শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

বিএনপির বর্ধিত সভা, নেতৃত্বের পালাবদল না ঐতিহ্যের অবিচল ধারা? 

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
  ০৩ মার্চ ২০২৫, ১৪:৩৮
আপডেট  : ০৩ মার্চ ২০২৫, ১৪:৪৩
বিএনপির বর্ধিত সভা, নেতৃত্বের পালাবদল না ঐতিহ্যের অবিচল ধারা? 
ফাইল ছবি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গত কয়েক মাসের ঘটনাবলি এক নতুন বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। হাসিনা সরকারের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র গণঅভ্যুত্থান তরুণদের নেতৃত্বে গণজাগরণের জন্ম দেয়। এর ফলে দেশে এক নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। এই সময়েই ঐতিহ্যবাহী বিরোধী দল বিএনপি গতকাল নয়াপল্টনে তাদের জাতীয় নির্বাহী কমিটির একদিনের বর্ধিত সভা করল। হাজার হাজার নেতাকর্মীর অংশগ্রহণে এটি ছিল এক ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক আয়োজন -এ যেন দলীয় সভার চেয়ে বিশাল এক সমাবেশ।

এই সভার মাত্র একদিন পরই ঢাকায় আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি, যা ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণে গঠিত। দুই পক্ষের এই কর্মসূচি যেন এক নতুন বার্তা বহন করে ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা।’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানের পরবর্তী পঙক্তির মতো- ‘তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা’ -এই দুটি শক্তি একে অপরের পরিপূরক হবে, নাকি পৃথক ধারায় প্রবাহিত হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

সংসদ ভবন কেন্দ্রিক প্রতীকী অবস্থান

ঢাকার শেরেবাংলা নগরে, স্থপতি লুই কানের নকশায় নির্মিত সংসদ ভবন আজ গণতন্ত্রের প্রতীক। বিএনপির বর্ধিত সভা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ, দুই আয়োজনই এই প্রতীকী স্থানকে ঘিরে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রমাণ করে যে উভয় পক্ষ সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করতে চায়।

বিএনপির নেতৃত্বে সূক্ষ্ম পরিবর্তনের ইঙ্গিত

বিএনপির এবারের বর্ধিত সভা শুধু রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চ ছিল না; এটি ছিল নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনারও এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। দলটির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের স্বল্পকালীন নেতৃত্ব অস্থির সময়ের জন্ম দিয়েছিল। এরপর বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্বে এসে বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং দলকে ক্ষমতায় এনেছেন। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল, বন্দিত্ব ও অসুস্থতার কারণে দলের কার্যকর নেতৃত্ব দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে বিএনপির নেতৃত্বে প্রজন্মগত পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

বেগম খালেদা জিয়া তার ভার্চুয়াল ভাষণে স্পষ্ট করেই বলেছেন, তার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমান দল পরিচালনায় সফল হয়েছেন। এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি কার্যত বিএনপির নেতৃত্ব তারেক রহমানের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে অর্পণ করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। অতএব, শহীদ জিয়া, সাত্তার ও খালেদা পর্বের পর বিএনপিতে এখন প্রকৃত অর্থে তারেক পর্বের সূচনা ঘটেছে।

বেগম খালেদা জিয়ার বার্তা: ঐক্য ও গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার ডাক বেগম জিয়া তার সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি পরিহারের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে একটি বাসযোগ্য, উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করব।’ তিনি সতর্ক করে দেন যে, ‘ফ্যাসিস্টদের দোসররা এখনো গণঅভ্যুত্থানের অর্জন ধ্বংস করতে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। ইস্পাত কঠিন ঐক্যের মাধ্যমে এই চক্রান্ত প্রতিহত করতে হবে।’

নতুন ও পুরনো রাজনীতির সমন্বয়, নাকি পৃথক গতি?

বিএনপির বর্ধিত সভার আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দল এখনো ঐতিহ্যগত সাংগঠনিক কাঠামো ধরে রেখেছে। পুরনো রাজনীতির পদ্ধতিতেই নেতৃত্ব নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, মনোনয়ন ও সাংগঠনিক কর্মকৌশলে বড় পরিবর্তনের আভাস নেই। এই অবস্থায় বিএনপি কি সত্যিই তরুণ প্রজন্মের নতুন রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে? নাকি তারা পুরনো ধারা বজায় রেখেই অগ্রসর হবে?

অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টির অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তরুণদের একাংশ নতুন রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার দিকে এগোচ্ছে। ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের এই তরুণ নেতৃত্ব কি বিএনপির সঙ্গে মিলিত হবে, নাকি ভিন্ন পথে এগোবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী কয়েক মাসে বাংলাদেশের রাজনীতি একটি নতুন গঠনতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হবে, যেখানে পুরনো ও নতুনের মধ্যে সমন্বয় কিংবা প্রতিযোগিতা দুটিই হতে পারে সম্ভাব্য দিকনির্দেশনা।

আগামীর দিকনির্দেশনা

বিএনপির এবারের বর্ধিত সভা মূলত একটি রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্র হলেও এর ভেতরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সুপ্ত ছিল—নেতৃত্বের পরিবর্তন অনিবার্য। তারেক রহমান এখন আনুষ্ঠানিকভাবে দলের প্রধান হয়ে উঠছেন এবং আগামী দিনের নির্বাচন ও দলীয় পুনর্গঠন তার হাতেই ন্যস্ত হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি কেবল নেতৃত্ব পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি পুরনো কাঠামোর মধ্যেই থেকে যাবে, নাকি তাদের রাজনীতি ও সাংগঠনিক সংস্কারে নতুন কিছু আনবে? আর ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের তরুণরা কি বিএনপির সঙ্গে ঐক্য গড়বে, নাকি তারা নিজস্ব রাজনৈতিক গতিপথ তৈরি করবে?

বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুব শিগগিরই আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র।

যাযাদি/ এসএম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে