শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যায় স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের শঙ্কা

পানি নামার সঙ্গে পালস্না দিয়ে রোগব্যাধি বাড়ছে করোনা সংক্রমণও মারাত্মক রূপ নিতে পারে পুষ্টি ঘাটতিসহ নানা ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা নাজুক অবস্থার কথা স্বীকার করলেন মন্ত্রীও
সাখাওয়াত হোসেন
  ২২ জুন ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ২২ জুন ২০২২, ১০:০০

পানিবাহিত বিভিন্ন সংক্রামক রোগসহ নানা কারণে বন্যাপীড়িত এলাকায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বিশেষ করে শিশুরা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার বেশকিছু জায়গায় বন্যার পানি কমতে শুরু করার পর সেখানে রোগব্যাধি বাড়ছে। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ফুড পয়জনিং, হেপাটাইটিস এবং খোসপাঁচড়া, ফাঙ্গাল ইনফেকশন, প্যারনাইকিয়া ও স্ক্যাবিস জাতীয় নানা চর্মরোগের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানুষ গাদাগাদি করে থাকার কারণে অনেকে শ্বাসনালির প্রদাহ, ফ্লু ও হাঁপানিতে আক্রান্ত হচ্ছে। করোনার ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতিতে বন্যার্ত মানুষের গাদাগাদি অবস্থানে এ-সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থা জোরদার করা না গেলে দেশের বন্যাকবলিত প্রতিটি জেলাতেই ভয়াবহ স্বাস্থ্যবিপর্যয় ঘটতে পারে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে পালস্না দিয়ে রোগব্যাধি বাড়বে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সুযোগ না থাকায় বাড়তে পারে করোনা। এ সময় মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ মারাত্মক রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে যেসব এলাকার সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই সেখানে জলাবদ্ধতার কারণে স্বাস্থ্যসমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। দুধসহ অন্যান্য শিশুখাদ্যের সংকটে শিশুর মারাত্মক পুষ্টি ঘাটতি দেখা দেবে। মায়ের অসুস্থতা, ত্রাণের জন্য ছোটাছুটি এবং পুরুষহীন পরিবারের নারীদের ঘর-বাড়ি পুনর্বাসনের ব্যস্ততায় শিশুর নিয়মিত পরিচর্যা ব্যাহত হবে। এতেও নবজাতকসহ নানা বয়েসি শিশুর স্বাস্থ্যবিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. গোবিন্দ চন্দ্র রায় বলেন, অনেকেই নদীর আশপাশে খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করে। মানুষের এ পয়োবর্জ্য এবং ওই এলাকার বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা মিলে জলাশয়ের পানি দূষিত হয়ে পড়ে। লোকজন তখন যদি এসব জলাশয়ের পানি বিশুদ্ধ না করে পান করে, খাবারের কাজে ব্যবহার কিংবা থালাবাসন ধোয়া, কাপড় কাচা ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করে, তখন ডায়রিয়া বা পানিবাহিত রোগবালাই হতে পারে। দেশের সব জায়গায় পানিবাহিত রোগ একসঙ্গে ছড়ায় না। একই সঙ্গে সব মানুষ রোগে আক্রান্তও হয় না। ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটুকু, তার শরীরে কতগুলো জীবাণু প্রবেশ করল এবং সে কী ধরনের পরিবেশে থাকে, রোগ হওয়ার হার এসবের ওপর নির্ভর করে। শরীর যদি এ তিনটির ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারে, তখন সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডায়রিয়া মূলত পানিবাহিত রোগ। খাবারের মাধ্যমে এ জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। মূলত বন্যাকালীন দূষিত পানি পান আর অপরিচ্ছন্নতার কারণেই রোগবালাই বেশি হয়। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত এলাকার জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় নানা তৎপরতা শুরুর দাবি করা হলেও বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অভিযোগ তুলেছেন। তাদের দাবি, চিকিৎসাসেবা দূরে থাক, ভয়াবহ এই দুঃসময়ে সামান্য পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও ওরস্যালাইনও মিলছে না। ত্রাণের বস্তায় চিড়া, মুড়ি, গুড় ও খেজুরসহ বিভিন্ন শুকনা খাবার দেওয়া হলেও এসব পণ্য নেই। দুধসহ অন্যান্য শিশুখাদ্যও দেওয়া হচ্ছে না। ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিমেরও কোথাও দেখা মেলেনি। বিদু্যৎ সংযোগ না থাকায় বেশিরভাগ হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থাও এখন নাজুক। অধিকাংশ হাসপাতালে জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়নি। চিকিৎসা সংকটের কথা খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার কারণে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে পানি ঢুকে যাওয়া এবং রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় রোগীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছে। বন্যা দুর্গতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য এরইমধ্যে ১৪০টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এ টিম বন্যাকবলিত জেলা-উপজেলাগুলোতে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দেবে। তবে ১৮ জুন তিনি এ দাবি করলেও দু'দিন পর বলেন, 'বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ২০০ মেডিকেল টিম কাজ করছে। যদিও এটা সত্যি, ভাসমান চিকিৎসাকেন্দ্র করার মতো আমাদের কোনো উপকরণ নেই। দেশে প্রতিবছর বন্যা হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কোনো হেলিকপ্টার ও পানিতে চলার অ্যাম্বুলেন্সের মতো কোনো পরিবহণ নেই।' স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দাবি, বানভাসি মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় ইমার্জেন্সি কন্ট্রোল রুম চালু এবং পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে একটি সেন্ট্রাল মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিন সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ডকে সিলেট পাঠানো হয়েছে। তারা সরেজমিনে বন্যার সার্বিক অবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। ঢাকা থেকে যাওয়া মেডিকেল টিম বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে পরবর্তীতে করণীয় নিয়ে পরামর্শ দেবে। বন্যার্ত এলাকায় বর্তমানে কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে এ প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডাক্তার আহমেদুল কবির জানান, এখন স্বাস্থ্যসেবা কীভাবে দেওয়া হচ্ছে এটার চেয়ে বেশি জরুরি হলো মানুষ ডুবে মরছে, তাদের জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার করা। আসার মতো কোনো উপায় না থাকায় মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে আসছে না। তবে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, বন্যা-পরবর্তী ডিজাস্টার হবে, সেটির জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের যে ডিজাস্টার টিম কাজ করছে, তাদের পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটিকসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ দেওয়া হয়েছে যাতে ইমিডিয়েট ক্রাইসিস ম্যানেজ করা যায়। চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে কী ধরনের স্বাস্থ্যবিপর্যয় ঘটতে পারে তা জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার লেলিন চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, হেপাটাইটিস এ ধরনের রোগ বাড়বে। এছাড়া চর্ম রোগ ও নিউমোনিয়া বৃদ্ধি পাবে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ফুড পয়জনিং দেখা দেবে। আমরা মনে করি, যেসব এলাকায় বন্যার পানি কমছে সেখানে দ্রম্নত স্বাস্থ্যসবা জোরদার করাই জরুরি। দেশে করোনা বাড়ছে, তাই বন্যাকবলিত যেসব এলাকায় করোনার টিকা দেওয়া হয়নি, সেখানে টিকা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাসুদা খাতুন বলেন, এই সময়ে যে কটি চর্মরোগ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, তার মধ্যে ছত্রাকজনিত চর্মরোগ অন্যতম। এ সমস্যা এড়াতে হলে গায়ে ভেজা কাপড় না রাখা উচিত। এ সময়ে ছত্রাকজনিত দাদ, ছুলি ও ক্যানডিডিয়াসিস হতে পারে। এদের মধ্যে ছুলির কারণে ত্বক দেখতে সাদা হয়। তাই অনেকেই আবার একে শ্বেতী ভাবতেও শুরু করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শ্বেতীর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সাবধানতা অবলম্বন করলে এই সমস্যা থেকে সহজেই পরিত্রাণ পাওয়া যায়। সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুবই স্বল্প সংখ্যক বন্যার্ত মানুষ এখন পর্যন্ত ত্রাণ পেয়েছে। এতে চিড়া, চাল, ডালসহ কিছু খাবার থাকলেও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ওরস্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা অন্য কোনো ধরনের ওষুধ নেই। এসব এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষ পূর্ণ ডোজ করোনার ভ্যাকসিন পায়নি। মাস্ক, স্যানিটাইজার সংগ্রহ ও ব্যবহার বন্যার্তদের কাছে এখন অনেকটাই দুঃস্বপ্ন। তারা জানান, বানের পানি কমলেও এখনো বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে ডুবে আছে। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় রান্না ও পানি ফোটানোর পর্যাপ্ত সুযোগও পাচ্ছে না তারা। খাবার পানি বিশুদ্ধ করার জন্য এ সময় প্রয়োজন বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট। কিছু এলাকায় তা দেওয়া হলেও চাহিদার তুলনাই খুবই অপ্রতুল। মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এ সময় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ তৎপর থাকার কথা থাকলেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। চিকিৎসকরাও এখনো তোড়জোড়ভাবে মাঠে নামেননি। বন্যার্ত এলাকার সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানির হাহাকার শুনে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এগিয়ে আসার কথা। অথচ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপস্থিতি শুধু সরকারি ওয়েবসাইট আর গৎবাঁধা কাজে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে