শিক্ষাক্রম শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Curriculum। কারও মতে Curriculum শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Currere থেকে এসেছে। যার অর্থ Course of study অর্থাৎ পাঠ্যবিষয়। অন্যদের মতে এটি ল্যাটিন শব্দ Currer থেকে এসেছে। যার অর্থ ঘোড়দৌড়ের মাঠ। একটি নির্দিষ্ট স্তর বা শ্রেণির শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রীক পরিকল্পনাই হল শিক্ষাক্রম।
শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ হুইলার (1967) এর মতে, “শিক্ষাক্রম বলতে শিক্ষার উদ্দেশ্য, শিখন অভিজ্ঞতা নির্বাচন, বিষয়বস্তু শনাক্তকরন, বিষয়বস্তু সংগঠন, মূল্যায়ন ইত্যাদির একটি বৃত্তাকার গতিশীল কার্যক্রমকে বুঝায়।"
শিক্ষাক্রম বা কারিকুলামের মূল উপাদান চারটি। যথা-
সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার উদ্দেশ্য পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনের ফলে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কয়েকবার জাতীয় শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হলেও তা নিয়ে এত আলোচনা সমালোচনা হয়নি “জাতীয় শিক্ষাক্রম বিস্তরণ-2022” নিয়ে যত আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে।
এই শিক্ষাক্রমে বড় ধরণের পরিবর্তনগুলো হলো:-
১. ৬ষ্ঠ- ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, শিল্প ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিষয়গুলো পড়ানো হবে। ৯ম ও ১০ম শ্রেণিতে কোনো বিভাগ থাকবে না এবং সকল শিক্ষার্থীকে কেবল ১টি কোর্স বিজ্ঞান বিষয় পড়তে হবে। এর ফলে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে মাত্র ২ বছর জীববিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত পড়েই চিকিৎসা বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষায় পড়তে যেতে হবে। যেখানে আগে চার বছর এই বিষয়গুলো পড়ে উচ্চ শিক্ষায় যেতে হত।
২. বাংলাদেশে বেঞ্জামিন ব্লুম এর শিক্ষার ক্ষেত্র অনুসরণ করা হয়। তার মতে শিক্ষার ক্ষেত্র তিনটি। যথা- জ্ঞান, (Cognitive Domain), আবেগ (Effective Domain) মনোপেশিজ (Psychomotor)। নম্বর ভিত্তিক পরীক্ষাগুলো দ্বারা শিক্ষার্থীর আবেগিক দিক ও মনোপেশিজ দিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না বিধায় নম্বর ভিত্তিক পরীক্ষার পরিবর্তে প্রতীক দিয়ে PI (কর্মদক্ষতা ইনডিকেটর) BI (আচরণগত ইনডিকেটর) ক্ষেত্র মূল্যায়ন করা হবে। এ মূল্যায়ণ কার্যক্রম সারা বছর জুড়ে চলবে। এ ধরণের মূল্যায়নের ফলে শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের কোনো মেধা তালিকা করার প্রয়োজন থাকবে না। কোনো শিক্ষার্থীকে আর অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে না।
৩. শিখন পদ্ধতিতে নবতর সংযোজন হলো- এ্যাসাইনমেন্ট। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের একটি সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য দিবেন। শিক্ষার্থী তা তার বাস্তব অভিজ্ঞতা, চারপাশ ও ইন্টারনেট হতে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে সেগুলো লিপিবদ্ধ করে শিক্ষককের নিকট উপস্থাপন করবে।
৪. পাঠ্যবইগুলোকে শিক্ষার্থীদের নিকট আনন্দময় করে তোলার জন্য অন্যান্য বইয়ের সাথে গণিত, বিজ্ঞান বইতেও বিভিন্ন গল্পের অবতারণা করা হয়েছে। আবার প্রত্যেক অধ্যায়ে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন ও ব্যাপক অনুশীলনী বাদ দেওয়া হয়েছে।
৫. নতুন দুইটি বিষয়ের মধ্যে জীবন ও জীবিকা বিষয়টি পড়াবেন ব্যবসায় শিক্ষা বিষয় ও কৃষি শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষকগণ এবং শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয় পড়াবেন অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষকগণ। নির্বাচিত শিক্ষকগণ স্নাতক পর্যায়ে এ বিষয় না পড়লেও উনাদেরকে ৫ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞগণের মতে একটি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হয়:
১) রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবন দর্শন বা আদর্শ ২) আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোগত ব্যবস্থা ৩) আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ৪) জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ৫) জনগণের ধর্মীয় চেতনা ও বিশ্বাস ৬) বস্তুগত সম্পদের প্রাপ্যতা ৭) শিক্ষার্থীর সমকালীন ও ভবিষ্যৎ চাহিদা ৮) শিক্ষার্থীর অভিযোজন ক্ষমতা ৯) অভিভাবক ও স্টেক হোল্ডাগণের মানসিকতা ১০) শিক্ষকবৃন্দের দক্ষতা ১১) ভবিষ্যৎ সমাজ নির্মাণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারের রূপরেখা ১২) শাখায় শিক্ষার্থীর পরিমাণ ১৩) শ্রেণিকক্ষের অবকাঠামোগত অবস্থা।
বাংলাদেশে বিদ্যমান অবস্থার সাথে জাতীয় শিক্ষাক্রম বিস্তরন-2022 এর সামাঞ্জস্য বিধান এর উপর এর সফলতা নির্ভর করছে।
লেখক : বি.কম. (অনার্স) ১০ম স্থান, এম. কম (হিসাববিজ্ঞান), বিএড সহকারী প্রধানশিক্ষক, আমিশাপাড়া কৃষক উচ্চ বিদ্যালয়, আমিশাপাড়া, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী।
যাযাদি/ এস