রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চাকায় চড়েই এগিয়েছে এখনকার প্রযুক্তি

শেখ একেএম জাকারিয়া
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

চাকা কী জিনিস তা বর্তমানে কারও অজানা নয়। ছোট-বড় নুনাধিক সবাই অবগত প্রযুক্তি বিজ্ঞানের প্রথম আবিষ্কার চাকা। এ চাকাকে বলা হয়ে থাকে মানবসভ্যতা উন্মেষের গতি। মানুষের মন্থর গতিবিশিষ্ট জীবনে গতি আনে এই চাকা। চাকা উদ্ভাবন হওয়ার আগে মানুষ নিজেই বহন করত তাদের সব বোঝা। চাকার আরেক নাম চক্র। এ চাকা বা চক্র হচ্ছে যানবাহনে ব্যবহৃত এক ধরনের চক্রাকার যন্ত্রাংশ। এর উপরেই ভর করে বা গড়িয়ে গড়িয়ে যানবাহন তার অবস্থান পরিবর্তন করে থাকে। মানুষজাতির ইতিহাসে চাকার উদ্ভাবনকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বা পরিবর্তন হিসেবে ধরা হয়। তা ছাড়া এ সময়ে শুধু যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত বাহনেই নয়, আরও অনেক যন্ত্রেই চাকার ব্যবহার আছে। আজ আমরা চোখের সামনে প্রতিদিনই চাকার ব্যবহার দেখছি। কিন্তু একটা ব্যাপার হয়তো অনেকেই গভীরভাবে উপলব্ধি করি না, এই চাকা মানবসভ্যতাকে বদলে দেওয়া উদ্ভাবনগুলোর একটি। চাকা উদ্ভাবনের পর থেকেই নতুন গতিতে এগিয়েছে মানুষ। আর এ কারণেই চাকা আবিষ্কার মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি বিশেষ প্রাপ্তি হিসেবে দেখা হয়। চাকা উদ্ভাবনের আগে মানুষজাতি বনের পশুকে পোষ মানাতে শেখে। গৃহপালিত প্রাণীতে পরিণত হয় গরু, গাধা, ঘোড়া, খচ্চর, উট প্রভৃতি প্রাণী। এরপর এসব প্রাণীর পিঠে বোঝা চাপিয়ে মানুষ মালামাল বহন শুরু করে। যখন চাকা ছিল না, তখন মানবসভ্যতায় কোনো ধরনের গাড়ির প্রচলনও ছিল না। ফলে মানুষকে হেঁটে পাড়ি দিতে হতো মাইলের পর মাইল পথ। মানুষ তখন নিজেদের প্রয়োজনে কাঁধে কিংবা মাথায় বহন করে অথবা ঘোড়া-গাধা-উট প্রভৃতি পালিত পশুর গায়ে চাপিয়ে জিনিসপাতি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেত। যে কাজটি মানুষের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। শুধু কষ্টসাধ্যই নয়- এভাবে পরিবহণ করতে অনেক সময় লাগত। আর এ কারণেই মানুষজাতি একটা সময় গাছের গুঁড়ির চাকতি কেটে মাঝ বরাবর ছিদ্র করে? চাকা তৈরি করে। চাকা তৈরির পর মানুষ এখানেই থেমে থাকেনি, চাকার সঙ্গে যুক্ত করে একটি অক্ষদন্ড। দুই চাকাকে জুড়ে দিয়ে তার সঙ্গে যুক্ত করে কাঠের পাটাতন। তৈরি হয় পৃথিবীর প্রথম অপরিণত গাড়ি। মোটকথা চাকা উদ্ভাবনের পর আস্তে আস্তে মানুষের সব সমস্যা দূর হতে থাকে।

চাকার উপর ভর করে আবিষ্কার হতে থাকে নানা ধরনের রুচিশীল ও আরামদায়ক গাড়ি। এক সময় মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহণ সবই হয়ে ওঠে সহজ-দ্রম্নততর।

তবে পৃথিবীতে কখন, কোথায় প্রথম চাকা আবিষ্কার হয়, তার কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় প্রথম চাকা আবিষ্কৃত হয়। মেসোপটেমিয়া হচ্ছে ইরাক অঞ্চলের প্রাচীন এক সভ্যতার নাম। আদিতে কুমোরদের কাজে চাকার ব্যবহার ছিল। বইপত্রাদি পাঠে জানা যায়, ককেশাসের উত্তরে কিছু গোরের সন্ধান পাওয়া গেছে, যে স্থানে ৩৭০০ খ্রিষ্টপূর্ব হতে ঠেলা গাড়িতে করে মৃতদেহ সমাহিত করা হতো। তা ছাড়া খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের নিকটবর্তী সময়ে তৈরি করা একটি মাটির পাত্র দক্ষিণ পোল্যান্ডে পাওয়া গেছে, যে পাত্রটিতে চার চাকার একটি গাড়ির ছবি আছে। আর এটিই আমাদের পৃথিবীতে চাকাযুক্ত গাড়ির ছবির সবচেয়ে পুরানো চিহ্ন বা নিদর্শন।

খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় চাকার ব্যবহার শুরু হয়। অন্যদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতায় চাকার ব্যবহার শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে। চীনে চাকার ব্যবহার শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ অব্দে যে সময় অন্যান্য দেশে চাকাযুক্ত গাড়ির প্রচলন ছিল। তবে বারবিয়েরি-লো-এর মতে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে চীনে চাকার প্রচলন ছিল।

প্রাচীন যুগে নুবিয়াতে চাকার প্রয়োগ হতো মাটির হাঁড়ি ও পাত্র তৈরিতে। নুবিয়াতে সে সময় খাবার পানি উত্তোলনেও চাকা ব্যবহৃত হতো। পানি উত্তোলন করতে চাকাগুলো ঘুরানো হতো গবাদিপশু দিয়ে। এ ছাড়া নুবিয়ার অধিবাসীরা মিশর থেকে আনা অশ্বচালিত রথ ব্যবহার করত। প্রাচীনকালে চাকা ব্যবহার করা যাবে এমন উপযুক্ত সমতল বা মসৃণ রাস্তা না থাকায় চাকার ব্যবহার অনেকটা বাধাগ্রস্ত হয়। যেসব অঞ্চলে সমতল ভূমি বা পথ ছিল না ও অসমতল-পথহীন ভূমির উপর দিয়ে চলতে হয়েছে, সেসব এলাকায় চাকাযুক্ত যানবাহনের পরিবর্তে মানুষ কিংবা পশুর পিঠে চাপিয়ে জিনিসপত্র বহন করা হতো। অধিকন্তু বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত পৃথিবীর অনগ্রসর অঞ্চলগুলোতে ভালো পথঘাটের অভাবে চাকাযুক্ত যানের প্রচলন কম ছিল।

আদিযুগে মানবসভ্যতায় চাকা নির্মাণ হতো কাঠের চাকতি দিয়ে, যার মাঝখানে অক্ষদন্ডের জন্য একটি গর্ত করা হতো। স্পোকযুক্ত চাকা অনেক পরে আবিষ্কৃত হয়। এই স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার গাড়ির ওজন কমিয়ে আনে, যার ফলে দ্রম্নতগতির বাহন মানুষের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব হয়। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে আন্দ্রোনভ সংস্কৃতিতে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার দেখা যায়। এর কিছুকাল পরেই ককেশাস অঞ্চলের বাসিন্দারা অশ্বচালিত বাহনে স্পোকযুক্ত চাকা ব্যবহার করে। বাস্তবিকপক্ষে যুদ্ধে ব্যবহৃত রথে এ ধরনের চাকা তারা ব্যবহার করত। আর এখান থেকেই স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার গ্রিক উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে। চাকাযুক্ত বাহনের ব্যবহার গ্রিকসভ্যতা উন্মেষে সহায়তা করে। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দে কেল্টিকদের রথগুলোতে এমন চাকা ব্যবহার দেখা যায়, যার পরিধি বরাবর লোহার বেষ্টনী দেওয়া থাকত। যে কারণে এ ধরনের চাকাগুলো অনেক টেকসই হতো। স্পোকযুক্ত চাকা এভাবেই প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় ১৮৭০ সাল অবধি ব্যবহৃত হয়ে আসে। এরপর এ বছরই চাকায় নিউম্যাটিক টায়ার ব্যবহার করে উন্নতমানের যান তৈরি করা হয়। পুরোপুরিভাবে চাকার উদ্ভাবন শুধু পরিবহণ ব্যবস্থায় নয়, বরং প্রযুক্তির নানা দিকে নতুন নতুন যন্ত্র উদ্ভাবনে জরুরি ও তাৎপর্যবহ অবদান রাখে। চাকা ব্যবহার করে জলচক্র, গিয়ার, চরকা, ইত্যাদি যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়। ইদানীংকালের প্রপেলার, জেট ইঞ্জিন, জাইরোস্কোপ এবং টারবাইনের সবই চাকারই রূপান্তরিত রূপ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে