শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

‘জোট গঠন’ প্রক্রিয়ায় ইসলামী দলগুলো

যাযাদি ডেস্ক
  ০৪ জুলাই ২০২৫, ২১:২৮
আপডেট  : ০৪ জুলাই ২০২৫, ২৩:০৮
‘জোট গঠন’ প্রক্রিয়ায় ইসলামী দলগুলো
ইসলামী দলগুলোর লগো নিয়ে প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিকে বড় শক্তি মনে করছে ইসলামি দলগুলো। ফলে বিএনপির পাল্টা শক্তি হতে তৎপরতা চলছে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে। চলছে নানা মেরুকরণ। যদিও তৎকালীন আওয়ামী সরকারের শাসনামলে সরকার ঘেঁষা ইসলামী দলগুলো জোট গঠনের চেষ্টা করেছে বারবার। কিন্তু সফল হতে পারেনি।

কিন্তু দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসলামী দলগুলোর জোট গঠন আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কেননা এখানেও রাজনৈতিক দলগুলোর রয়েছে নানা স্বার্থ। এ নিয়ে পর্দার আড়ালে চলছে নানামুখী তৎপরতা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে নানা রকম মেরুকরণ হচ্ছে। নির্বাচনে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো চায় একক প্রার্থী ঘোষণা করতে। ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামী ৩শ’ আসনে প্রার্থী তালিকাও প্রায় চূড়ান্ত করেছে। শেষ পর্যন্ত ইসলামপন্থিদের রাজনীতির মেরুকরণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, এই প্রশ্নে এসব দলের মধ্যেই চলছে নানা আলোচনা।

জামায়াতসহ অন্য ইসলামী দল নির্বাচনী জোট কিংবা বৃহত্তর সমঝোতার দিকে এগোচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। সমঝোতা হলে অন্য দলগুলো প্রার্থী মনোনয়নে একে অপরকে ছাড় দেবে। দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ইসলামী দলকে একই প্ল্যাটফর্মে আনতে কাজ করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

সম্প্রতি জামায়াতে আমির বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন নয়। তিনি এজন্য আইনশৃঙ্খলার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। বলেছেন, ‘মব’ পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আগে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সেজন্যই আমরা সংস্কারের কথা বলছি। মৌলিক সংস্কার ছাড়া ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়।

জানা গেছে. যেসব দলের নিবন্ধন এবং ভোটব্যাংক রয়েছে সেসব দলই এই সমঝোতা প্রক্রিয়ায় থাকছে। অর্থাৎ ৮টি ইসলামী দলের মধ্যে সমঝোতা হবে। মধ্যপন্থি দল, যেমন এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টিকেও (এনসিপি) জোটে আনার ক্ষেত্রে আলোচনা চলছে। এ নিয়ে অনেকটা ব্যস্ত সময় পার করছেন লিয়াজোঁ কমিটির সদস্যরা।

তবে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সমঝোতা বা নির্বাচনী জোটের কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা চলছে। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হলে সবকিছু দৃশ্যমান হবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় থাকছে না অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ‘বিএনপির সঙ্গে জোট’ গড়ার পক্ষে সংগঠনটি।

গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর দেশে রাজনীতির চিত্র বদলে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা ‘নির্ধারণ’ হওয়ায় বিএনপিসহ মিত্ররা সন্তুষ্ট। এর পরই নির্বাচনের প্রস্তুতিতে নেমেছে বিএনপিসহ দলগুলো।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে একটি বৃহত্তর নির্বাচনী ঐক্য বা সমঝোতা করতে চায় জামায়াতের ইসলামী। সেক্ষেত্রে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকেও পাশে চায় তারা। এরই মধ্যে উভয় দলের মধ্যে বেশ কিছু বৈঠক হয়েছে।

তবে জামায়াতে ইসলামীর এক সময়ের কট্টর সমালোচক ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নির্বাচনী সমঝোতা প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে। কেননা, একসময় জামায়াত নিয়ে কট্টর সমালোচনা করেছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শীর্ষ নেতারা।

জামায়াতে ইসলামী ‘কোনো ইসলামী দল নয়’ এমন কথাও বলেছেন তারা। যদিও জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, দেশ ও উম্মাহ এবং ইসলামের স্বার্থে কোনো সমালোচনা বা প্রতিবন্ধকতা নির্বাচনী সমঝোতাকে ঠেকাতে পারবে না। এখন আর অতীত নিয়ে পড়ে থেকে লাভ নেই।

জামায়াত নিয়ে সমালোচনা সত্ত্বেও একসঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা কী করে হবে—এ প্রশ্নের উত্তরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব এবং দলের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করছি। সেটি শুধু ভোটের জন্য। বৃহত্তর স্বার্থে আমরা ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে একক প্রার্থী দেওয়ার চিন্তা করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘তা ছাড়া বিএনপিও তো জামায়াত নিয়ে বহুবার বহু কথা বলেছে, সমালোচনা করেছে। তবুও তো বিএনপি-জামায়াত জোটও করেছিল। সুতরাং নির্বাচনী সমঝোতার জন্য কোনো সমস্যা হবে না।’

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিমও বলেন, ‘অতীতে কে কী বলেছে সেটি খুব একটা বিবেচ্য নয়। বরং দেশ এবং উম্মাহর স্বার্থে আগামীতে ভালো কী করা যায়, সেটিই মুখ্য। গতানুগতিক চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এখন বৃহত্তর স্বার্থে সবার মধ্যে দায়িত্ববোধের সূচনা হয়েছে। দলের নাম আলাদা হতে পারে, কিন্তু ইসলাম তো সবাই চায়।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে যে নির্বাচনী জোট বা সমঝোতা হবে, সেখানে থাকছে ৮টি ইসলামী দল।

সেগুলো হচ্ছে—বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত আন্দোলন।

এসব দলের রয়েছে লিয়াজোঁ কমিটি। এর মধ্যে প্রথম ছয়টি দলের ভেতরে আলোচনা জোরালো হচ্ছে। এ ছাড়াও এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ এবং এনসিপিও সমঝোতায় আসার ক্ষেত্রে আলোচনায় রয়েছে। এই দলগুলোর দায়িত্বশীল পর্যায়ের নেতারা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এরই মধ্যে লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা একাধিক বৈঠক করেছেন। আবারও বৈঠক হবে। বিভিন্ন ইস্যুতে সরাসরি, কখনো মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হচ্ছে। মূলত, তারা চান একটি কার্যকরী নির্বাচনী সমঝোতা বা জোট। যাতে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য আরও দৃঢ় ও শক্তিশালী হয়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় পর নির্বিঘ্নে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন শুরু করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

একপর্যায়ে গত বছরের ১৫ আগস্ট থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করে দলটি। এর মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ১২ দলীয় জোট, জাকের পার্টি, লেবার পার্টি, খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজী আন্দোলন অন্যতম।

এ ছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির আব্দুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমীসহ ব্যক্তিপর্যায়ে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের আমির পৃথকভাবে বৈঠক, মতবিনিময় করেন।

এসব বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জামায়াতে ইসলামী দেশের ইসলামী অন্য দলগুলোর মধ্যে একটি ঐক্য ও সমন্বয় চায়। এ লক্ষ্যে জামায়াত এরই মধ্যে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে একটি যোগাযোগের সম্পর্ক তৈরি করেছে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত কওমিধারার আলেমদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের যে বিরোধ বা বিতর্ক, সেটি কমেছে। এখন নির্বাচনী সমঝোতার দিকে ঝোঁক জামায়াতের।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ কোনো জোটে বা সমঝোতায় থাকবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম অরাজনৈতিক সংগঠন। নির্বাচন নিয়ে বা নির্বাচনী সমঝোতা নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা নেই। তবে হেফাজতে থাকা বিভিন্ন দল কোনো জোটে বা সমঝোতায় পৃথকভাবে যেতে পারে।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে