মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

শরীরের কোথাও কেটে গেলে তা গজিয়ে উঠবে সহজে

বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কিংবা অসুখের কারণে কত মানুষেরই না কাটা পড়ছে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। চিকিৎসায় এসব ক্ষত অনেক সময় ভালো হলেও কিংবা আহত লোকটি সুস্থ হলেও তাকে বয়ে বেড়াতে হয় পঙ্গুত্বের অভিশাপ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বিজ্ঞানীরা শরীরের কাটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আবার নতুন করে গজিয়ে তোলার ব্যাপারে গবেষণা করছেন।
প্রদীপ সাহা
  ০২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শরীরের কোথাও কেটে গেলে তা গজিয়ে উঠবে সহজে

বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কিংবা অসুখের কারণে কত মানুষেরই না কাটা পড়ছে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। চিকিৎসায় এসব ক্ষত অনেক সময় ভালো হলেও কিংবা আহত লোকটি সুস্থ হলেও তাকে বয়ে বেড়াতে হয় পঙ্গুত্বের অভিশাপ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বিজ্ঞানীরা শরীরের কাটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আবার নতুন করে গজিয়ে তোলার ব্যাপারে গবেষণা করছেন। মেক্সিকোতে গিরগিটির মতো দেখতে প্রায় ২০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এক ধরনের লেজযুক্ত অদ্ভুত উভচর সরীসৃপ প্রাণী আছে। এর নাম 'আক্সোলোটল'

অর্থাৎ জলদৈত্য।

সবচেয়ে অদ্ভুত ও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এ প্রাণীর কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটা পড়লেও তা আবার সহজে গজিয়ে উঠতে পারে। শুধু তাই নয়, নিজ থেকে রক্তক্ষরণও বন্ধ হয়ে যায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। বিষয়টি গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কঠিন দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের চিকিৎসায় এ বিশেষ নৈপুণ্য কাজে লাগানো যায় কিনা, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তা-ভাবনা করছেন। জার্মানির হানোফার মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োরিজেনারেশন সেন্টারে বিজ্ঞানীরা অদ্ভুত প্রাণীটির প্রকৃতি প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা করছেন জোরালোভাবে। বায়োরিজেনারেশন সেন্টারের ঠান্ডা একটি ঘরে রাখা আছে অ্যাকুরিয়াম। এই অ্যাকুরিয়ামে পানির উষ্ণতা ১৬ ডিগ্রির বেশি নয়। কারণ এর চেয়ে বেশি গরম হলে সরীসৃপগুলো অসুস্থ হয়ে পড়বে।

গবেষক ক্রিস্টিনা আলমেলিং বলেন, বায়োরিজেনারেশন সেন্টারে শুধু গবেষণাই নয়, জীবগুলোর সুরক্ষা ও প্রজননের দিকেও তারা লক্ষ্য রাখছেন। বিশেষ করে আক্সোলোটল নিয়েই এখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এদের বংশ বিস্তারের বিষয়টিও ভালোভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। দেখা গেছে, এগুলোকে সহজেই লালন-পালন করা যায়। তবে সমস্যা হলো, পরিবেশ দূষণের কারণে উৎপত্তিস্থল মেক্সিকোতে সরীসৃপগুলোকে সচরাচর দেখা যায় না। বিজ্ঞানের দিক দিয়ে আকর্ষণীয় না হলে হয়তো এ প্রাণীগুলো একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।

হানোফারের গবেষণাগারে মোট ১২০টি আক্সোলোটল রয়েছে। অলস ভঙ্গিতে অ্যাকুরিয়ামের এদিক-সেদিক অবস্'ান করছে এ প্রাণীগুলো। দেখলে মনেই হবে না যে, এদের এমন অসাধারণ গুণাগুণ রয়েছে। গবেষক ক্রিস্টিনা আলমেলিং আরও বলেন, অ্যাম্ফিবিয়াস আক্সোলোটল পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে এক দারুণ বিস্ময়! কোনো দুঘর্টনায় কিংবা অন্য কোনো জন্তুর কামড়ে শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটা পড়লে আবার তা এদের শরীরে গজিয়ে ওঠে। আর ঠিক এ বিষয়টিই তাদের গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অঙ্গচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা দেখার জন্য বিজ্ঞানীরা প্রাণীটির পরীক্ষামূলক অপারেশনও করেন।

আক্সোলোটলকে চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে অচেতন করে এর একটি পা অপারেশন করে ছেদ করা হয়। তারা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন, কাটার ক্ষতটাতে কোনো ওষুধ লাগানোর দরকার হয়নি।

কয়েক মূহূর্তের মধ্যেই রক্তপাত বন্ধ হয়ে গেছে। আর অত্যন্ত দ্রম্নত ঘটে গেছে এসব অবিশ্বাস্য এবং অলৌকিক ঘটনা। তাদের কাছে বারবারই মনে হয়েছে, এ প্রাণীদের কাছে অঙ্গচ্ছেদ যেন একটি অতি সাধারণ ব্যাপার!

বিয়র্ন মেনগার ডক্টরেটের থিসিসের জন্য আক্সোলোটল-এর ওপর তিনশ' বারের মতো এ ধরনের অপারেশন করেছেন। প্রত্যেকবারই তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন যে, সেকেন্ডের মধ্যেই রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায় এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাংসের তন্তু দিয়ে এর ঘা'টাও শুকিয়ে যায়। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের তুলনায় এদের ব্যাপারটা ঘটে ভিন্নভাবে। ঘা'টা শুকানোর সঙ্গে সঙ্গে এর নিচের অংশও ভালো হয়ে যায়। কয়েক দিনের মধ্যে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং কেটে যাওয়া পা'টা আবার বেড়ে উঠতে থাকে। আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নতুন পা সম্পূর্ণ আকার ধারণ করে। এ প্রক্রিয়াটি কীভাবে ঘটে তা জানতেই বিজ্ঞানীরা এখন বেশি উৎসুক হয়ে পড়েছেন। কোনো কোনো মাছের মধ্যেও এ ধরনের পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়া দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, চারপায়ী মেরুদন্ডযুক্ত

প্রাণী হিসেবে আক্সোলোটল জিনের দিক দিয়ে মানুষের কাছাকাছি। তাই এ উভচর প্রাণীটির প্রকৃতি প্রদত্ত বিশেষ দক্ষতা মানুষের ক্ষেত্রেও কাজে লাগানো যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা ভীষণ আশাবাদী।

পস্নাস্টিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. বিয়র্ন মেনগার বলেছেন, মানুষের চামড়া বা হাড়ে বড় রকমের আঘাত বা খুঁত হলে নিজের শরীরের কোষ প্রতিস্থাপন করেও অনেক সময় ভালো হয় না। তাই চিকিৎসকরা এমন এক পদ্ধতির খোঁজ করছেন, যার সাহায্যে পুনর্গঠন প্রক্রিয়াটি সহজ হয়। এক্ষেত্রে আক্সোলোটল নামের উভচর প্রাণীর প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতাটা কাজে লাগাতে চান তারা। তিনি মনে করেন, তাদের এ গবেষণা সফল হলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে

এক বিশাল দ্বার খুলে যাবে। এ গবেষণার আলোকে বিজ্ঞানীরা এমন এক ওষুধ তৈরি করতে চান, যার মাধ্যমে দুর্ঘটনায় শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটা গেলে আক্সোলোটল-এর মতোই দ্রম্নত আরোগ্য লাভ সম্ভব হয়। তাদের স্বপ্ন- আক্সোলোটল-এর মতো মানুষের শরীরেও পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়ার শক্তিটা এমনভাবে বৃদ্ধি পাক, যাতে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনরুজ্জীবিত হতে পারে বা গজিয়ে উঠতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে