এ পেশায় ২০১৯ সালে শুদ্ধাচার পুরস্কার লাভ করেন। তিনি নজরুল, রবীন্দ্র সঙ্গীত ছাড়াও আধুনিক গান করতে পারেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান করারও অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।

গাজীপুর পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম বলেন, নন্দিতা তার কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত নিষ্ঠিাবান একজন পুলিশ অফিসার। চিকিৎসায়, সংস্কৃতি অঙ্গনেও তার ভালো দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। সর্বমহলে তার কানেক্টিভিটিও ভালো। তাকে কোনো দায়িত্ব দেয়া হলে তা তিনি সুচারুভাবেই সম্পন্ন করেন। তিনি নারী হলেও পুরুষের সমানতালে তাকে কাজ করতে দেখেছি।

গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেন, নন্দিতা একজন চৌকস ও মেধাবী কর্মকর্তা। একজন পারফেক্ট পুলিশ অফিসার বলতে যা বুঝায় নন্দিতা সেরকম একজন পুলিশ অফিসার। নন্দিতা একজন নারী হলেও তার মধ্যে একজন পুরুষের চেয়ে পারফরমেন্স কোনো অংশে কম দেখিনি।

আপনার পছন্দের ব্যক্তি: নন্দিতার প্রিয় ব্যক্তি হলেন ইন্দিরা গান্ধী, বেগম রোকেয়া এবং আমার বাবা।

দেশের নারীদের জন্য আপনার বক্তব্য: নারীদের জীবনে সফল হতে হলে হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। যে কোনো মূল্যে লেগে থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভালো পড়াশোনা করাটা খুব জরুরি, এর কোনো বিকল্প নেই। এটা অন্যের কাছে আপনার গুরুত্ব ও প্র?য়োজন বাড়িয়ে দেবে।

অবসর কীভাবে কাটে: বাগান করে।

নিজের রান্না/বান্না অভিজ্ঞতা :

পেশার জন্য প্রতিদিন রান্না করার সুযোগ নেই। তবে আমার দুই ছেলের সঙ্গে অবসরে রান্নাঘরে ঢুকে ওদের সঙ্গে মিলে রান্না করা হয়। আমার বড় ছেলে খুব ভালো রাঁধে। ছোট টাও পারে। আমার অনুপস্থিতিতে ছোট খাটো রান্না নিজেরাই করতে পারে। তাদের বিভিন্ন কাজে স্বাবলম্বী হতে উৎসাহ দেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে