শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নারী ও সামাজিক ন্যায্যতা

সাদিয়া আফরিন
  ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

ইদানীং নারী দিবসের আগে থেকেই কেমন দোআঁশলা অনুভূতি হতে থাকে একই সঙ্গে কৌতুক ও বিড়ম্বনা মিশ্রিত। কৌতুকবোধ হয় এই ভেবে যে, নারী দিবস ঘিরে না জানি কত ধরনের তামাশা দেখতে হবে! আর বিড়ম্বনা এ অর্থে, দিনটির ইতিহাস, গৌরব ও তাৎপর্য ফিকে হতে হতে 'পার্পল পাওয়ার ডে' হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছে। যদিও নারীদের নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবাভাবির সুযোগ হয়, কিন্তু দিবসটি দায়িত্বশীলতার চেয়ে ঢের বেশি হয়েছে উদযাপনের। কর্মযজ্ঞের চেয়ে বেশি হয়েছে করপোরেটের। খাই-দাই, শপিং, আড্ডা, সভা-সেমিনার, উপহার, ফুল, বিশেষ ছাড়, হীরার আংটি, ট্রল, নিন্দা, হাসাহাসি আর দিন শেষে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেগুনি সাজসজ্জার ছবি। যেন মিডল ক্লাস, অভিজাত, করপোরেট নারী দিবসের কমপিস্নট প্যাকেজ। শ্রমজীবী, পিছিয়ে পড়া নারীসহ আপামর জনসাধারণের সঙ্গে দিবসটির যোগাযোগ কতটা, গবেষণার দাবি রাখে।

কেউ কেউ বলতে পারেন, এমন একটি আন্তর্জাতিক দিবসে উদযাপন ছাড়া কী বা করার আছে? অংশীজন না হয় আলাপ-আলোচনা করবেন; একাডেমিক ও গবেষকরা লেখালেখি করবেন; নীতিনির্ধারকরা কর্মপন্থা ঠিক করবেন; এসবে ব্যক্তির ভূমিকা কী?

দেখা যাচ্ছে, শুরু থেকেই দৃশ্যত নারী দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন-সমঅধিকার, সুযোগ, মর্যাদা, বৈষম্য বিলোপ, ক্ষমতায়ন, সহিংসতা প্রতিরোধ ইত্যাদি। কিন্তু জনপরিসরে এ দিবস নিয়ে যে মাতামাতি, তা অনেকটাই 'টোকেনেস্টিক'। যে লিঙ্গবাদী আচরণ, ভূমিকা, স্টেরিওটাইপ, মূল্যবোধ নারীকে অধস্তন, প্রান্তিক, অনগ্রসর করে রাখে, বৈষম্য আরোপ করে, সেসব নিয়ে কথা বলা, প্রশ্ন করার চাইতে এক দিন নারীর স্তব, প্রশস্তিগীত করা, দায়িত্বশীল পদে বসিয়ে সং সাজানো-সমেত এ দিন হয়ে উঠেছে করপোরেট ও বাণিজ্যিক উদযাপনের ঝলমলে উপলক্ষ।

ধরে নিলাম, পুঁজিবাদ যেহেতু আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আঁতুড়ঘর, সেহেতু করপোরেট বাণিজ্য একে গ্রাস করবেই। ধরে নিলাম, মূলধারার নারীবাদ ফিলিস্তিনের নারীদের সংগ্রাম নিয়ে এদিন 'সঙ্গত' কারণেই কথা বলবে না। কিন্তু নারী বা অন্যান্য লিঙ্গের ব্যক্তির বুঝতে পারা জরুরি, কোনটা সার্কাস আর কোনটা অর্থবহ। ব্যক্তির ভূমিকা এখানেই।

নারী-পুরুষ বাইনারি জেন্ডার অথবা যে কোনো লিঙ্গীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকা সমাজ, আইন, রাষ্ট্র থেকে কম নয়; বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি এবং বিস্তৃত। এ ক্ষেত্রে সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে, 'পারসোনাল ইজ পলিটিক্যাল'। কারণ ব্যক্তি সম্পর্কের (পরিবার) ওপরেই সমাজ, আইন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। এই কাঠামোগুলোকে ব্যক্তি চ্যালেঞ্জ না ছুড়লে কীভাবে নারীর অন্তর্ভুক্তি ঘটবে? যে লিঙ্গ পক্ষপাত, ভূমিকা, আচরণ নির্ধারিত আছে, যেসব নির্মিতি আছে- যা নারীর অন্তর্ভুক্তিকরণকে বাধা দেয়, ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা তাদের ছুড়ে না ফেললে অন্তর্ভুক্তি হবে কীভাবে?

সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার কাজটি ব্যক্তি সম্মিলিতভাবে করতে পারে। নারীর কাঠামোগত অধস্তনতা ও অস্বীকৃতির রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। প্রশ্ন করতে পারে, কেন পিতার সম্পত্তি কন্যারা সমান পাবে না? কেন মায়েরা সন্তানের আইনি অভিভাবক হবে না? কেন সব প্রতিষ্ঠান সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করবে না? কেন গৃহস্থালিতে নারী একা খেটে মরবে? কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ক পার পেয়ে যাবে? অথবা কেন একা থাকা, বিচ্ছেদে থাকা অথবা ধর্ষিত নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে? কথাগুলো বারবার বলা জরুরি।

গর্ভধারণের কারণে যদি নারীর চাকরি হারাতে হয়, আর আমি সেই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে সে বিষয়ে সোচ্চার না হই; যদি নারী দিবসে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানো নারীকে সর্বক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; তা আদৌ নারীর সমষ্টিগত উপকারে আসবে কি? যেখানে আমি নিজেই নারীর বাদ পড়া বা কোণঠাসা হওয়াকে মেনে নিচ্ছি, সেখানে নারীর অন্তর্ভুক্তিকরণ ঘটবে কীভাবে? আমি হয়তো এটাকেই 'স্বাভাবিক' হিসেবে দেখতে শিখেছি। কারণ এই প্রান্তিকীকরণ আসে তথাকথিত লিঙ্গীয় পক্ষপাত থেকে। নারীর অন্তর্ভুক্তির জন্য তাই দরকার সমাজ নির্মিত লিঙ্গীয় ভূমিকা, লিঙ্গীয় পক্ষপাত ও রাজনীতিকে প্রশ্ন করা। লিঙ্গবাদী কাঠামো কোনো এক সুন্দর সকালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বদলে যাবে না।

নারীর অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গীয় পক্ষপাত ও লিঙ্গীয় ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ করার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষের অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণও জরুরি। পুরুষের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া নারী বা অন্যান্য লিঙ্গের অন্তর্ভুক্তিও অসম্ভব। পুরুষের অন্তর্ভুক্তি এই অর্থে যে, যেসব কাজ, ভূমিকা নারীর বলে নির্ধারণ করা হয়েছে, সেসবে পুরুষের অন্তর্ভুক্তি। যেসব আচরণ, অভ্যাস, আরোপণ নারীর ক্ষেত্রে 'স্বাভাবিক' করে দেখা হয়, তার বদল।

এই বদল কীভাবে হতে পারে? পরিবার থেকেই এর শুরুটা হতে পারে। কেননা, নারীকে দেখার প্রাথমিক দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা, আচরণ গঠিত হয় পরিবারে। যে শিশু নারীকে সেবা প্রদানকারী হিসেবে দেখে অভ্যস্ত, সে শিশু নিজের পরিবারেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করবে। যে শিশু পরিবারে নারীকে নির্যাতিত হতে দেখবে, সেও নারী নির্যাতনকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখতে শিখবে।

এ বিশ্বেরই কিছু অংশে যেমন- পশ্চিমা সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্ষণের ঘটনায় শিশুরা দেখে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আইন কীভাবে ধর্ষণের শিকার নারীর পাশে দাঁড়ায়; উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। সে দেখে তিনি যত না নারী, তার চেয়ে বেশি চিহ্নিত হন ব্যক্তি হিসেবে। যার অধিকার আছে নিরাপদে, নিশ্চিন্তে বিচরণ করার।

পশ্চিমা রাষ্ট্রে যেহেতু বহু সংস্কৃতির সম্মিলন ঘটে, রাষ্ট্র এখানে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঐক্য ও সমঅধিকারের ভিত্তিতে আইনকানুন, ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ফলে লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, ক্ষমতার বিচারে কেউ বৈষম্যের শিকার হয় না। আর হলেও রাষ্ট্র তার দায়িত্ব নেয়। কিন্তু বিশ্বের যেসব অঞ্চলে রাষ্ট্রের চাইতে সমাজ বেশি শক্তিশালী এবং লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ ও ক্ষমতার বিচারে মানুষের অবস্থান নির্ণীত হয়, যেমন- বাংলাদেশ, সেসব অঞ্চলে রাষ্ট্রের অবস্থান অনেকটাই ঢিলেঢালা। ফলে লিঙ্গীয় পরিচয় ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তি ও 'বাদ পড়া'র ক্ষেত্রে অনেক বড় প্রভাবক।

লিঙ্গীয় অন্তর্ভুক্তি ধারণা হিসেবে লিঙ্গীয় সমতা থেকে খানিকটা সূক্ষ্ন। এতে নারী-পুরুষ লিঙ্গীয় সমতার বদলে লিঙ্গ নির্বিশেষে অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে ন্যায্যতাকে ফোকাস করা সম্ভব হয়। দীর্ঘ মেয়াদে তা সামাজিক ন্যায্যতার ব্যাপারে কিছুটা আশাবাদীও করে। কিন্তু আমাদের দেশে নারী ও অপরাপর লিঙ্গীয় পরিচয় ঘিরে, তদুপরি নারীকেন্দ্রিক একটি দিবস ঘিরে যেসব কর্মকান্ড বিস্তৃত হচ্ছে, তাতে এই আশার গুড়ে বালি পড়া নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে