বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার উচ্চ সংক্রমণ :উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি

দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের জনগণ মাস্ক পরার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। মাস্ক পরা ছাড়া যে যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, আড্ডা জমাচ্ছে, গল্প করছে। রাস্তায় বের হলেই এই ধরনের দৃশ্য চোখে পড়ে। ফলে বিপদ বাড়ছে। আমরা মনে করি, সরকারকে এ ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা উচিত। যারা মাস্ক না পরে বাইরে বের হবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সালাম সালেহ উদদীন
  ২৬ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ২৬ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:২৭

বিশ্বজুড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে মৃতু্য ও সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর আগে এমন পরিস্থিতি বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেনি। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, বিশ্বজুড়ে গত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ কোটি পার হয়েছে। অন্যদিকে, মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫৬ লাখ ১১ হাজার। গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে ফ্রান্সে। অন্যদিকে, দৈনিক প্রাণহানির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রাণহানির তালিকায় এরপরই রয়েছে রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালি, মেক্সিকো, ব্রাজিল ও পোল্যান্ড। এদিকে, ভারতে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনেরগোষ্ঠী সংক্রমণ (কমিউনিটি ট্রান্সমিশন) শুরু হয়েছে। আর ভাইরাসের দাপট বেশি দেশটির বড় শহরগুলোতেই। ভারতে প্রতিদিন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা তিন লাখ, টানা ৫ দিনের চিত্র একই। আগে ডেল্টার দাপটও ভারতে বেশি ছিল। এদিকে, বাংলাদেশেও করোনার অতি সংক্রামক ধরন ডেল্টা ও ওমিক্রনের প্রভাবে ফের সংক্রমণ বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫ জনের মৃতু্য হয়েছে। একই সময়ে নতুন রোগী হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ১৪ হাজারের বেশি। দেশে এ পর্যন্ত মোট ১৭ লাখ ২০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। আর মারা গেছেন ২৮ হাজার ২৩৮ জন। বাংলাদেশে শনাক্ত বেড়েছে ১৮০ শতাংশ এবং মৃতু্য বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। সারাবিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ কোটি ৬৫ লাখ এবং মৃতু্যর সংখা ৫৬ লাখ। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) নতুন ধরন ওমিক্রন প্রতিরোধসহ সংক্রমণ রোধে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বুধবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের পঞ্চম অধিবেশনে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। করোনার দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘটেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একইসঙ্গে ওমিক্রন একটু একটু করে ডেল্টার জায়গা দখল করছে বলে সতর্ক করেছে প্রতিষ্ঠানটি। দেশে শনাক্তের হার ফের ৩২% ছাড়াল। এই তথ্য উদ্বেগজনক। এমন পরিস্থিতিতে অর্ধেক জনবল নিয়ে সরকারি অফিস ও ব্যাংক চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে গণপরিবহণের কী হবে। অর্ধেক আসন নিয়ে গণপরিবহণ চালানোর কথা থাকলেও পূর্ণ আসনই কেবল নয় দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া হচ্ছে, যেন দেখার কেউ নেই। উলেস্নখ্য, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশের হুবেই শহরে প্রথম করোনার অস্তিত্ব শনাক্ত হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই ভাইরাসটি বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়ে। গত বছরের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে 'বৈশ্বিক মহামারি' হিসেবে ঘোষণা করে। দেশে করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া উন্মুক্ত স্থানে যে কোনো সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বন্ধ থাকবে। ওমিক্রন আতঙ্ক এবং সামগ্রিকভাবে করোনা পরিস্থিতিতে সরকার যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি আরও জানিয়েছে, এখন আর বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের থেকে ওমিক্রনে সংক্রমিত হওয়ার প্রসঙ্গটি থাকছে না, যেহেতু তা এরই মধ্যে গোষ্ঠী সংক্রমণের চেহারা নিয়ে ফেলেছে। কমিটি আরও জানিয়েছে, মাস্ক পরা, ভিড় এড়ানো, স্যানিটাইজারের ব্যবহারের মতো করোনার বিধিনিষেধগুলো ও ভ্যাকসিনেশনই বর্তমান পরিস্থিতিতে একমাত্র ঢাল হতে পারে করোনার সঙ্গে যুদ্ধে। ইতিমধ্যে সরকার দুই সপ্তার জন্য স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। এ ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া যাবে, তা নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। এটা সত্য, প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃতু্য হারও বাড়ছেই। এমন পরিস্থিতি অতীতে দেখা যায়নি। যদিও ওমিক্রনে সংক্রমিতদের অধিকাংশই উপসর্গহীন। তবে সর্দি জ্বর মাথাব্যথা কাশি রয়েছে অনেকেরই। কেউ কেউ খাবারের স্বাদও পাচ্ছে না। হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। সেইসঙ্গে আইসিইউ বেডের চাহিদাও বাড়ছে। ফলে তৃতীয় ঢেউয়েও কোভিড নিয়ে আশঙ্কা দূর হয়েছে, এমনটা এখনই বলা যাচ্ছে না। বিধিনিষেধে সব ধরনের যানবাহনের চালক ও সহকারীদের আবশ্যিকভাবে করোনার টিকা সনদ থাকার কথা বলা হলেও দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ চালক-সহকারী এখনো টিকাই নেননি। যদিও চালক-সহকারীদের টিকা নেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে মাস্ক পরতেও অনীহা তাদের। এছাড়া বাসগুলোতে যাত্রী তোলা হয়েছে এমনভাবে যেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন ইসু্যতে দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। সরকারের দেওয়া ১১ বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসেছে। অনেকেরই মাস্ক পরায় ত্রম্নটি দেখা যায়। কেউ থুতনিতে মাস্ক পরেছেন, কেউ কেউ আবার মাস্ক পকেটে রেখেছেন। কেউ ম্যাজিস্ট্রেট দেখে পকেট থেকে মাস্ক বের করেছেন। এছাড়া অধিকাংশের কাছেই ছিল না মাস্ক। তারা দিয়েছেন নানা অজুহাত। এটা সত্য, সারা বিশ্বে মহামারি হয়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউনের চেয়েও সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হলো মাস্ক ব্যবহার করা। কারণ করোনাভাইরাস মূলত বাতাসে ড্রপলেটস বা মুখ থেকে নিঃসৃত মিহি জলকণার মাধ্যমে ছড়ায়। আর মাস্ক ব্যবহার করলে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায় বলে এক গবেষণায় বলা হয়েছে। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের তিনটি উপধরন হয়েছে। এই উপধরনগুলো রাজধানী ঢাকায় বেশি ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। এ বিষয়ক একটি প্রতিবেদন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, জানুয়ারির প্রথম দুই সপ্তাহে আইসিডিডিআরবির ল্যাবরেটরিতে ১ হাজার ৩৭৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ২৮ শতাংশই ছিল করোনায় আক্রান্ত। আর আক্রান্তদের মধ্যে ওমিক্রন ছিল ৬৯ শতাংশের দেহে। ওমিক্রনের জিনোম সিকুয়েন্স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা শহরে তিনটি সাব টাইপ রয়েছে। এগুলো আফ্রিকান, ইউরো-আমেরিকান এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ওমিক্রন ধরনের সঙ্গে মিলে যায়। উলেস্নখ্য, বাংলাদেশে ৬ ডিসেম্বর ওমিক্রন প্রথম শনাক্ত করা হয়। তবে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে ১১ ডিসেম্বর। ওই মাসেই আইসিডিডিআরবির ল্যাবে পরীক্ষা করা ঢাকা শহরের ৭৭ জন করোনা রোগীর মধ্যে পাঁচটিতে ওমিক্রন শনাক্ত করা হয়েছিল। অন্যগুলো ছিল ডেল্টা। ২৭ জনের কোনো উপসর্গও ছিল না। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের জনগণ মাস্ক পরার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। মাস্ক পরা ছাড়া যে যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, আড্ডা জমাচ্ছে, গল্প করছে। রাস্তায় বের হলেই এই ধরনের দৃশ্য চোখে পড়ে। ফলে বিপদ বাড়ছে। আমরা মনে করি, সরকারকে এ ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা উচিত। যারা মাস্ক না পরে বাইরে বের হবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আবার অনেকে মনে করছেন, দুই ডোজ টিকা নিলে কোনো সমস্যা হবে না। করোনা হবে না। এই চিন্তা ঠিক নয়। টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। মনে রাখতে হবে, নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বেগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, অকারণে ঘোরাফেরা না করা, মাস্ক পরাসহ প্রয়োজনীয় সচেতনতাও জরুরি। জনগণ স্বাস্থ্য-সচেতন হলে দেশে সংক্রমণ ও মৃতু্য কমে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ ক্ষেত্রে সরকারকে আরো তৎপর ও মনোযোগী হতে হবে। সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে