বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জুটি

জাহাঙ্গীর বিপস্নব
  ২২ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০
আবদুর রাজ্জাক-সারাহ বেগম কবরী

রাজ্জাক-কবরী। বাংলা চলচ্চিত্রের অবিচ্ছেদ্য দুটি নাম। কিন্তু নাম আলাদা আলাদা হলেও ঢাকাই চলচ্চিত্রের দর্শকের মুখে বেশিরভাগ সময়েই একসঙ্গে উচ্চারিত হতো নাম দুটি। সেই সত্তর দর্শকের সোনালি যুগ থেকে আজ অবধি রাজ্জাকের নামের সঙ্গে কবরীর নামটিও যেন সিনেমাপ্রেমী মানুষের কাছে অন্য রকম এক আকর্ষণ, অন্য রকম এক অনুভূতি। নিজের নামের আগে রাজ্জাকের নাম জুড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেক সময় ভীষণ রাগও হতো কবরীর। কিন্তু এসব রাগ-অনুরাগ কিংবা মান-অভিমান যাই হোক না কেন- এদেশের কোটি কোটি দর্শকের কাছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ হয়েই থাকবেন এ জুটি। মুম্বাইয়ের দিলীপ কুমার-মধুবালা, কলকাতার উত্তম-সুচিত্রা বা লাহোরের নাদিম-শবনমরা যেমন রুপালি পর্দায় বাস্তব প্রেমের মিথ তৈরি করেছেন তেমনি ঢাকার সিনেমায় সাদাকালো যুগ রঙিন করে তুলেছিল রাজ্জাক-কবরীর প্রেম। সেই সাদাকালো যুগ থেকেই রোমান্টিক ছবির অপ্রতিদ্বন্দ্বী জুটি হিসেবে এক নামে পরিচিতি পেয়ে আসছেন রাজ্জাক-কবরী। অনেকের কাছে চিরসবুজ জুটি হিসেবেও বিবেচিত তারা। বাংলাদেশি সিনেমা জগতের উজ্জ্বল এ নক্ষত্র জুটি একের পর এক সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছে দর্শককে। রাজ্জাক-কবরী মানেই পয়সা উসুল- এমনই চিত্র ছিল তৎকালীন ঢালিউডে।

রাজ্জাক-কবরী জুটি নিয়ে বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে উন্মাদনা আজও অমলিন। তখন পাকিস্তানি আক্রমণ ও মুক্তিযুদ্ধের দামামার মাঝে পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ যেন শান্তি খুঁজে পেতেন রাজ্জাক-কবরীর রোমান্টিক ছবি দেখে। ঠিক যেভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর পঞ্চাশের দশকে উত্তম-সুচিত্রা জুটি এক প্রেমের রেশ বইয়ে দিয়েছিল ওপার বাংলার মানুষদের মনে। আবার একইরকম যুদ্ধ, অনিশ্চয়তা, বহু রক্তধারার মাঝেও পূর্ববাংলার মানুষ শান্তি পেত রাজ্জাক-কবরীর ছবি দেখে। দুটি জুটির ক্ষেত্রেই অস্থির সামাজিক পরিস্থিতি থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে তাদের ছবিগুলো দর্শক আপন করে নিয়েছিল। যদিও উত্তম-সুচিত্রা দুই বাংলার কাছেই জনপ্রিয়। যেটা রাজ্জাক-কবরী জুটির ক্ষেত্রে ঘটেনি। কারণ বাংলাদেশি ছবিগুলো কলকাতায় সেভাবে সম্প্রচার হয়নি। তাই এ জুটির রেশ পায়নি পশ্চিমবাংলার মানুষ।

একটু অন্যরকম শোনা গেলেও বলতে হয়, রাজ্জাক-কবরী জুটি অনেকটাই ছিল উত্তম-সুচিত্রা জুটির থেকে প্রভাবিত, কিন্তু রাজ্জাক-কবরীর ছবিগুলো উত্তম-সুচিত্রার ছবির মানকে অতিক্রম করতে পারেনি। এর দায়িত্ব অবশ্য বাংলাদেশের পরিচালকদের। তবে কলকাতার মানুষের কাছে কবরী শুধুমাত্রই আর্ট ফিল্মের নায়িকা হয়ে রয়ে গেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের দর্শক দেখেছেন কবরী বাণিজ্যিক রোমান্টিক ছবিতেও কতটা সফল। একজন অভিনেত্রীর নিজস্বতা এখানেই। আবার রাজ্জাক হার্ডকোর কর্মাশিয়াল কলকাতার ছবিতে পিতার রোলে ছিলেন আইকনিক। 'বাবা কেন চাকর', 'অন্নদাতা'র মতো ছবিতে। তরুণ রাজ্জাক কলকাতায় ক্যারিয়ার জমাতে পারেননি। রাজ্জাক কিন্তু আদতে কলকাতার নাকতলার মানুষ। কৈশোরেই বাবা-মাকে পরপর হারান। রাজ্জাক পড়তেন নাকতলার খানপুর হাইস্কুলে। আজও রমরমিয়ে চলছে সেই স্কুল। কিন্তু আমরা ক'জন খোঁজ রেখেছি নায়করাজ রাজ্জাক ঐ স্কুলে দীর্ঘকাল পড়েছেন! এমনকি এই স্কুলের নাটকে অভিনয় করেই রাজ্জাকের অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। কলকাতার নাট্যদলে যোগ দেন, পেয়েছিলেন মহান অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের সান্নিধ্য। কিন্তু সেসময় কলকাতায় উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, বিকাশ রায়ের যুগ। রাজ্জাকের এখানে টিকে থাকা কঠিন ছিল। তাই ঢাকাই ছবিতে অভিনয় করতেন চলে আসেন বাংলাদেশে। সেখানেই রাজ্জাকের ভাগ্য খুলে যায়।

কবরীকে কিন্তু রাজ্জাকের মতো এত লড়াই করতে হয়নি। কবরী আদতে হিন্দু বাড়ির মেয়ে। আসল নাম মিনা পাল। ছবিতে এসে বিয়ের পর মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে। পিতা শ্রীকৃষ্ণ দাস পালের ইচ্ছাতেই মেয়ের সিনেমায় আসা। ক্লাস সিক্সে পড়া মাত্র ১৩ বছরের এক কিশোরীকে নায়িকা হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেন চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত তার পরিচালিত প্রথম 'সুতরাং' ছবিতে। মিনা নাম বদলে কবরী করে দেন পরিচালক। ১৯৬৪ সালের 'সুতরাং' ছবিতে 'পরানে দোলা দিলো এই কোন ভোমরা' গানের মাধ্যমে কবরী দর্শক মনে 'মিষ্টি মেয়ে' নামে জায়গা করে নেন। মিষ্টি মেয়ে উপাধি কবরীর থেকে আর সরেনি। এরপরই কবরী সুযোগ পেলেন তার জীবনের সেরা চলচ্চিত্র ঋত্বিক কুমার ঘটকের হাত ধরে 'তিতাস একটি নদীর নাম' ছবিতে। যে ছবি দিয়ে এককভাবে নায়িকা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন কবরী। তার মুখ সারা বিশ্বের দরবারের আঙিনায় পৌঁছে গেল। যদিও কলকাতার বাণিজ্যিক ছবিতে আর সে অর্থে সুযোগ পেলেন না কবরী।

কিন্তু কবরী-রাজ্জাক জুটি তৈরি হয়ে যেন ঢালিউডের ছবিতে এক যুগের সূচনা করল। রাজ্জাক সাহেব বলেছেন 'কবরী এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।' অর্থাৎ রাজ্জাকের হিট ছবির তালিকা কবরীকে পেয়ে বেড়ে গেল অনেক। যদিও দুজন আলাদা নায়ক নায়িকার সঙ্গেও হিট ছবি করেছেন কিন্তু তাদের জুটি ছাপিয়ে গিয়েছিল সবাইকে।

একসঙ্গে অসংখ্য রোমান্টিক ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নায়ক-নায়িকার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাজ্জাক-কবরীর বেলাতেও কী তেমন কিছু ঘটেছিল? আমরা কিংবা সাধারণ দর্শক জানতাম রাজ্জাক এবং কবরীর মাঝে পারিবারিক ও চমৎকার একটা বন্ধুতা ছিল। কিন্তু এ নিয়ে কবরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'আমাদের প্রেম ছিল। প্রেম ছাড়া কি অমন ভালো প্রেমের ছবি করা যায়! অনেক সিনে ম্যাগাজিনে আমাদের নিয়ে গসিপে ছেয়ে যায়। কিন্তু আমরা প্রেম করিনি, প্রেম হয়ে গেছে। আমার বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সে। প্রেম করার সুযোগ ছিল না, অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে, প্রেম কি বুঝতামও না। কিন্তু রাজ্জাকের সঙ্গে যখন পর্দায় অভিনয় করতাম, তখন এক ধরনের রোমান্স অনুভব করতাম। কিন্তু সেই প্রেম কাজ অবধি ছিল। ব্যক্তিগত স্তরে প্রেম যে ছিল না- তা অস্বীকার করব না, কিন্তু আমরা নিজেদের সংসার ভেঙে বিয়ে করব এটা কখনও ভাবিনি। তাই আমাদের প্রেম এত সুন্দর সসম্মানে রয়ে গেছে।'

এত রোমান্স, দু'জনের প্রতি এত টান, দর্শকের এত ভালোবাসা থাকার পরও মাঝখানে ২০ বছরেরও বেশি সময় একসঙ্গে ছবি করেননি রাজ্জাক-কবরী জুটি। ঠিক যেন উত্তম সুচিত্রার প্রেমের মানচিত্র আঁকা হয়েছিল রাজ্জাক-কবরীর জীবনেও। যদি এই কুড়ি বছরে তারা একসঙ্গে অভিনয় করতেন- তাহলে তাদের ছবির সংখ্যা কত হতো, হিসাব করেছেন কেউ? কিন্তু কেন এত বছর একসঙ্গে অভিনয় করেননি দু'জনে? এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে। রাজ্জাক বলেছেন এক কথা। অন্যদিকে কবরী বলেছেন অন্যকথা। মূল বিষয় হলো- একটা ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে তাদের মধ্যে মান-অভিমান তৈরি হয়। সেই থেকে আর একসঙ্গে অভিনয় করেননি তারা। শুধু তাই নয়, কবরী তো রাজ্জাকের নামই শুনতে পারতেন না। এমনকি কোনো অনুষ্ঠানে রাজ্জাক থাকলে, সেই অনুষ্ঠানই বর্জন করতেন কবরী। তারপর ইস্পাহানি আরিফ জাহান পরিচালিত 'আমাদের সন্তান' ছবিতে বাবা-মায়ের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে দীর্ঘ ২০ বছরের মান অভিমান ও রাগ অনুরাগ দূর হয় তাদের।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে