শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর জাগরণই জাতির জাগরণ

রাজিন হাসান রাজ
  ১২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

সাম্যের গান গাই-

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ, নিউইয়র্কের সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা এবং কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছিলেন। এই প্রতিবাদের ফলে অনেক নারী গ্রেপ্তার ও নির্যাতিত হন। এরপর ১৯১০ সালে ক্লারা জেটকিন প্রস্তাব করেন যে, ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা হোক এবং ১৯১১ সাল থেকে এই দিনটি পালিত হতে থাকে। যা নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অর্জনকে সম্মান করে ও লিঙ্গ সমতা এবং নারীর অধিকারের পক্ষে কথা বলে। এই দিনটি নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রগতির একটি শক্তিশালী অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে, এটি আরও ন্যায়সঙ্গত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় চলমান কাজ।

ক্লারা জেটকিন ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ। জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। তার জীবন ও কর্ম নারীদের মুক্তি এবং সমাজতন্ত্রের প্রচারে উৎসর্গিত ছিল।

১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে, ১৯৭৭ সালে এই দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘ প্রতি বছর একটি বিশেষ থিম নির্ধারণ করে- যা নারীর সমস্যা এবং অর্জনকে আলোকিত করে।

এই দিবসটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে পালিত হয় এবং সারা বিশ্বের সব দেশে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়। নারী দিবস হচ্ছে সেই দিন, যেই দিন জাতিগত, গোষ্ঠীগত, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে বৈষম্যহীনভাবে নারীর অর্জনকে মর্যাদা দেওয়ার দিন। এ দিনে নারীরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করে। প্রতি বছর জাতিসংঘ একটি বিশেষ থিম নির্ধারণ করে- যা নারীর সমস্যা এবং অর্জনকে আলোকিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের নারী দিবসের থিম 'নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ'। এই থিমগুলো নারীর প্রতি সবরকম বৈষম্য ও অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটিয়ে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব গড়ার কাজে পুরুষের সমান অবদান রাখার প্রত্যয় নিয়ে নারীর এগিয়ে চলাকে উৎসাহিত করে।

বিশ্বের এক এক প্রান্তে নারীদিবস উদ্‌যাপনের প্রধান লক্ষ্য এক এক প্রকার হয়। কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা উদ্‌?যাপনের মুখ্য বিষয় হয়, আবার কোথাও মহিলাদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠাটি বেশি গুরুত্ব পায়। বিশ্বের অনেক দেশে এই দিবসটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়, যেমন আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, কিউবা, জর্জিয়া, গিনি-বিসাউ, ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, লাওস, মলদোভা, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনিগ্রো, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উগান্ডা, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং জাম্বিয়া। চীন, মেসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার, নেপালে শুধুমাত্র নারীরাই সরকারি ছুটির দিনভোগ করেন।

বাংলাদেশে নারী দিবস বিভিন্ন উপায়ে উদযাপিত হয়। এই দিনটি সাধারণত র?্যালি, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং নারী উন্নয়ন মেলার মতো কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হয়। এই দিনে নারী উন্নয়নে অসামান্য অগ্রগতি, সমতা সৃষ্টি, বৈষম্য হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিয়ে বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি, নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে ব্যানার, পস্নাকার্ড, ফেস্টুন প্রকাশিত ও প্রদর্শিত হয়। বাংলাদেশে নারী দিবস উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য হলো নারীর অধিকার আদায়ের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করা এবং নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করা। এই দিনটি বিশ্বের অনেক দেশে সরকারি ছুটির দিন হিসেবেও পালিত হয় এবং বাংলাদেশেও এটি একটি প্রধান উপলক্ষ হিসেবে পালিত হয়।

নারীদের প্রতি সম্মানজনক ও ন্যায্য আচরণ অত্যন্ত জরুরি। সমাজে নারীরা বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে থাকেন এবং তাদের অবদান অপরিসীম। তাই তাদের প্রতি আচরণে সম্মান ও সহানুভূতি প্রদর্শন করা উচিত। কর্মক্ষেত্রে নারী সহকর্মীদের প্রতি পুরুষের আচরণ সম্মানজনক ও পেশাদারি হওয়া উচিত। নারীদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সচেতনতা, শিক্ষা এবং আইনি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা অপরিহার্য। নারীদের অধিকার ও সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তাদের প্রতি অন্যায্য আচরণ বা হিংসার বিরুদ্ধে আইনি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিশ্চিত করা। সমর্থন ও সহানুভূতি প্রদর্শন করা। সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করা। এই বিষয়গুলো মেনে চললে নারীরা সমাজে আরও নিরাপদ ও সম্মানিত অবস্থানে থাকতে পারবেন। সবার উচিত নারীদের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতির সঙ্গে আচরণ করা এবং তাদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করা।

নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা আমাদের সমাজের একটি অপরিহার্য বিষয়। নারীরা যে কোনো সমাজের অর্ধেক আকাশ এবং তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা সমাজের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। তবে, এই স্বাধীনতার নামে অশ্লীলতা প্রচার একটি গুরুতর সমস্যা- যা সমাজের মৌলিক মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ন করে। সমাজে নারীর নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং অশ্লীলতা বন্ধ করা উভয়ই জরুরি। নারীর স্বাধীনতা মানে হলো তার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, স্বাবলম্বী হওয়া এবং সমাজে সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার। এই অধিকার অর্জনের পথে নারীদের অনেক বাধা পেরোতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তাই নারীর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনায় অশ্লীলতার প্রচার একটি বিপজ্জনক প্রবণতা- যা নারীর সম্মান ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করে। অশ্লীলতা বন্ধের জন্য সমাজের সব স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষা প্রসার, আইনি প্রতিকার, মিডিয়া ও ইন্টারনেটের যথাযথ ব্যবহার জরুরি। সরকার ও সমাজের যৌথ প্রচেষ্টায় অশ্লীলতা বন্ধের উপায় হিসেবে ইন্টারনেটে অশ্লীল ভিডিও বন্ধ করা, সামাজিক মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং শিক্ষামূলক কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে।

সমাজের প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব হলো নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানো এবং অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সচেতন থাকা। একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে হলে নারীর সম্মান এবং মর্যাদা রক্ষা করা অপরিহার্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে