ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে যা শুধু একটি জাতির গল্প নয়, বরং মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। এমনই একটি ঘটনা হলো ফেরাউনের পরাজয় এবং মুসা (আ.)-এর বিজয়। এটি কেবল দুটি শক্তির সংঘাত ছিল না, বরং অহংকার, জুলুম এবং ঐশ্বরিক ক্ষমতার এক অসাধারণ পরীক্ষা। কিভাবে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক ফেরাউন, একজন রাখাল নবী মুসা (আ.)-এর কাছে পরাজিত হলেন, সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়েই এই প্রতিবেদন।
ঐতিহাসিক পটভূমি: মিশরের ক্ষমতা এবং ফেরাউনের দম্ভ
প্রাচীন মিশরের ফেরাউনরা নিজেদের দেবতা জ্ঞান করতেন এবং তাদের ক্ষমতা ছিল অসীম। নীলনদের উর্বর ভূমিতে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা ছিল জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং স্থাপত্যে উন্নত। কিন্তু এই উন্নতির পাশেই ছিল সীমাহীন জুলুম। ফেরাউন বনি ইসরাইলদের দাস বানিয়েছিলেন, তাদের উপর চালাতেন অকথ্য নির্যাতন। তাদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের হত্যা করার নির্দেশও দিয়েছিলেন। এই জুলুমের প্রতিবাদ করতে এবং বনি ইসরাইলদের মুক্ত করতে আল্লাহ তা’আলা মুসা (আ.)-কে নবুওয়াত দান করেন।
মুসা (আ.)-এর আহ্বান এবং ফেরাউনের ঔদ্ধত্য
আল্লাহর নির্দেশে মুসা (আ.) তার ভাই হারুন (আ.)-কে সাথে নিয়ে ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত হন। তারা ফেরাউনকে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহ্বান জানান এবং বনি ইসরাইলদের মুক্তি দিতে বলেন। কিন্তু ফেরাউন তার ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যে মত্ত হয়ে মুসা (আ.)-কে উপহাস করেন এবং তার দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মুসা (আ.)-কে জাদুকর আখ্যা দেন এবং চ্যালেঞ্জ করেন।
ঐশ্বরিক নিদর্শন এবং ফেরাউনের অস্বীকার
ফেরাউনের চ্যালেঞ্জের জবাবে মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তার লাঠি নিক্ষেপ করেন, যা এক বিশাল সাপে রূপান্তরিত হয় এবং ফেরাউনের জাদুকরদের সাপগুলোকে গ্রাস করে ফেলে। এরপর তিনি তার হাত বগলের নিচে ঢুকিয়ে বের করলে তা আলোকিত হয়ে যায়। এসব অলৌকিক নিদর্শন দেখে জাদুকররা ঈমান আনলেও ফেরাউন তার অহংকার ত্যাগ করেননি। বরং তিনি মুসা (আ.)-কে আরও বেশি ঘৃণা করতে শুরু করেন এবং বনি ইসরাইলদের উপর নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দেন।
আল্লাহর গজব: একের পর এক বিপদ
ফেরাউনের অবাধ্যতা এবং জুলুমের কারণে আল্লাহ তা’আলা মিশরের উপর একের পর এক বিপদ নাজিল করেন। প্লাবন, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ এবং রক্তে মিশরের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রত্যেকবার বিপদ এলে ফেরাউন মুসা (আ.)-এর কাছে ক্ষমা চাইতেন এবং বনি ইসরাইলদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেন। কিন্তু বিপদ কেটে গেলেই তিনি তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতেন এবং পূর্বের ন্যায় জুলুম অব্যাহত রাখতেন।
নীলনদের বিভাজন: চূড়ান্ত পরাজয়
অবশেষে আল্লাহ তা’আলা মুসা (আ.)-কে বনি ইসরাইলদের নিয়ে মিশর ত্যাগের নির্দেশ দেন। ফেরাউন তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করেন। যখন তারা লোহিত সাগরের তীরে পৌঁছান, তখন সামনে অথৈ সাগর এবং পেছনে ফেরাউনের সেনাবাহিনী। এই সংকটময় মুহূর্তে মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তার লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত করেন। ফলে সাগর দু’ভাগ হয়ে যায় এবং মাঝখানে শুকনো পথ তৈরি হয়। বনি ইসরাইলরা নিরাপদে সাগর পার হয়ে যায়।
ফেরাউনের সলিল সমাধি
ফেরাউন তার সেনাবাহিনী নিয়ে সেই শুকনো পথ ধরে সাগরে প্রবেশ করেন। কিন্তু যখন তারা মাঝপথে পৌঁছান, তখন আল্লাহর নির্দেশে সাগর আবার জোড়া লেগে যায়। ফেরাউন এবং তার বিশাল সেনাবাহিনী সাগরের অথৈ জলে সলিল সমাধি লাভ করে। এভাবে ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসকদের একজন, তার অহংকার এবং জুলুমের কারণে মুসা (আ.)-এর হাতে এক ঐতিহাসিক ও মর্মান্তিক পরাজয় বরণ করেন।
শিক্ষণীয় বিষয়
ফেরাউনের পরাজয় এবং মুসা (আ.)-এর বিজয় মানবজাতির জন্য এক বিরাট শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, ক্ষমতা, ঐশ্বর্য এবং অহংকার ক্ষণস্থায়ী। জুলুমের পরিণতি সবসময় ভয়াবহ হয় এবং ঐশ্বরিক ক্ষমতা সকল ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। এই ঘটনা যুগে যুগে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সত্য ও ন্যায়ের পথই চিরন্তন বিজয়ের পথ।
মুসা (আ.)-এর হাতে ফেরাউনের পরাজয় শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এটি ঐশ্বরিক ন্যায়বিচারের এক চিরন্তন প্রতীক। এই ঘটনা মানবজাতিকে অহংকার পরিহার করে বিনয়ী হতে, জুলুম পরিহার করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে উৎসাহিত করে। ফেরাউনের পতন আজও বিশ্বব্যাপী ক্ষমতা ও দম্ভের করুণ পরিণতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।