শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধ সোচ্চার হওয়া রমজানের শিক্ষা

আবছার তৈয়বী (আবুধাবি থেকে)
  ১৭ মার্চ ২০২৫, ১৩:৫৮
অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধ সোচ্চার হওয়া রমজানের শিক্ষা
ছবি: সংগৃহীত

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজান অন্য যে কোন মাসের চেয়ে মাহাত্মপূর্ণ। এর অনেকগুলো কারণ আছে।

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বর্ণনানুযায়ী তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো: ক. এ মাসে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হওয়া, খ. এ মাসের কোন বেজোড় রাতে বিশেষ করে শেষ দশকের বেজোড় রাতে পবিত্র ‘লাইলাতুল কদর’ লুকায়িত থাকা, গ. মাসব্যাপী রোজা ফরজ হওয়া, ঘ. নফল বা অতিরিক্ত কাজকে ফরজের মর্যাদা দেয়া, ঙ. একটিমাত্র ফরজকে অন্য মাসের সত্তরটি (কমপক্ষে) ফরজের সমান মর্যাদা দেয়া ইত্যাদি।

আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম মাহে রমজানের ফজিলত ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করে বলেন- “যখন রমজান মাস আসে, আকাশের দরোজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়।” অপর বর্ণনায় আছে- “জান্নাতের দরোজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরোজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়।” (মিসকাতুল মাসাবীহ) এ হাদিসের মর্ম বর্ণনা করে হযরত কাজী আয়াজ (রহ.) বলেন, “এ বাক্যগুলি বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় অর্থেই যুক্তিযুক্ত।”

ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেন, ‘আকাশের দরোজাসমূহ খোলা’ দ্বারা আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ অবতীর্ণ হওয়ার এবং বান্দার আমলসমূহ আল্লাহর দরবারে গৃহীত হওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর ‘জাহান্নামের দরোজাসমূহ বন্ধ করা হয়’ দ্বারা প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়া ও পাপাচার থেকে পবিত্র হওয়ারই ইংগিত করা হয়েছে।

প্রিয় পাঠক/পাঠিকা! মাহে রমজানে শয়তানকে শৃঙ্খলিত করার পরও অনেকে পাপাচার ও গুনাহের কাজে লিপ্ত হতে দেখা যায়। এর কারণ কী? এর উত্তরে বিখ্যাত দার্শনিক হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরবী (রহ.) বলেন, “গুনাহ্ ও কুকর্ম যেমন শয়তানের প্ররোচনায় সংঘটিত হয়, তেমনি কুপ্রবৃত্তি, নফসে আম্মারা, খারাপ অভ্যাস ও মানব শয়তান দ্বারাও সংঘটিত হয়ে থাকে।

কারণ, অব্যাহত ভাবে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামের নাফরমানি করার ফলে ‘মানব শয়তানরা’ ইবলিস শয়তান থেকেও মারাত্মক ও খতরনাক হয়ে পড়ে।” আর কোন মানুষ মানব শয়তানে রূপান্তরিত হয়, তার বিবেক-বুদ্ধি, হায়া-শরম এবং বিবেচনাবোধ সম্পূর্ণরূপে লোপ পায়।

ফলে তার দ্বারা যে কোন সময় যে কোন অকল্যাণকর কাজ, অন্যের অনিষ্ট সাধন এবং অপরাধমূলক কাজ অনায়াসেই সংঘটিত হয়। তারা মানুষের অবয়বে সমাজে বসবাস করলেও তাদের মাঝে মানবীয় গুণাবলী আর অবশিষ্ট থাকে না। তারা হয়ে যায় পশুতুল্য।

ক্ষেত্রবিশেষে তারা পশুর চেয়েও অধম হয়ে যায়। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বলেন, “ ওয়া লাক্বাদ যারা’না লিজাহান্নামা কাছীরাম মিনাল জিন্নি ওয়াল ইনসি লাহুম ক্বলুবুন লা ইয়াফক্বাহূনা বিহা ওয়া লাহুম আ’য়ুনুন লা ইবছিরূনা বিহা ওয়া লাহুম আযানুল লা ইয়াসমাঊনা বিহা উলায়িকা কালআন’আমি বাল হুম আদ্বাল্ল, উলায়িকা হুমুল গাফিলূন।”

অর্থাৎ ‘অবশ্যই আমি এমন অধিক সংখ্যক মানুষ এবং জ্বীন দিয়ে জাহান্নাম পরিপূর্ণ করবো; যাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা (আল্লাহ-রাসূলের বিধি-নিষেধ) অনুধাবন করে না; যাদের চোখ আছে, কিন্ত তারা (সত্য, সঠিক, উপযোগী এবং কল্যণকর কাজ ও বিষয়) দেখতে পায় না; তাদের কান (শ্রবণশক্তি) আছে, কিন্তু তারা (আল্লাহ্-রাসূলের বাণী, কল্যাণকর কথা এবং মজলুমের আর্ত-চিৎকার) শুনতে পায় না; (জেনে রাখো) তারা বোধহীন পশুতুল্য; বরং পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট। তারাই গাফিল। অসতর্ক, অসাবধান এবং আল্লাহ-রাসূলের অবাধ্য।”

(সূরা আ’রাফ, আয়াত: ১৭৯) প্রিয় পাঠক/পাঠিকা! উল্লেখিত একটিমাত্র আয়াতে আল্লাহ পাক সুবহানাহু তায়ালা মানব শয়তানের পুরো বায়োগ্রাফি তুলে ধরেছেন। মানুষরূপে জন্ম নিয়ে এবং মনুষ্য সমাজে বসবাস করেও কতেক মানুষ কেন অন্যায়, অবিচার, জোর-জুলুম, অত্যাচার, অনাচার, চুরি-ডাকাতি, ঘুষ-দুর্নীতি, রাহাজানি-ছিনতাই এবং হত্যা-ধর্ষণসহ অমানবিক ও পশুশুলভ এমকি পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট কাজ সংঘটিত করে তা খুব সাবলীল ভাষায় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। এই পশুবৎ এবং পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট ‘মানব শয়তান’ থেকে সবসময় আমাদেরকে সতর্ক ও সাবধান থাকতে হবে। মানব শয়তানদের যাবতীয় অন্যায়-অপকর্ম ও জুলুম সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং প্রতিবাদী হতে হবে।

আইনানুগ পক্রিয়ায় মানব শয়তানদের রুখে দিতে হবে এবং তাদেরকে আইন-আদালতের কাছে সোপর্দ করতে হবে। তবেই জনগণ, সমাজ ও দেশ নিরাপদ ও শান্তিতে থাকবে। আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর প্রিয় হাবিবে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম ইবলিস শয়তানকে মানবজাতির বিশেষ করে মুমিন-মুসলমানদের প্রকাশ্য দুশমন বলেছেন এবং সেই শয়তানের পথে না চলার জন্য, শয়তানের ধোঁকায় না পড়ার জন্য এবং শয়তানের অনুসারী না হওয়ার জন্য বারবার সতর্ক করেছেন।

কিন্তু আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লামের নিষেধাজ্ঞা ও সতর্কতা উপেক্ষা করে এই শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে কতো মানুষ যে, বরবাদ হয়েছে- তার কোন ইয়ত্তা নেই। ইবলিস শয়তানের রাস্তায় চলতে চলতে এক পর্যায়ে তারা শয়তানের অনুসারী বা থেকে উন্নীত হয়ে 'শয়তানের গুরু'তে রূপান্তরিত হয়।

ফলে শয়তানও তাদেরকে ভয় পায়। মানুষরূপী এই শয়তানদের পবিত্র কোরআনে ‘খান্নাস’ বলা হয়েছে। মানুষ অনেক সময় ইবলিস শয়তানের ধোঁকা ও খপ্পর থেকে বাঁচতে পারলেও নানাভাবে এই মানব শয়তানের ফাঁদে আটকা পড়ে। মনুষ্য শয়তানের অত্যাচার ও জোর-জুলুমের শিকার হয়।

সম্প্রতি আমাদের দেশে নিকটাত্মীয় কর্তৃক শিশু ধর্ষন, শিক্ষক কর্তৃক না বালিকা ছাত্রী ধর্ষন, মসজিদের ইমাম কর্তৃক মহিলা ধর্ষন, মাদ্রাসার শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণ ও ছাত্র বলাৎকার, এমনকি পিতা কর্তৃক নিজ কন্যা ধর্ষনের মতো অবিশ্বাস্য সব নারকীয় ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছে! পবিত্র রমজান মাসেও এ রকম নিকৃষ্ট পাপাচার ও জঘন্য পাশবিকতায় মেতে ওঠেছে মানুষরূপী কিছু সাক্ষাত শয়তান।

এ যেন আইয়্যামে জাহেলিয়াতের পূনরাবৃত্তি। কতটুকু বেপরোয়া হলে আল্লাহর ঘর মসজিদের ভেতরে ধর্ষন ও হত্যাযজ্ঞ করতে পারে- তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। মসজিদের ভেতরে ধর্মীয় লেবাস পরিহিত তথাকথিত তওহিদী জনতার হাতাহাতি, মারামারি, জুতা নিক্ষেপ ইত্যাদি যেন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের দোহাই দিয়ে তাওহিদী জনতা নামধারণ করে কিছু পাণ্ডব দেশের নানা প্রান্তে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাধিক মাজারে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। জায়গায় জায়গায় মবসন্ত্রাস সৃষ্টি করে সারা দেশে ফিতনা তথা নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হচ্ছে।

এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে। এসব অন্যায়-অপকর্ম, অনাচার-পাপাচার ও জোর-জুলুমের বিরুদ্ধ জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। সরকারকে শক্ত হাতে এই মানব শয়তানদের দমন করতে হবে এবং কালবিলম্ব না কবে আইনানুগ বিচার করে এই মানব শয়তানদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

প্রিয় পাঠক/পাঠিকা! এই মানব শয়তানদের আইনের হাতে সোপর্দ করার পাশাপাশি তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। মনে রাখবেন, এ রকম মানব শয়তানদের সঙ্গ দোষে অনেক ভালো মানুষও খারাপ পথে পা বাড়ায়।

তাই ইসলামে বন্ধু বা সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে। গ্রাম বাংলার প্রবাদ ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গে বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’ ইসলামেরই নীতিকথা। তাই মানব শয়তান যেন আমাদেরকে ধোঁকায় ফেলতে না পারে সে জন্য অবশ্যই প্রত্যেক রোজাদার মুমিন মুসলমানকে সতর্ক ও সচেষ্ট থাকতে হবে। আল্লাহ্ আমাদের তওফিক দিন। আমিন! বিহুরমাতি রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম।

আবছার তৈয়বী: লেখক, গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি- প্রবাসী সাংবাদিক সমিতি (প্রসাস)- দুবাই, ইউ.এ.ই। চেয়ারম্যান: আহলে বায়ত (আ.) ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র, আবুধাবি, ইউ.এ.ই।

যাযাদি/এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে