‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত এবং একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের কাছে দ্রæত ক্ষমতা হস্তান্তর প্রয়োজন।’ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সাম্প্রতিক এ বক্তব্যে দেশের রাজনীতি আকস্মিক নতুন মোড় নিয়েছে।
দ্রæত সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসা দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি সেনা প্রধানের এ বক্তব্যের পর দ্রæত নড়েচড়ে বসেছে। দলের নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে হাতে আর খুব বেশি সময় নেই। তাই স্বল্প সময়ের মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে দলের সাংগঠনিক কাঠামো আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল দূর ও প্রাথী নির্বাচনে করা জরুরি। একই সঙ্গে দ্রæততম সময়ের মধ্যে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং ছোট দলগুলোকে কাছে টানার কৌশলী তৎপরতা চালাতে হবে। এসব বিষয়গুলোতে সর্বো”চ গুরুত্ব দিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে স্থানীয় নির্বাচনের আগে কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচন নয়- এমন দাবিতে জামায়াত ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অনড় থাকলেও সেনা প্রধানের সাম্প্রতিক বক্তব্যের পর তারাও সতর্ক হয়ে উঠেছে। স্থানীয় নির্বাচনের ইস্যুতে গো ধরে থাকার সুযোগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জামায়াত ও এনসিপি দু’দলের ভরাডুবি হবে এমন আশঙ্কা তাদের পেয়ে বসেছে। তাই ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তারা যাতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে অংশ নিতে পারে তার পূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে।
অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনের পূর্ণ প্রস্ততি নিতে জামায়াতের সঙ্গে অন্যান্য ইসলামী দলের ঐক্য নিয়েও তৎপরতা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ ক্বওমী মাদরাসা কেন্দ্রিক বিভিন্ন দল আছে এই ঐক্যপ্রক্রিয়ায়। তবে এই জোট এখনই আত্মপ্রকাশ করছে না।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, জোট গঠনের প্রাথমিক আলাপ তারা আগেই সেরে রেখেছিলেন। এখন দ্রæত দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু করা হবে। তফসিল ঘোষণার পরপরই এ বিষয়ে দলের স্পষ্ট অবস্থান জানানো হবে। যাতে কোনো আসনে জোটের একাধিক প্রার্থী দেওয়া না হয়। তবে কোনো বিষয়ই এখনো চুড়ান্ত নয়।
আরেকটি সূত্র বলছে, তরুণদের নতুন দল এনসিপি বিএনপির নেতৃত্বে জোটে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেক্ষেত্রে নতুন এই দলকে কিছু আসন ছাড়তে পারে বিএনপি। আবার আসন নিয়ে সমঝোতা না হলে জামায়াত, নতুন দল এনসিপিসহ আরও কয়েকটি দল মিলে জোট বাঁধবে। তাই এসব ব্যাপারে স্বল্প সময়ের মধ্যে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি কার সঙ্গে জোট বাঁধবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে তোড়জোর আলোচনা শুরু করেছে বলে জানা গেছে। দলের দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, বিএনপির সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। তবে তাদের সঙ্গে জোট নিয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। তবে রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। কিন্তু দ্রæত এ বিষয়টি নিস্পত্তি করতে হবে। কেননা ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হলে তাদের অনেক কাজ সারতে হবে। নতুন দল হিসেবে তাদের অনেক ব্যাপারে জোরালো প্রস্তুতি নিতে হবে।
অন্য একটি সূত্র বলছে, বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে এনসিপির একজন নীতিনির্ধারককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সরকারের দুইজন প্রভাবশালী ব্যক্তি বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে শিগগিরই এ নিয়ে দৃশ্যমান কিছু অগ্রগতি দেখা যেতে পারে। এনসিপির একাধিক নেতা জানান, নতুন রাজনৈতিক দল হিসাবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাদের দল খুব শিগগির প্রতীক চূড়ান্তের পর নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু করবে। যখন নির্বাচন হবে তখন দেখা যাবে কে কোন জোটে যায়। সে সময় যে কারও সঙ্গেই জোট হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশের জনগণ জাতীয় নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে আছেন। জনগণ গত ১৫ বছর যে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকারের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, সেই অধিকার ফিরে পেতে চান। সবাই আশা করছে, ইসি দ্রæত সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে। একক নাকি জোটগতভাবে বিএনপি ভোটে অংশ নেবে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। নির্বাচন এলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হয়, তারপর সিদ্ধান্ত হয়। এদিকে আসন্ন ত্রয়োদশ নির্বাচনে ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, কিংবা দিনের ভোট রাতের আঁধারে দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না- এ বিষয়টি মাথায় রেখেই নির্বাচনের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিটি দলই নিজেদের মাঠের নেতাকর্মী গোছানোর তোড়জোর শুরু করেছে। তাদের মাধ্যমে কীভাবে ভোটারদের প্রভাবিত করা যায় তার কৌশলী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। একই সঙ্গে দলের যেসব নেতাকর্মী বিগত সময়ের নানা বিতর্কিত কর্মকাÐের জন্য সমালোচিত, তারা যাতে নির্বাচনী প্রচারণার মাঠে নেমে প্রার্থীর ভাবমূর্তি নষ্ট না করে সে ব্যাপারেও প্রতিটি দল সতর্ক হচ্ছে।
এদিকে জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী দলগুলো প্রার্থী চুড়ান্ত করার ব্যাপারে কিছুটা ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করলেও বিএনপি এ ব্যাপারে জোর কদমে হাঁটার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলের নীতি-নির্ধারকদের ভাষ্য, এ ব্যাপারে দলীয় হাইকমান্ড চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেও স্থানীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। তাই এ ব্যাপারে তারা আগেভাগেই চুলচেরা পর্যবেক্ষণ করতে চায়।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ত্রয়োদশ নির্বাচনের প্রাক-প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সারা দেশে কমিটিগুলোকে পুনর্গঠন করা হচ্ছে। জনশক্তির মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনা ও জনগণের সঙ্গে তাদের সংযোগ ঘটাতে ৩১ দফাকে নিয়ে সারা দেশে কর্মশালা আরও জোরেশোরে চালানো হবে। এবারের নির্বাচনে তরুণ, অভিজ্ঞ ও প্রবীণদের সমন্বয়ে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা সাজানো হচ্ছে বলে দলীয় সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। সংশ্লিষ্ট বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতিত শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে মুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করলেও নির্বাচনের মাঠে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রার্থী তালিকা তৈরিতে ১৬ বছরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ত্যাগী নেতারা মূল্যায়িত হবেন। সে সঙ্গে ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেওয়া জনপ্রিয় প্রার্থীদের মূল্যায়নও করা হবে।
এদিকে দলটির নেতাদের জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে এরই মধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর ধারাবাহিকতায় কোনো নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে অভিযুক্ত নেতার পদবি স্থগিত করা, পদাবনতি ঘটানো, এমনকি বহিষ্কারের মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, নির্বাচনের জন্য আমাদের দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি তো আছেই। নতুন করে প্রস্তুতির কোনো প্রয়োজন নেই। শিডিউল ঘোষণা হোক, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব।
প্রার্থী বিবেচনায় বিএনপির কৌশল সম্পর্কে দলের প্রথম সারির একজন নেতা বলেন, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। সে ক্ষেত্রে অনেকে প্রার্থী হতে চান। এ ক্ষেত্রে দল প্রথমে যেসব প্রার্থীর জনগণের সঙ্গে বেশি সম্পর্ক থাকবে, তাকে মূল্যায়ন করবে। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদ আন্দোলনে ভ‚মিকা, দলের দুর্দিনে ত্যাগ ও দলের প্রতি আনুগত্য রয়েছে- এমন ব্যক্তিদের মূল্যায়ন করবে। একইসঙ্গে যাদের মধ্যে জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিচক্ষণতা আছে, তাদের বিবেচনা করবে দল।
ভোটের জন্য দলের প্রস্ততি সম্পর্কে জামায়াতের দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, প্রথমত জামায়াত ৩০০ আসনেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে সঙ্গে এটাও বিবেচনায় নিয়েছে যে, অতীতে যেহেতু জামায়াত ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছে, এবারও যাতে ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে, সেজন্য প্রয়োজনে আবারও ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করবে। তবে নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা হলে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।