অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বহুল প্রতীক্ষিত ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ বৈঠক শুরু হয়েছে লন্ডনে। আজ বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টার দিকে তারেক রহমান পৌঁছান ডরচেস্টার হোটেলে, যেখানে তাকে স্বাগত জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। এরপরই শুরু হয় দুই নেতার রুদ্ধদ্বার আলোচনা।
তারেক রহমান লন্ডনের কিংস্টন এলাকার নিজ বাসা থেকে রওনা হন দুপুর ১টার দিকে। বিএনপির মিডিয়া সেলের মতে, এই বৈঠক শুধুমাত্র দুই নেতার মধ্যে হলেও, এর তাৎপর্য গভীর এবং বহুমাত্রিক।
বাংলাদেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বৈঠকের তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গণআন্দোলনের প্রেক্ষিতে দেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তা এবার রূপ নিতে পারে একটি বাস্তব রাজনৈতিক সমঝোতায়। শুধু দেশের ভেতরেই নয়, বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও এই আলোচনাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছেন।
আলোচ্য বিষয়ে সম্ভাব্য দিকনির্দেশনা
বৈঠকের নির্দিষ্ট কোনো আলোচ্য বিষয় সরকারিভাবে ঘোষণা করা না হলেও, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যে আলোচনায় আসতে পারে তা ধারণা করা যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে:
* ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি
* জুলাই আন্দোলনের সময় চালানো নির্যাতনের দায় নির্ধারণ
* মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার
* রাজনৈতিক সংস্কার এবং "জুলাই সনদ" বাস্তবায়নতবে রাজনৈতিক মহল মনে করছে, এই বৈঠকের মূল কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে *নির্বাচনি রোডম্যাপ*।
এপ্রিল না ডিসেম্বর—নির্বাচনের সময় নিয়ে মতভেদ
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ঈদুল আজহার প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে ভাষণে ঘোষণা দেন, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অপরদিকে, বিএনপি ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায় এবং এ বিষয়ে অনড় অবস্থান নিয়ে এগোচ্ছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এপ্রিল মাস ভোটের জন্য অনুপযুক্ত—রোজা, ঈদ, এসএসসি পরীক্ষা এবং আবহাওয়াজনিত দুর্ভোগকে সামনে রেখে তারা এই দাবি করছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এমনকি হালকা ব্যঙ্গের সুরে বলেন, “প্রতিদিন ইফতার পার্টি করতে হবে, নির্বাচনের খরচ দ্বিগুণ হবে।”
অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান হলো—এপ্রিলের আগে নির্বাচন না হলে, প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে জুলাই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হতে পারে।
*সমঝোতার দিক: জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি?*
বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা জানিয়েছেন, ডিসেম্বর সম্ভব না হলে জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এমনকি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও এই অবস্থানের প্রতি সম্মতি জানিয়েছেন।
সেক্ষেত্রে এই বৈঠকে যদি জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো সমঝোতা হয়, তাহলে তা উভয়পক্ষের জন্য *উইন-উইন পরিস্থিতি* তৈরি করবে এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর একটি কার্যকর পথ খুলে দেবে।
বৈঠককে ঘিরে প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল এই বৈঠককে "রাজনৈতিক টার্নিং পয়েন্ট" হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “যদি সব কিছু ঠিকঠাক চলে, এটি হতে পারে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও একে একটি মাইলফলক বলেই মনে করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, “সরকার ও বিএনপির মধ্যে আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা নিরসনে এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”
সমঝোতার বাইরেও বড় দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন
তবে শুধু নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নয়, বরং এই দুই দূরদর্শী নেতার মধ্যে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক রূপরেখা নিয়েও আলোচনা হওয়া উচিত। যেমন:
* কীভাবে বাংলাদেশকে একটি কল্যাণরাষ্ট্রে রূপান্তর করা যাবে
* রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা
* ভবিষ্যতে যেন স্বৈরাচার বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেই নিশ্চয়তাযারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের সম্মান ও অবদান স্মরণ রাখার ব্যবস্থাও এই আলোচনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
লেখক : কলামিষ্ট, সমাজ সেবক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী ও রাজনীতিবিদ।