শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অসৎ পথে ধনী হওয়ার হিড়িক

দেশের মানুষ সৎ ন্যায়নিষ্ঠ দেশপ্রেমিক হলে অবস্থা এমন হতো না। দেশব্যাপী অসৎ পথে উপার্জনের ও ধনী হওয়ার হিড়িক পড়ত না। জাতি হিসেবে এটা আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা।
সালাম সালেহ উদদীন
  ১৮ মে ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ১৮ মে ২০২২, ০৯:১৪

স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা গর্বিত ও আশাবাদী। এই দেশ এক দিন উন্নত দেশের কাতারে যাবে। এমন স্বপ্ন দেশদরদি জনগণ দেখে, দেখে সরকারও। প্রত্যাশা করা, স্বপ্ন দেখা আর তা বাস্তবে রূপ দেয়া এক কথা নয়। কঠিন সাধনার মাধ্যমে সত্যের মুখোমুখি হওয়া এবং তাকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। পরিকল্পনা, পরিশ্রম, গঠনমূলক চিন্তা ছাড়া যেমন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়, একইভাবে সম্ভব নয় রাষ্ট্রের উন্নয়নও। রাষ্ট্র তা যত ক্ষুদ্রই হোক তার চরিত্র হতে হবে গণমুখী তথা জনকল্যাণমূলক। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশকে নিয়ে বিগত পাঁচ দশকে অনেক স্বপ্ন দেখলেও রাষ্ট্রের কাঠামোগত চরিত্র দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। যদিও বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে এশিয়ার বাঘ, উন্নয়নের রোল মডেল। স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশ এতটাই আর্থিকভাবে দুর্বল ছিল, মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদ হেনরি কিসিঞ্জার এই দেশকে একটি 'তলাবিহীন ঝুড়ি' হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের সেই বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকার দেশের ইপ্সিত প্রবৃদ্ধির ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রাপ্তির হারও অনেক বেড়েছে এবং এ ক্ষেত্রে বাজেটে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। মাতৃমৃতু্য ও শিশুমৃতু্যর হার কমেছে। মুদ্রাস্ফীতি নেমে এসেছে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশে। তথ্যপ্রযুক্তিতে, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক ভালো। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। সুখী ব্যবসাসফল দেশের তালিকায় বাংলাদেশ আশাব্যঞ্জক অবস্থানে রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্রীড়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে 'ভিশন-২০৪১' কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার- যা সফল হওয়ার পথে। শুধু দেশেই নয়- আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর স্বীকৃতি মিলেছে। আমাদের এই অর্জন ধরে রাখতে হবে। তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে বাংলাদেশ এখনো মুক্ত হতে পারেনি। বাংলাদেশ এক সময় দুর্নীতির জন্য পর পর পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। দুর্নীতির সেই কলঙ্কতিলক মোচন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি এটা যেমন সত্য, একইভাবে সত্য যে, আমরা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে পারিনি। যার কারণে আমাদের আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে তার রয়েছে জিরো টলারেন্স নীতি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার তিনি। ইতোমধ্যে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, দুর্নীতি না হলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। তিনি আরও বলেছেন, ফাঁকফোকর কোথায় এবং কারা উন্নয়ন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। অসৎ দুর্নীতি-অনিয়ম-উচ্ছৃঙ্খলতায় জড়িত থাকলে দলের লোকদেরও ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ার করেছেন তিনি। তিনি আরও বলেছেন, 'আমি একটা কথা স্পষ্ট বলতে চাই, এই অসৎ পথ ধরে কেউ উপার্জন করলে, অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খলতা বা অসৎ কাজে যদি ধরা পড়ে, তবে সে যেইহোক না কেন, আমার দলের হলেও ছাড় হবে না, এর বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা অব্যহত থাকবে।' দুর্নীতির পাশাপাশি মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথাও বলেছেন তিনি। কথায় বলে ক্ষমতা পেলে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। কীভাবে ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নয় অপ-ব্যবহার করা যায় সে চেষ্টায় সারাক্ষণ মত্ত থাকে। ছোট ক্ষমতা ছোট অপরাধের জন্ম দেয় বড় ক্ষমতা জন্ম দেয় বড় অপরাধের। ক্ষমতা পাওয়ার পর জীবনকে কর্মকান্ডকে স্বচ্ছ রেখেছেন এমন নেতা বিরল। তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই অসৎ পথে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কোটি কোটি টাকা বানানো। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, একদিন যিনি রাস্তার লোক হিসেবে চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, ক্ষমতাসীন দলে কৌশলে ঢুকে যাওয়ার কারণে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, এই সুযোগ তাকে কে করে দিয়েছে। দলের মধ্যে যদি বিশেষ স্বচ্ছ শক্তিশালী মনিটরিং সেল থাকতো তা হলে অপরাধের বা দুর্নীতির একটি চিত্র জনগণ পেত। অপরাধ ধরা পড়লে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী সৎ আদর্শিক দেশপ্রেমিক না হলে, তিনি তো সুযোগ পেলে লুটপাট করবেনই, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। এটা সত্য এই সমাজে সৎভাবে জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এটা যেন ২৪ ঘণ্টা আগুনে হাত রাখার মতো। অসৎ বা অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং সমাজকে বিকলাঙ্গ করে দেয়। চারদিকে তারই ধ্বনি আমরা শুনতে পাচ্ছি। সম্প্রতি পি কে হালদারের দুর্নীতির যে চিত্র বেরিয়ে এলো তা ভাষাহীন। মনে রাখতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা সহজ কাজ নয়। আর এটা প্রধানমন্ত্রীর একার কাজও নয়। এটা হচ্ছে সম্মিলিত কাজ। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই যুদ্ধে জয়লাভ করতেই হবে। না হলে আমাদের রক্ষা নেই। তবে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যেতে পারত। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি বড় বাধা। বিশেষ করে রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতিতে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছেন- যা রীতিমতো ভয়ংকর। এখন মনে হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ করেও কোনো লাভ হয়নি। তাদের লোভ ও মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। সরকারি কোনো কাজের জন্য ১০ জায়গায় ধরনা দিতে হয়। ঘুষ দিতে হয় প্রতিটি টেবিলে। তারপরও সময়ের কাজ সময়ে হয় না। দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসে কাজের পরিবর্তে কীভাবে চুরি দুর্নীতি লুটপাটের মাধ্যমে ধনী হওয়া যায় সর্বক্ষণ সেই চিন্তাতে ব্যস্ত থাকেন। এভাবে যদি রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্র ধরে ধরে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জায়গায় নিয়ে আসা যায় তবে চরম হতাশা ও নৈরাজ্যজনক চিত্রই চোখে পড়বে। ফলে আশাবাদী হওয়ার আর সুযোগ থাকবে না। বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা অনেক কঠিন কাজ। এ জন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। অসম ও অসুস্থ পুঁজির বিকাশের কারণেই সমাজে ধন-বৈষম্য বেড়েছে। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ ঠিকমতো খাবার জোগাড় করতে পারছে না অন্য এক শ্রেণির মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছে। তাদের ঘরে টাকার পাহাড়। তাদের টাকা রাখার জায়গা নেই। একেক জনের ১৫-২০টি বাড়ি, ৮-১০টি গাড়ি। তাদের নিরাপত্তাকর্মীর অভাব নেই। সৎ পথে উপার্জিত অর্থের চিত্র এমন হতে পারে না। সমাজ ও রাষ্ট্রে অর্থই প্রধান নিয়ন্ত্রক শক্তি। টাকা দিয়ে সব করা যায়, কাজ না করেও সরকারি প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা তুলে নেয়া যায়। টাকার বিনিময়ে পিয়ন-ঝাড়ুদার থেকে নেতা হওয়া যায়, হওয়া যায় ধনপতি ও পেশিশক্তির অধিকারী। আরও কত কী? বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কত টাকা প্রয়োজন। দেশের সবাই যধি অবৈধভাবে কোটিপতি হতে চায় তা হলে এটা রাষ্ট্রের জন্য একটা বিপজ্জনক বার্তা। দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের বুকে একটি মর্যাদাশালী ও গর্বিত দেশ। বাংলাদেশের সাফল্যের তালিকা দীর্ঘ এবং আকর্ষণীয়। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর নিজস্ব আর্থিক সংকট মোকাবিলার সক্ষমতা রয়েছে। বাংলাদেশের সাফল্যের তালিকা আরও অনেক বেশি দীর্ঘ হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা। যদিও সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও রয়েছে- এটা স্বীকার করতেই হবে। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, এটাকে কী হিসেবে ব্যাখ্যা দেব। সারাদেশে অবৈধভাবে মজুত রাখা তেল উদ্ধার চলছে। কয়েকদিনের অভিযানে লাখ লাখ লিটার তেল বেরিয়ে আসছে- যা রীতিমতো বিস্ময়কর। ভোজ্যতেল নিয়ে এ দেশের অসৎ ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা যা করেছে তাতে তাদের প্রকৃত চরিত্র ফুটে উঠেছে। এর আগে তারা পেঁয়াজ নিয়েও একই কান্ড করেছিল। তাদের রয়েছে সীমাহীন লোভ। সয়াবিন তেল অবৈধভাবে মজুত ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অভিযোগ ওঠার পর সম্প্রতি সারাদেশে বেশ কিছু গুদামে হানা দেয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। জব্দ করে কয়েক লাখ লিটার তেল। অবৈধ মজুতের দায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের করা হয় জরিমানা। কিন্তু কারও বিরুদ্ধ ফৌজদারি মামলা হয়নি। শুধু সয়াবিন তেল নয়, নিত্যপণ্য অবৈধভাবে মজুতদারদের বিচারের কঠিন আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। এর আগেও লিখেছি, এ দেশে তেলের দাম বাড়লে তুলার দাম বেড়ে যায়। এবারো তাই হলো। তেলের সঙ্গে যে সব পণ্যের সম্পৃক্ততা নেই, সেই সব পণ্যের দামও ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বলতে গেলে সব নিত্যপণ্যেরে দামই চড়া। মাছ প্রতি কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। কিছুদিন আগেও এক ডজন ডিমের দাম ছিল ১০০ টাকা এখন ১২০ টাকা। আলু কেজিতে ৫ টাকা এবং পেঁয়াজ ১৫ টাকা বেড়েছে। নদীর চিংড়ির কেজি ১৪০০ টাকা। চাষের চিংড়ি কেজিতে বেড়েছে ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা। সব ধরনের মাংসের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। পাস্তুরায়িত দুধের দামও বেড়ে যাচ্ছে। চালের দামও আরেক দফা বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। রিকশা সিএনজি ভাড়ার কথা তো বলাই বাহুল্য। দেশের মানুষ সৎ ন্যায়নিষ্ঠ দেশপ্রেমিক হলে অবস্থা এমন হতো না। দেশব্যাপী অসৎ পথে উপার্জনের ও ধনী হওয়ার হিড়িক পড়ত না। জাতি হিসেবে এটা আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা। তবে হতাশ হলে চলবে না, চলবে না মনোবল হারালেও। আমাদের দৃঢ়চেতা মানসিকতা নিয়ে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। অসৎ দুর্নীতিবাজদের বিরেুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। সালাম সালেহ উদদীন :কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে