কোথায় সেই নাদুস-নুদুস ভুঁড়ি? মাঠে নামলেই যা স্পষ্ট দেখা যেত। কোথায় সেই হাত-পায়ের বাড়তি মেদ? যার জন্য দৌড়তে সমস্যা হত। ভুঁড়ি নেই। বরং এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মুখমণ্ডলের চিবুক। গাল, ঘাড় থেকে শুরু করে শরীরের বাকি জায়গার মেদও উধাও হয়ে গিয়েছে সরফরাজ় খানের।
মাত্র দেড় মাসে নিজেকে বদলে ফেলেছেন ব্যাটার সরফরাজ়। ফিটনেসে জোর দিয়েছেন। ৮৬ কেজি থেকে ১০ কেজি ওজন ঝরিয়ে তিনি এখন ৭৬ কেজি। অর্থাৎ, সরফরাজ় ২.০। সরফরাজ় থেকে সরফরাজ় ২.০ হওয়ার সাক্ষী তাঁর বাবা নওশাদ। তাঁর কাছেই জানা গেল সরফরাজের পরিবর্তনের কাহিনি।
সুনীল গাওস্করের মতো কিংবদন্তি ব্যাটার ব্যাট ধরেছিলেন সরফরাজ়ের হয়ে। বলেছিলেন, ওজন নয়, একজন ব্যাটারের পারফরম্যান্স দেখা উচিত নির্বাচকদের। কিন্তু তা দেখা হয়নি। কারণ, আধুনিক ক্রিকেটে ফিটনেস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত ভারতের মতো দলে, যেখানে ‘ইয়ো ইয়ো টেস্ট’ পাস না করলে প্রথম পঞ্চদশেও জায়গা পাওয়া যায় না, সেখানে তো ফিটনেসের গুরুত্ব আরও বেশি। সেই কারণেই নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে ১৫০ রান করেও ভারতের টেস্ট দলে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছেন সরফরাজ়।
গত অস্ট্রেলিয়া সফরে রিজ়ার্ভ বেঞ্চেই কেটে গিয়েছে। জায়গা হয়নি প্রথম একাদশে। কিন্তু সরফরাজ় চান আবার ভারতীয় দলে ফিরতে। তিনি জানেন, নিজেকে না বদলালে সেই সুযোগ কম। প্রায় নেই। আরও কী বুঝেছেন সরফরাজ়? বুঝেছেন, তাঁর ব্যাটিংয়ে বিশেষ খামতি নেই। খামতি তাঁর ফিটনেসে। টেস্ট ক্রিকেটে পাঁচ দিন খেলার ধকল, মাঠে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফিল্ডিং করার জন্য দরকার পেটানো চেহারা। যে কারণে হয়তো এমন অনেকে ভারতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছেন, যাঁদের ব্যাটিং প্রতিভা তাঁর তুলনায় কম। কিন্তু তাঁদের নড়াচড়া অনেক ক্ষিপ্র। সরফরাজ় তাই তাঁর নতুন যাত্রা শুরু করেছেন। মেদ ঝরানোর যাত্রা। সুযোগ যাতে আর হাতছাড়া না হয়।
সরফরাজ় ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে পরিচিত নাম। মুম্বইয়ের হয়ে ধারাবাহিক ভাবে বড় রান করেছেন। তার পরেও জাতীয় দলে জায়গা না পেয়ে এক সময় ‘বিদ্রোহ’ করেছিলেন। সরাসরি মুখ খুলেছিলেন বোর্ডের বিরুদ্ধে। অবশেষে গত বছর ইংল্যান্ড সিরিজ়ে দলে জায়গা পান তিনি। চোখে জল নিয়ে পুত্রের অভিষেকের সাক্ষী ছিলেন সরফরাজ়ের বাবা নওশাদ। তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে কোচ হিসাবে পরিচিত। পুত্রের সব লড়াইয়ের সঙ্গী তিনিও। এ বার নওশাদ সঙ্গী হয়েছেন পুত্রের নিজেকে বদলে ফেলার যুদ্ধেও। বস্তুত, সরফরাজ়ের বাবা শুধু নন, গোটা পরিবার ওজন কমানোর যুদ্ধে নেমেছেন! সকলে মিলেই লড়াই জিততে চান তাঁরা। সেই লড়াইয়ের বিবরণ জানিয়েছেন সরফরাজ়ের জনক।
লড়াই খুব সহজ ছিল না। পছন্দের চিকেন ও মটন বিরিয়ানি ছাড়তে হয়েছে সরফরাজ়কে। এমনকি, ভাত-রুটিও বন্ধ। অর্থাৎ, তাঁর খাদ্যতালিকায় কোনও কার্বোহাইড্রেট নেই, যা শরীরকে রসস্থ করে। মন্থর করে। খাদ্যাভ্যাস পুরোপুরি বদলে ফেলেছে গোটা পরিবার। নওশাদের কথায়, “পরিবারের সকলে মিলেই ওজন কমানোর যুদ্ধে নেমেছি। ডায়েট পুরো বদলে ফেলেছি। ভাত, রুটি, চিনি বন্ধ। দেড় মাস ধরে ও সব খাইনি। তার বদলে সব্জি খাচ্ছি বেশি করে। ব্রকোলি, গাজর, শশা, স্যালাড-সহ বিভিন্ন সব্জির দিকে মন দিয়েছি। চিকেন, ডিম সমস্তই সেদ্ধ করে খাচ্ছি। আর খাচ্ছি গ্রিন টি এবং গ্রিন কফি।”
ফলও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন নওশাদ। শুধু সরফরাজ়ের ক্ষেত্রে নয়, তিনি নিজেও এই কড়া ডায়েটের সুফল পেয়েছেন। নওশাদ বললেন, “সরফরাজ় দেড় মাসে ১০ কেজি ওজন কমিয়েছে। আরও কমানোর চেষ্টা করছে। আমার ওজনও ১২ কেজি কমেছে। আমার হাঁটুতে সমস্যা আছে। আগে চিকিৎসক বলেছিলেন, হাঁটু বদলাতে হবে। কিন্তু ওজন কমিয়ে ফেলেছি বলে এখন আর তার প্রয়োজন নেই। আমার ছোট ছেলে মইনও ওজন কমিয়েছে।”
শুধু খাদ্যাভ্যাস নয়, দিনের গোটা রুটিনই বদলে ফেলেছেন পিতা-পুত্র। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত নিজেদের তৈরি রুটিনও জানিয়েছেন নওশাদ। গত দেড় মাস ধরে তাঁরা এই রুটিন মেনে চলছেন। নওশাদ বললেন, “ভোর সাড়ে ৫টায় বাড়ি থেকে বেরোই। ১৫ কিলোমিটার দূরে ক্রস ময়দানে যাই। সেখানে প্রথমে ওয়ার্ম আপ করি। তার পর সরফরাজ় কিছু ক্ষণ দৌড়য়। দৌড়ের পর ফিল্ডিং অনুশীলন করে। তার পরে ব্যাট করে। সাড়ে ১০টা নাগাদ বাড়ি ফিরে প্রাতরাশ সেরে বিশ্রাম নিই।”
সন্ধ্যায় মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার জিমে যান সরফরাজ় ও নওশাদ। সপ্তাহে ছ’দিন। জিমে ঢোকার আগে সরফরাজ় আধ ঘণ্টা করে দৌড়ন আর সাঁতার কাটেন। সেই সময়টা হনহন করে হাঁটেন নওশাদ। তার পরে জিম শুরু হয়। রাতে বাড়ি ফিরে নৈশভোজ সেরে ঘুম।
জিম ও শারীরিক কসরতের পাশাপাশি নিজের ব্যাটিং নিয়েও বাড়তি পরিশ্রম করছেন সরফরাজ়। নওশাদ জানেন, শেষ পর্যন্ত রানই আসল। তাই সরফরাজ়ের ব্যাটিং অনুশীলনে কোনও খামতি যাতে না হয়, সে দিকেও নজর রয়েছে তাঁর। দিনে তিন বার ব্যাটিং অনুশীলন করেন সরফরাজ়। নওশাদ বললেন, “সকালে ক্রস ময়দানে সরফরাজ় লাল বলে ব্যাট করে। বাড়ি ফিরে প্রাতরাশের পর আবার ব্যাট করতে নামে। আমাদের বাড়িতেই পিচ আছে। সেখানে প্রতি দিন অন্তত ৫০০ বল খেলে। সামনে টেস্ট সিরিজ় আছে বলে দ্বিতীয় দফার ব্যাটিং অনুশীলনও হয় লাল বলে। তার পর সন্ধ্যায় জিমের পর আবার ব্যাট করে। তখন সাদা বলে।”
বিরাট কোহলি টেস্ট থেকে অবসর নেওয়ায় ভারতের মিডল অর্ডারে একটা জায়গা ফাঁকা। সেই চার নম্বর জায়গাটা নেওয়ার লড়াইয়ে রয়েছেন অনেকে। শ্রেয়স আয়ার, লোকেশ রাহুলের পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করা করুণ নায়ারও দলে ঢোকার চেষ্টা করছেন। সরফরাজ় জানেন, তাঁর জায়গা পাওয়া কঠিন। কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? সেই লক্ষ্যেই নিজেকে বদলানো। ভারত ‘এ’ দলের হয়ে রান করে নির্বাচকদের নজরে পড়তে হবে তাঁকে। দ্বিতীয় বার সুযোগ পেলে যাতে ফিটনেস ‘অন্তরায়’ হয়ে না দাঁড়ায়।