মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বহুতল ভবনে রেস্তোরাঁ ও আমাদের করণীয়

মাহমুদুর রশিদ
  ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৩২
মাহমুদুর রশিদ

বহুতল ভবনে অনেক রেস্তোরাঁ থাকতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, পরিকল্পনা ও অনুমোদন ছাড়াই যখন তা করা হয়, তখন তা শুধু দোষ নয়, তখন এই অপরিকল্পিত নির্মাণ পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শামিল।

আমরা সব সময় পুরান ঢাকার ঝুঁকির কথা বলি, কিন্তু বেইলি রোডের এই মর্মান্তিক ঘটনাটি আমরা কিভাবে নতুন ঢাকা গড়ে তুলছি তার উদাহরণ। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়; এটা আমাদের কর্মের ফলাফল, ভবন মালিক থেকে কর্তৃপক্ষ সবাই সমান দায়ী। ঢাকা শহরজুড়ে গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁর মেলা।

অনেক বহুতল ভবনের প্রতিটি তলায় গড়ে উঠেছে এসব অপরিকল্পিত রেস্তোরাঁ। এখনই সচেতন না হলে এর ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। আমাদের আবার ভাবতে হবে, কোনটির দাম বেশি? নিরাপত্তা সরঞ্জামের নাকি জীবনের!

বেইলি রোডের ভবন- গ্রীন কোজি কটেজের রাজউকের কাছ থেকে mixed-use (commercial office and residential apartments) হিসেবে অনুমোদন নিয়েছে। বিল্ডিংয়ের ধরন: E এবং R । বাণিজ্যিক হিসেবে ছাড়পত্র গ্রহন করলে যে সেখানে রেস্তোরাঁ করা যাবে তা সঠিক নয়, এর জন্য পৃথক অনুমোদন প্রয়োজন। যথাযথ অনুমতি ছাড়া ভবনে বাণিজ্যিক রান্নাঘর/রেস্তোরাঁ স্থাপন করা সম্পূর্ণ বেআইনি। গ্রীন কোজি কটেজে ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স থেকে অনুমোদিত ফায়ার সেফটি প্লান থাকার কথা ছিল। কিন্তু তারা সেটা করেনি।

ভবনটিতে ফায়ার ডোর, জরুরি বহির্গমন পথ, ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম এবং ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম এর প্রয়োজন ছিল। তা ছাড়া, একটি বাণিজ্যিক রান্নাঘর/রেস্তোরাঁর রান্নাঘরের হুডে একটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা স্বয়ংক্রিয় Wet Chemical Type Fire Suppression System থাকতে হবে। একটি সাধারণ অফিস বা শপিং এরিয়ার এবং একটি রেস্তোরাঁর জন্য অগ্নি সুরক্ষা ব্যবস্থা এক নয়৷ প্রতিটি রেস্তোরাঁয় লাইভ আগুন থাকে। রান্নার তেল এবং গ্যাস সিলিন্ডার স্টোর করার জন্য তাদের একটি ব্যবস্থা থাকা উচিত। কিন্তু এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে গ্রীন কোজি কটেজে এর কোন কিছুই ছিল না বরং সিঁড়ির প্রতিটি স্থানে ৫/৬ টি করে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার ছিল।

একটি রেস্তোরাঁর সাজসজ্জার জন্য যা ব্যয় করা হয় তার ৩০% অর্থ ব্যয় করে স্বয়ংক্রিয় অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা করা সম্ভব।

ভবন মালিক/ব্যবহারকারীর দায়িত্ব-

* বিএনবিসি অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করতে হবে।

* যথাযথ অনুমোদন এবং ব্যবস্থা ছাড়া অকুপেন্সি পরিবর্তন করা যাবে না।

* ফায়ার এক্সিট, ফায়ার ডোর, ইমার্জেন্সি লাইটিং সিস্টেম, ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম এবং ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে রাখুন।

* যেখানে প্রয়োজন সেখানে স্বয়ংক্রিয় ফায়ার স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম ইনস্টল করতে হবে।

* •বাণিজ্যিক রান্নাঘর/রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে Wet Chemical Type Fire Suppression System ইনস্টল করতে হবে।

* রান্নার তেল, এলপিজি গ্যাস এবং অন্যান্য দাহ্য সামগ্রী পৃথক ভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করতে হবে, এটি করার বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়।

* অগ্নি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আশ্রয় নেওয়ার জন্য বহুতল ভবনগুলিতে একটি নিরাপদ আশ্রয় স্থান রাখা উচিত।

* উচ্চ মানের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম , বৈদ্যুতিক তার এবং ওভেন ব্যবহার করা উচিত।

* সেন্ট্রাল এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেমে ফায়ার রেটেড ড্যাম্পার ব্যবহার ব্যবহার করা উচিত।

* প্রতি ৫৫০ বর্গফুট এলাকায় জন্য ন্যূনতম 6 কেজি ক্ষমতা সহ একটি CO2 বা ABC পাউডার ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করতে হবে।

* K ক্লাসের (cooking oil/fat) আগুনের জন্য Wet Chemical Type ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করতে হবে।

* নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করুন এবং সমস্ত বৈদ্যুতিক এবং সুরক্ষা সরঞ্জাম পরীক্ষা করুন।

* প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি প্রশিক্ষিত উদ্ধার ও অগ্নিনির্বাপক দল প্রয়োজন।

* প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার নিয়মিত ফায়ার ড্রিলের ব্যবস্থা করুন।

* বিল্ডিং কোডের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং ভবন গুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে বাধ্য করতে হবে।

* অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম আমদানি সহজ করতে হবে, বাণিজ্যিক ভবন সহ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে রপ্তানিমুখী কারখানার মতো অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম আমদানি করতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে হবে।

* অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহের উপর 7.5% ভ্যাট এবং অগ্নি নিরাপত্তা পরিকল্পনার পরামর্শ পরিষেবার উপর 15% ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে।

* ত্রুটিপূর্ণ এবং নিম্নমানের অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম আমদানি এবং বিপণন প্রতিরোধ করতে হবে।

* ব্যাংকগুলিকে সহজ শর্তে অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম ক্রয়ে বিনিয়োগ করতে উত্সাহিত করতে হবে।

* অগ্নি বীমা জনপ্রিয় করতে হবে।

* যারা আইন লঙ্ঘন করে বিপজ্জনক ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ করেন তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

* শিক্ষা ব্যবস্থায় অগ্নি নিরাপত্তা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে হবে।

* উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে ফায়ার সেফটি ইকুইপমেন্ট উৎপাদন ও বিনিয়োগ শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে।

* শহরের রাস্তা ও জলাধারে পর্যাপ্ত ফায়ার হাইড্রেন্ট তৈরি করতে হবে।

* প্রতিটি প্রাকৃতিক জলাধার কে সংরক্ষন করতে হবে, ব্যবহার উপযোগী করতে হবে এবং নতুন জলাধার তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠের নিচে বৃহৎ আকারের জলাধার তৈরি করা যেতে পারে।

* নতুন প্রযুক্তি এবং জনবলের মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা

জনসাধারণের দায়িত্ব:

* অনিরাপদ ভবন ভাড়া নেয়া, ক্রয় করা এবং ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন

* অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহারের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহন করুন

* বিল্ডিং কোড এবং অগ্নি নিরাপত্তা বিধান অনুযায়ী ভবন/কাঠামো নির্মাণ করুন

* প্রতিটি বাড়িতে, অফিসে, দোকানে, কারখানায় যথাযথ অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম স্থাপন করুন।

* সব ধরনের বৈদ্যুতিক এবং গ্যাসীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করুন

* সমস্ত নিরাপত্তা নির্দেশাবলী এবং চিহ্ন অনুসরণ করুন।

* দেশের আইন বাস্তবায়নে এবং একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে সকলকে সহযোগিতা এবং উৎসাহ প্রদান করুন।

লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইসাব

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে