সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়  

মো. মোবাশ্বির হাসান শিপন
  ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:২১
প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়  

২০১৪ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা সংক্রান্ত এক বিশেষ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন উচ্চ মানের শিক্ষক। তিনি বিশ্বের সকল নেতৃবৃন্দের প্রতি বলেছিলেন, অস্ত্র নয়, শিক্ষক বিনিয়োগ করুন।

আপনারা জানেন শিক্ষার জন্য বিনিয়োগ অর্থবহ ফলাফল বয়ে আনে। আপনার সন্তানকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোন বিকল্প নেই। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা প্রদানে নিয়োজিত থাকেন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী। তাদের কাছেই আপনার সন্তান যথাযথ প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠবে। সেই লক্ষেই বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে অন্যতম অগ্রাধিকার খাত হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এখন প্রয়োজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে আপনার ভূমিকা নিশ্চিত করা। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড,শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনা। ব্যক্তি,সামাজিক রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য সর্বপ্রথম যে বিষয়টা প্রয়োজন তা হল শিক্ষা।

আর এই শিক্ষা অর্জনের মৌলিক ভিত্তি তৈরী স্থান হলো প্রাথমিক শিক্ষা। যা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো থেকেই হাতে খড়ি হয়ে থাকে। আমরা শিক্ষিত সমাজের সবাই উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে থাকে অভিন্ন সিলেবাস আর কারিকুলামের মাধ্যমে। কিন্তু জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে গিয়েই এই মানুষ গুলো ব্যতিক্রমভাবে উপস্থাপন করে। জীবনের এই ব্যতিক্রমতটা তৈরী যে মৌলিক ভূমিকা রাখে তা হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাদের শিক্ষার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের আচার আচরন,কথাবার্তা কাজ ও শিক্ষা দেয়ার ব্যতিক্রমতার ফলাফলও ভবিষ্যৎ জীবনে ব্যতিক্রমতা তৈরী করে। সুতরাং একটি জাতিকে কীভাবে তৈরী করতে চায় তা নির্ভর করে প্রাথমিক শিক্ষার উপর।

আমরা জানি, এক দশক আগেও বাংলাদেশে স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীর হার ছিল খুব কম এবং মেয়েদের হার ছিল আরও কম। শহরে স্কুলগামীর সংখ্যা কিছুটা বেশী হলেও গ্রাম গঞ্জে যা ছিল একেবারেই কম। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে যেমন শতভাগ উপস্থিতি প্রদান, অভিভাবকদের সচেতন করতে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ, শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা, সময়মত বই বিতরণ, বিনা বেতনে শিক্ষা, ফ্রি টিফিনের ব্যবস্থা, বাল্য বিবাহ রোধ প্রভৃতি কারণে স্কুলগামী ছেলেমেয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি শিক্ষার হারও প্রতি বছর বেড়েই চলেছে।

দূঃখের ব্যাপার হলো শিক্ষার হার বাড়াসহ শিক্ষিত সমাজের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেলেও আমরা তাদেরকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে- তাঁদের মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রত করে দিতে পারছি না। শিক্ষার পাশাপাশি ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য বুঝিয়ে নিজের জীবনে তা বাস্তবায়নের কতটুকু প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করাতে পেরেছি।

চাকরী জীবনে গিয়ে নিজের দায়িত্বানুভুতি থেকে নাগরিক সেবায় নিয়োজিত করে নাকি ঘুষ দুর্নীতির মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে জাতির ধবংসের জন্য নিজের পকেট ভারী করে থাকে। একজন সেবা প্রাপ্তির কাছে কেমন ব্যবহার করতে হবে তা কতটুকু শিখাতে পেরেছি। সরকারের এত সুযোগ সুবিধা ও আধুনিকায়নের যুগেও আমার মনে হয় এসব প্রশ্নের অধিকাংশরাই বলবেন আমরা চেষ্টা করেছি; বাস্তবায়ন করতে পারিনি।

বিশ্বের অনেক দেশের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, তাদের শিশু কিশোররা প্রাথমিক জীবনে যা অর্জন করে আমরা প্রাথমিক পর্যায়েও তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। কারণ মূল ভিত্তি তৈরীর স্থান হলো প্রাথমিক শিক্ষকের ব্যবস্থা সেখানেই তা আমরা নয়-ছয় দিয়ে পার করে তাদেরকে পরবর্তী জীবনকে ধবংস করে দিচ্ছি। পৃথিবীর সমৃদ্ধ দেশগুলোতে একজন কিশোর তার টিন এইজ বয়স থেকে কর্মমূখী হয়ে নিজে স্বাবলম্বী হয় আর দেশের জন্য নিজেকে সর্ব্বোচ্চ প্রস্তুত করে রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষার হার যত বাড়ছে বেকারত্ব ততই গ্রাস করছে।

জীবনের শুরু থেকেই শিশুরা কীভাবে তাদের প্রাত্যাহিক জীবন ব্যয় করতে হবে, কোনটা সঠিক নয়, স্কুলের নিয়ানুবর্তিতা, রাস্তায় চলাচলের প্রচলিত নিয়ম সম্পর্কে সর্বোচ্চ সচেতন থাকে। রাস্তা পারাপারের সময় কোন চিত্র ব্যবহার করলে কীভাবে চলতে হবে তা সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারনা নিয়েই বিদেশের শিশুরা পথ চলে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাস্তর একটু তুলনা করলে দেখা যাবে শিশুরা দূরের কথা এই নিয়মগুলো আমরাদের শিক্ষকরা জানেন না। তাহলে একটা মৌলিক শিক্ষা তাঁদের অজানা থেকে যাচ্ছে। যে সময়টা মূল ভিত্তি তৈরীর তখন তাঁকে কী পুঁজি দিয়ে প্রাথমিক জীবন থেকে বিদায় দিচ্ছি এ আমলে নিতে হবে।

নিজের দায়িত্ব পরিপূর্নভাবে পালন না করা: আমরা যারা প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত তাদের মনে রাখতে হবে আমাদের শুধু পেশাগত দায়িত্ব পালনই আমাদের কাজ না বরং একজন সন্তানকে গড়ার জন্য যেরকম চতুর্মুখী চিন্তা করে সন্তানের ভবিষ্যত গড়তে র্পূনাঙ্গ দায়িত্ব পালন করা। প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের সিলেবাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেখানে নৈতিক শিক্ষা বা নীতি কথার চেয়ে তাত্ত্বিক কথা অনেক বেশী যা বাচ্চারা মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাশের জন্য।

শুধু সার্টিফিকেট অর্জন করলেই যেমন শিক্ষিত হওয়া যায়না তেমনি শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য আর যাই হোক শিক্ষকতা পেশায় আসা ঠিকনা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো আমরা অনেকে এই মানষিকতার হয়ে গেছি। বলতে দ্বিধা নেই, যারা মানুষ গড়ার কারিগর, তাঁদের অনেকের নৈতিক মান নিয়ে অনেক খবর আমাদের নজরে আসে।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখানোর মহান দায়িত্ব যাদের তারা শিক্ষকতা নামক পেশাটিকে নেহায়েতই আয় রোজগারের একটি উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বা নিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষকতা করার যোগ্যতা সর্ম্পকেই প্রশ্ন চলে আসে। নিজেই যদি এসব বিষয়ে অজ্ঞ থাকে তাহলে কোমলমতিদের কী শিক্ষা দিবে।

বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষকের যে অনুপাত তা মানসম্মত শিক্ষার জন্য মোটেও উপযোগী নয়। একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার জন্য যে জনবল প্রয়োজন সেই তুলনায় সংখ্যাটা অপ্রতুল। যার কারনে কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছার চিন্তা থাকলেও সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় পিছু হটতে হয়।

আদর্শবান জাতি গঠনের লক্ষ্যই সুস্থমেধা বিকাশ উপযোগী যে ধরনের শ্রেণিকক্ষ দরকার তা অনেক বিদ্যালয়েই অনুপস্থিত। অনেক বিদ্যালয়ে বসার যথাযথ বেঞ্চ নেই, টয়লেট নেই, খেলার সামগ্রী নেই।

বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি অন্যতম দায়িত্ব হলো শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করা। দেখা গেছে, এসএমসির অনেক সদস্যই শিক্ষার গুরুত্ব বা গুনগত মান বৃদ্ধির বিষয়ে মোটেও সচেতন নয়। অনেকেই এসএমসির সদস্য হওয়াকে বা সভাপতি হওয়ার বিষয়টিকে সন্মান বৃদ্ধির/ক্ষমতা-আধিপত্য বৃদ্ধির/আয় রোজগার বৃদ্ধির উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শকে বিবেচনায় না এনে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদানকে বিবেচনা করার জন্য বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যেহেতু গ্রামে বসবাস করে এবং তারা কৃষি কাজে জড়িত, স্বাভাবিক ভাবেই তারা তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে তাদের মত কৃষক বানাতে চায়। তাদের অনেকের ধারণা, পড়ালেখা করে গরীব মানুষের সন্তানদের চাকরি পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া শিক্ষার গুরুত্ব বা সুদূর প্রসারী ফল নিয়ে চিন্তা করার মত কল্পনা শক্তিও তাদের নেই।

শুধু সিলেবাসভুক্ত পড়াশুনা না করিয়ে আদর্শ ভিত্তিক নীতি নৈতিকতা সম্পন্ন মানসিকতা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে।

সর্বোপরি, সুস্থ মেধা বিকাশে শিক্ষার পরিবেশ তৈরির জন্য যা যা প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য তা নিশ্চিত করতে হবে।

বিনয়ী, সৎ ও যোগ্যতা সম্পন্ন একটি জাতি গঠনের জন্য যে সব অন্তরায় রয়েছে সেগুলো অবশ্যই একদিন দূর হবে এবং যে স্বপ্ন-সাধ নিয়ে এই জাতির পথ চলা শুরু হয়েছিল তা অচিরেই পূর্ণ হবে। আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ এবং সেবাধর্মী একটি জাতি গঠনে সবাই কাজ করব। নীতি নৈতিকতা সম্পন্ন, দেশপ্রেম জাগ্রত করে কর্মসূখী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাথমিক স্তর থেকে মূল ভিত্তি রচনা করে দেব।

লেখক: শিক্ষক, সংগঠক

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে