শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চাঁদের রহস্যময় দক্ষিণ মেরু

চাঁদের মেরুর বেশ কিছু গর্তে কখনো আলো পৌঁছায় না। তেমন গর্তকে 'অনন্ত অন্ধকারের গর্ত' বলা হয়। এমন পরিবেশ আর নিম্ন তাপমাত্রা থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন, সেখানে প্রচুর পরিমাণে বরফ জমা রয়েছে। আর এর অনেকটাই পানি থেকে তৈরি। কোটি কোটি বছর ধরে জমা হয়েছে এমন বরফ। এই বরফ হয় মাটির সঙ্গে মিশে আছে, না হয় চন্দ্রপৃষ্ঠে উন্মুক্ত অবস্থাতেই আছে। এই বরফ নভোচারীদের জন্য এক ধরনের সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
প্রদীপ সাহা
  ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

চাঁদের রহস্যময় স্থান হলো দক্ষিণ মেরু। চাঁদের এ দক্ষিণ মেরু দারুণ আকর্ষণীয়? এটি এমন এক জায়গা যেখানে মানুষের তৈরি কোনো কিছু আগে যায়নি। রোভার 'প্রজ্ঞান' তার মাদারশিপ ল্যান্ডার 'বিক্রম' থেকে নেমে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর চারপাশে অনুসন্ধান শুরু করে। হিমশীতল, ছড়ানো-ছিটানো গর্তে ভরা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করা এটি প্রথম মহাকাশ যান। ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে অ্যাপোলো মিশনগুলো প্রাথমিকভাবে চাঁদের বিষুবরেখা বা মাঝ বরাবর টার্গেট করেছিল। ভারতের চন্দ্রযান-৩ মিশন থেকে ল্যান্ডারটি চাঁদের দক্ষিণ মেরু থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবতরণ করে। এর দুদিন আগে রাশিয়ার লুনা-২৫ মহাকাশ যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। এরপরই ভারতের সফল অবতরণকে মানুষের চাঁদে যাওয়ার তৎপরতার প্রথম ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই দশকের শেষদিকে মানুষ চাঁদে বিচরণ করবে- এমন পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নাসার (মহাকাশ গবেষণা সংস্থা)। ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সবার নজর এখন চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দিকে। এর কারণ, সেখানে রহস্যঘেরা পরিবেশ সম্পর্কে অনুসন্ধান করা। চাঁদের ধুলোমাখা পথে 'প্রজ্ঞান' রোভারটি প্রতি সেকেন্ডে ১ সেন্টিমিটার (শূন্য দশমিক ৪ ইঞ্চি) পার করতে করতে এর মাদারশিপ থেকে বেশ কয়েক মিটার দূরে চলে এসেছে। পথে এর সেন্সর কিছুটা চাঁদের মাটি খুঁড়েও দেখেছে। তাতে তাপমাত্রা পার্থক্যের এক অদ্ভুত চিত্র উঠে এসেছে। যেখানে চন্দ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো উত্তপ্ত, সেখানে মাত্র ৮০ মিলিমিটার বা ৩ ইঞ্চির মতো নিচে তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রিতে নেমেছে। এটা বিজ্ঞানীদেরও অবাক করেছে। অবশ্য চাঁদের চরম তাপমাত্রা সম্পর্কে আগেই ধারণা দিয়েছে নাসা। এর নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখা বরাবর দিনের বেলা তাপমাত্রা ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো থাকে; আর রাতের বেলা তা মাইনাস ১৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যেতে পারে। মেরু অঞ্চলে এ তাপমাত্রা আরও কম হয়। যেমন উত্তর মেরুর একটি গর্তে মাইনাস ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যা সৌরজগতে পরিমাপযোগ্য তাপমাত্রার মধ্যে সর্বনিম্ন। মহাকাশ যানে থাকা যন্ত্রাংশের রাসায়নিক বিশ্লেষণ বলছে- চাঁদের মাটিতে সালফার, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন, টাইটানিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম এবং অক্সিজেনের উপস্থিতি রয়েছে। নাসার রোভার যান ২০২৪ সালের শেষদিকে তেমন একটি গহ্বরে ঢুকে অভিযান চালানোর কথা। 'ভাইপার' নামের সে অভিযানে যানটি হেডলাইটের আলো ফেলে রহস্য উন্মোচন করতে নামবে। সেই মিশনে বোঝা যাবে সেগুলো কী বরফের আস্ত আস্ত টুকরো, না-কি বালুর সঙ্গে মিশে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্রিস্টাল। অবশ্য এমন গহ্বরে ভাইপারের আগে 'মাইক্রো-নোভা হপার' নামে আমেরিকার আরেকটি অভিযান করার কথা। তবে ভাইপারের মতো এর শক্তিশালী যন্ত্রপাতি থাকবে না। যেমন মাটি খোঁড়ার সক্ষমতা। যদিও এটি লাফ দিয়ে তেমন গহ্বরে নামতে পারবে। এর ফলে ভেতরের একটা প্রাথমিক চিত্র পাওয়া যাবে। উত্তর-দক্ষিণ মেরু বরাবর যে মেরুরেখায় পৃথিবী ঘোরে তা ২৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি কাত হয়ে থাকে। তবে চাঁদের ক্ষেত্রে তা হয় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি। এর অর্থ চাঁদের মেরুর বেশ কিছু গর্তে কখনো আলো পৌঁছায় না। তেমন গর্তকে 'অনন্ত অন্ধকারের গর্ত' বলা হয়। এমন পরিবেশ আর নিম্ন তাপমাত্রা থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন, সেখানে প্রচুর পরিমাণে বরফ জমা রয়েছে। আর এর অনেকটাই পানি থেকে তৈরি। কোটি কোটি বছর ধরে জমা হয়েছে এমন বরফ। এই বরফ হয় মাটির সঙ্গে মিশে আছে, না হয় চন্দ্রপৃষ্ঠে উন্মুক্ত অবস্থাতেই আছে। এই বরফ নভোচারীদের জন্য এক ধরনের সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আশা করা হচ্ছে তা ভবিষ্যতে আরও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভিত্তি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বোল্ডার কলোরাডো ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী মার্গারেট ল্যান্ডিস বলেন, এর সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৯ সালে। সেই সময় নাসা পরীক্ষামূলকভাবে একটি খালি রকেটকে ইচ্ছে করে দক্ষিণ মেরুর তেমন একটি গর্তে ফেলে দেয়। সেই পর্যবেক্ষণ থেকে প্রমাণ মেলে, চাঁদে পানির বরফ থাকতে পারে। গত ২০২২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার নাসার এমস রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানী উইলিয়াম রিচ নাসার পুরনো সোফিয়া টেলিস্কোপ নিয়ে পেস্ননে করে চাঁদের পর্যবেক্ষণ করেন। বরফ বা পানির অস্তিত্ব থাকাটাই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর মূল আকর্ষণের জায়গা। চাঁদের অন্ধকার গর্তগুলোও বিশেষ কৌতূহল জাগানোর মতো। যেগুলোকে বলা হচ্ছে 'চিরস্থায়ী ছায়াচ্ছন্ন এলাকা'। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে উত্তর মেরুর চেয়ে অনেক বেশি গর্ত রয়েছে। এসব ছায়াচ্ছন্ন গর্তের তাপমাত্রা মাইনাস ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নামতে পারে। যে বরফ বা পানির অস্তিত্ব নিয়ে এত আগ্রহ, সেটি সত্যি অনেক বেশি হলে চাঁদে মানুষের বসতি স্থাপন ও সৌরজগতের আরও দূরে অনুসন্ধানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে। চাঁদের মাটি থেকে বরফ তুলে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন ভাঙা গেলে, তা রকেটের জ্বালানির মূল উপাদান অথবা মানুষের বসতির জন্য খাবার পানি ও অক্সিজেনের উৎস হতে পারে। চাঁদের সেসব জায়গায় বছরে ৯০ ভাগ পর্যন্ত আলোকিত থাকে। সেখানে মাটি থেকে অক্সিজেন বা অ্যালুমিনিয়াম প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ভালো সৌরশক্তি পাওয়া সম্ভব। মহাকাশের গভীরে ভ্রমণ বা চাঁদে বসবাস স্বপ্নের মতো মনে হলেও এটাকে খুব দূরের কোনো কল্পনা বলা যায় না। ২০২৫ সালে স্পেস এক্স-এ করে মানুষের চাঁদে অবতরণের পরিকল্পনা রয়েছে। চাঁদে পানির উৎস নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ কম নয়। সেই পানি আসতে পারে কোটি কোটি বছর আগের আগ্নেয়গিরি থেকে, উল্কাপিন্ড বা ধূমকেতু থেকে। এছাড়া চীনের রোভার চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে একটি বিশাল গর্তের প্রমাণ পেয়েছে যা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা আরও জানতে আগ্রহী। আরও যত জানা যাবে, মানবজাতি ততই সামনের দিকে এক ধাপ করে এগোতে থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে