সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

মঞ্চসম্রাজ্ঞীর যাপিত জীবন

কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি অভিনেত্রী হবেন। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ের জন্য সেটাই ছিল স্বাভাবিক। সেই পরিবারের ভেতর থেকেই দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে হয়ে ওঠেন নাট্যকর্মী- এরপর দু্যতি ছড়িয়ে নামের সঙ্গে যুক্ত করেন 'মঞ্চসম্রাজ্ঞী' তকমা। মঞ্চের পাশাপাশি টিভি নাটকেও অভিনয়ের শুভ্রতা ছড়িয়েছেন তিনি। বলা হচ্ছে, নাটকের জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের কথা। অভিনয়ের সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখলেও এখন অভিনয় থেকে অনেকটা দূরে তিনি। সদ্য আশিতে পা দেওয়া বরেণ্য এই তারকা এখন কেমন আছেন? কোথায় আছেন? কীভাবে কাটছে তার চলমান সময়- এ রকম নানা কৌতূহল মেটাতে এই অভিনেত্রীর মুখোমুখি হয় তারার মেলা। তার সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন মাসুদুর রহমান
মাসুদুর রহমান
  ২২ জুন ২০২৩, ০০:০০
ফেরদৌসী মজুমদার

আষাঢ়ের মধ্য দুপুর। আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ছোটাছুটি- শেষে ঝুম বৃষ্টি। প্রকৃতির প্রাণচঞ্চল্যতায় অনেকটা শান্ত-স্থবিরতা বিরাজ করছে নগরীর পরতে পরতে। এমনই পরিবেশে কড়া নাড়া হয় ফেরদৌসী মজুমদারের মুঠোফোনে। প্রথমবার সাড়া না পেয়ে ব্যক্তিগত ফোনে চেষ্টা করতেই জবাব মেলে ও প্রান্ত থেকে। বয়সের দৌড়ে অনেকগুলো বসন্ত পার করে এলে হাঁপিয়ে ওঠেননি তিনি। ৮০ বছর বয়সেও নিজ ক্যারিয়ারের মতো দৃঢ় তার স্পষ্ট শব্দ চয়ন। কুশল বিনিময় শেষ করেই জানালেন এই বয়সে শারীরিকভাবে অনেকটাই ভালো আছেন তিনি। মানসিক শক্তিটা আরও সবল। 'আপনার আরও দীর্ঘায়ু কামনা করছি' বলতেই এই কিংবদন্তি বলে উঠলেন, 'না না। জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। জন্ম যখন হয়েছে মৃতু্য অবধারিত। এখন আর দীর্ঘায়ু আশা করি না। চাই জীবনের শেষ পর্যন্ত যেন সচল হয়ে কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে পারি। অচল হয়ে বেঁচে থাকা অর্থহীন। অচল হয়ে যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে না হয়, সেই দোয়া করেন।'

গত ১৮ জুন জীবনবসন্তের ৮০ বছর পূর্ণ করলেন এই বর্ষীয়ান অভিনেত্রী। বরাবরের মতো এবারও তার জন্মদিন ঘিরে দেশের গণমাধ্যমগুলো বেশ তৎপর ছিল। তিনি নিজেও উৎফুলস্ন ছিলেন জন্মদিনে। আর থাকবেনই না বা কেন। কারণ, এদিন শুধু তারই জন্মদিন নয়, তার মেয়ে ত্রপা মজুমদারেরও জন্মদিন। মা-মেয়ের একই তারিখে জন্মদিন হওয়াতে বিষয়টা খুব উপভোগ করেন তিনি।

এবার এই শুভ দিনটা কীভাবে কাটলো জানতে চাইলে ফেরদৌসী বলেন, 'খুব ভালোভাবে কেটেছে। আমার তো আসলে বন্ধুবান্ধব অনেক। আত্মীয়স্বজনও কম নয়। অনেক বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন থাকলে যা হয়। শুভেচ্ছা জানান, অনেকে বাসায় আসেন। ফুলে ফুলে ভরে যায় বাসা। বড় আয়োজনে না হলেও একটা আয়োজন হয়ে যায় বাসাতেই। এবারও তাই হয়েছে। সারাটা দিন খুব ভালোভাবে কেটে গেছে।' সবার জীবনে চাওয়া-পাওয়ার অনেক হিসেব থাকে। জীবন সায়াহ্নে এসে কেউ কেউ নানাভাবে জীবনের উপলব্ধি ব্যক্ত করেন। ৮০ বছরের এই দীর্ঘ সময়ে জীবনের এক দারুণ উপলব্ধির কথা বললেন ফেরদৌসী মজুমদার। তিনি বলেন, 'দীর্ঘ এই জীবনে আমার মধ্যে হতাশা নেই, অপ্রাপ্তি নেই। বাপের বাড়িতে অনেক বাধানিষেধে থাকতে হতো। বিয়ের পর মনে হয়েছিল, শ্বশুরবাড়িতে বাধা আসবে কিন্তু আসেনি, স্বাধীনতা পেয়েছি। আবার সন্তান জন্মের পর মনে হয়েছিল, হয়তো মেয়ের জন্য বাধা পেতে হবে। মেয়ে কোনো কিছু অপছন্দ করলে থেমে যেতে হবে। দীর্ঘ ৫০ বছরে তেমনটি হয়নি। জীবনটা আমাকে অবাক করে।'

ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয় জীবন শুরু হয় মঞ্চ দিয়ে। তার বড় ভাই মুনীর চৌধুরীর হাত ধরে। টিভিতেও ভাইয়ের নাটক দিয়েই আত্মপ্রকাশ করেন ফেরদৌসী। এরপর অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ইতিহাসের প্রথম নাটকেও ছিলেন তিনি। বলেন, 'সময়টা ছিল একেবারে অন্যরকম। পুরো একমাস অনুশীলন করেছিলাম। ওই সময় তিনটি ক্যামেরা ব্যবহার করা হতো। ফলে আমাদের ছিল অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা। খুব যত্ন নিয়ে আমরা কাজটি করেছিলাম।'

ফেরদৌসী মজুমদার নাট্যজগতে সব চেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন প্রয়াত নাট্যজন আব্দুলস্নাহ আল মামুনের কাছ থেকে। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনিই তাকে সফলতার পথ দেখিয়েছেন। ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, 'মামুন ভাইয়ের (আব্দুলস্নাহ আল মানুন) সঙ্গে আমার দীর্ঘ ৪৭ বছরের বন্ধুত্ব। আমি তো কিছুই ছিলাম না। উনি আমাকে গড়ে তুলেছেন। উনি আমাকে হাত ধরে শিখিয়েছেন, অভিনয়ের প্রতিটি কাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন, বুঝিয়েছেন মঞ্চের খুঁটিনাটি। 'কোকিলারা' নাটকটি আমার জন্য উনি লিখেছিলেন। তিনি আমাদের জন্য যা করেছেন তা ভোলার মতো নয়। নিজেতো অভিনয় পারতেনই; নাটক নির্মাণ, চিত্রনাট্য তৈরি- নাটকের সবকিছু নিজেই করতেন। বুঝতেন কাকে দিয়ে কি হয়। আমার কর্মজীবন নিয়ে ৮৬ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র 'জীবন ও অভিনয়' নির্মিত হয়েছে। এটাও মানুন ভাইয়ের কীর্তি। আমার ১০টি নাটকের খন্ড খন্ড অভিয়ের অংশ রয়েছে এতে। বেঁচে থাকতে কোনো অভিনেতা অভিনেত্রীর ভাগ্যে সহজে এমন জোটে না'।

ক্যারিয়ারে অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন ফেরদৌসী। শহিদুলস্নাহ কায়সারের 'সংসপ্তক' নাটকে হুরমতি চরিত্রটি আজও দর্শকের হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। এক সময় টিভি নাটকে সরব উপিস্থিতি থাকলেও দীর্ঘদিন নেই টিভি নাটকে। মানহীন গল্প ও পছন্দসই চরিত্র না হওয়ায় এখন অভিনয় করেন না টিভি নাটকে।

সর্বশেষ টেলিভিশন নাটকের জন্য কবে দাঁড়িয়েছিলেন ক্যামেরার সামনে তাও মনে নেই এই অভিনেত্রীর। তিনি বলেন, 'এখন টিভি নাটক করি না। সর্বশেষ কোন নাটকে অভিনয় করেছিলাম তাও মনে নেই। টিভি নাটকে অভিনয় করার আগের সেই ভালো পরিবেশটা হারিয়ে গেছে। আগের শিল্পীদের অনেকেই এখন নেই। এখনকার নাটকের গল্প ভালো লাগে না। ভাষার ব্যবহার একেবারে মানহীন। এসব নানা কারণে টিভি নাটকে অভিনয় করা হয় না।'

মানহীন গল্প, যাচ্ছে তাই ভাষার ব্যবহার, দুর্বল অভিনয়সহ নানা কারণে টিভি নাটকও দেখেন না বলে জানান এই উজ্জ্বল নক্ষত্র। বর্তমানের টিভি নাটক নিয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের নাটক কিন্তু ভারতে ওরা খুবই পছন্দ করে। ওরা আমাদের নাটক দেখার সুযোগ পায় না। আর এখন তো অজস্র টিভি চ্যানেল। মিডিয়ার বিস্তার বেশি। অসংখ্য নাটক তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। এ কারণে মানসম্মত নাটক এখন হচ্ছে না। অনেক দিক থেকেই নাটকের মান কমতির দিকে। নাটকের ভাষার মান এত নেমে গেছে- যা সহ্য করার পর্যায়ে নেই।'

বর্তমান টিভি নাটক নিয়ে তার ক্ষোভ-আক্ষেপ থাকলেও মঞ্চ নাটক নিয়ে তার ভালোবাসার কোনো ঘাটতি হয়নি, বরং বেড়েছে অনেক। তাই তো মঞ্চে এখনো সরব এই অভিনেত্রী। সুযোগ পেলে এখনো মঞ্চ কাপান সংলাপ আর দুর্দান্ত অভিনয়ে। মঞ্চে ফেরদৌসী সর্বশেষ অভিনয় করেন নাট্যদল থিয়েটারের ৪৮তম প্রযোজনা 'লাভ লেটার' নাটকে। এর নির্দেশনায় রয়েছেন ত্রপা মজুমদার। এতে ফেরদৌসীর সঙ্গে অভিনয় করেছেন রামেন্দু মজুমদার। নতুন গল্পে মঞ্চে নতুন করে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন পারদর্শী অভিনেত্রী ফেরদৌসী। আগামী ২৩ ও ২৪ জুন নাটকটি আবার প্রদর্শনী হবে। এই বয়সে এসেও মঞ্চে অভিনয় করছেন। এই শক্তির উৎস নিয়ে ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, 'অভিনয় করার জন্য প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি, আর দর্শকের ভালোবাসা। আমি যতদিন বাঁচব, অভিনয় করে যেতে চাই। দর্শক যতদিন আমার অভিনয় ভালোবাসবেন, ততদিনই অভিনয় করে যেতে চাই। এখন শরীরের জোর পাই না। এজন্য হেঁটে-চলে অভিনয়টা করতে পারি না। 'লাভ লেটার' যারা দেখেছেন, তারা জানেন- এই নাটকেও আমি বসে বসেই অভিনয় করি। আমার সহশিল্পী থাকেন রামেন্দু মজুমদার এবং আরও কয়েকজন।'

অভিনয়ের বাইরে এই অভিনেত্রী ব্যস্ত থাকেন পরিবার ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে। তবে অভিনয়ই তার ধ্যান-খেল। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটকে কাজ করেছেন ফেরদৌসী। নিজেকে নিয়ে গেছেন কিংবদন্তি পর্যায়ে। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ অর্জন করেছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মানা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে