শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
মহামারি করোনাভাইরাস

ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় ঠেকানো যাবে না ওমিক্রনের সংক্রমণ!

ভাইরাসটি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে : আশঙ্কা টিকা নিয়েছেন এমন ব্যক্তিদের দেহে এটি শনাক্ত হয়নি
ম যাযাদি ডেস্ক
  ২৮ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০

দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট (ধরন বা রূপ) 'ওমিক্রন' নিয়ে উদ্বিগ্ন গোটা বিশ্ব। ফলে বিধিনিষেধ জারি করতে শুরু করেছে বহু দেশ। কিন্তু শনিবার হংকংয়ের এক ভাইরাসবিদ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েও ঠেকানো যাবে না ওমিক্রনের বিস্তার। তবে আশার কথা হলো, দক্ষিণ আফ্রিকার মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান অ্যাঞ্জেলিক কোয়েৎজ জানিয়েছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের সংক্রমণে অসুস্থতার মাত্রা তীব্র নয়, বরং হালকা মাত্রার হয়। সংবাদসূত্র : বিবিসি, রয়টার্স

ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের ভাইরাসবিদ বেন কাউলিং বলেন, 'ভাইরাসটি বিভিন্ন স্থানে সম্ভবত ছড়িয়ে পড়েছে। তাই আমরা যদি এখন দরজা বন্ধ করি, তাহলে সম্ভবত অনেক দেরি হয়ে যাবে।'

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগের সংক্রামক রোগ বিষয়ক সংস্থা 'ইমপেরিয়াল ডিপার্টমেন্ট অব ইনফেকশাস ডিজিজ'র একজন ভাইরোলজিস্ট নতুন এই ভ্যারিয়েন্টকে 'ভয়াবহ' ও 'এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে খারাপ ধরন' বলে বর্ণনা করেছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার 'সেন্টার ফর এপিডেমিক রেসপন্স অ্যান্ড ইনোভেশন'র পরিচালক টুলিও ডি অলিভিয়েরা বলেন, এই ভ্যারিয়েন্টের মিউটেশনের ধারা অস্বাভাবিক এবং অন্যান্য ভ্যারিয়েন্ট থেকে এটি অনেক ভিন্ন। তার ভাষায়, 'এই ভ্যারিয়েন্ট আমাদের অবাক করেছে। বিবর্তনের হিসেবে এবং পরবর্তী মিউটেশনের হিসাব করলে এটি কয়েক ধাপ লাফ দিয়েছে।'

দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়াজুলু-নাটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড লেসেলস বলেন, 'মিউটেশনগুলো ভাইরাসকে সংক্রমণে, এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে ছড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শক্তিশালী করেছে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। ইমিউন সিস্টেমের (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) বিভিন্ন অংশকে পাশ কাটিয়ে শরীরে প্রবেশ করার সক্ষমতাও থাকতে পারে এগুলোর।' ফলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে এই ভাইরাস আটকানো সম্ভব বলে মনে হলেও তা বাস্তবভিত্তিক নয় বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীদের একাংশ। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এরই মধ্যে শীত মৌসুম শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে দু'টি অঞ্চলে বহু মানুষ ক্রিসমাস উদযাপনে জড়ো হচ্ছেন। সেই হিসেবে সংক্রমণ বিস্তারের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে সেখানে।

উলেস্নখ্য, ক্রমাগত জিন বিন্যাস বদলের ফলে সংক্রমণ ক্ষমতাও বেড়েছে করোনাভাইরাসের কয়েকটি নতুন প্রজাতির। ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশে আরও সংক্রামক রূপের সন্ধান মেলার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের একাংশ।

দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা এবং হংকংয়ে পাওয়া নতুন রূপটির আবির্ভাব হয়েছে প্রায় ৫০ বার জিনের বিন্যাস বদলে। এর মধ্যে ৩২ বার বদলেছে স্পাইক প্রোটিনের চরিত্র। যা দেখে ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা, ভবিষ্যতে স্পাইক প্রোটিনের বিন্যাস বদলের আরও 'রেকর্ড' তৈরি হতে পারে। সেই সঙ্গে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে করোনাভাইরাস।

সদ্য পাওয়া ওমিক্রন রূপটি স্পাইক প্রোটিনের বারবার বদলে মানবদেহে অনুপ্রবেশে আরও দক্ষ হয়ে উঠেছে বলেই মনে করছেন তারা। ভাইরাস বিজ্ঞানী তুলিও দে অলিভিয়েরা বলেছেন, 'নতুন রূপটি (ওমিক্রন) জিনের পরিব্যক্তির নজির তৈরি করেছে।' তবে জিনগত চরিত্র বদলের ধারা এখানেই থেমে থাকবে না বলে মনে করেন তিনি।

এর আগেও করোনাভাইরাসের নতুন আবিষ্কৃত হওয়া ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছিল। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে আতঙ্ক শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। চলতি বছরের গোড়ার দিকে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক তৈরি করেছিল 'বেটা' ভ্যারিয়েন্ট। কারণ ইমিউন সিস্টেমকে পাশ কাটিয়ে শরীরে প্রবেশ করার সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি ছিল ওই ভ্যারিয়েন্টের। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দ্রম্নত সংক্রমিত হওয়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই বেশি ভয়াবহ হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবি গুপ্ত বলেন, 'বেটা শুধু ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দিত, আর কিছু না। ডেল্টার সংক্রমণের ক্ষমতা ছিল বেশি। নতুন ভ্যারিয়ন্টের এই দুই ধরনের ক্ষতি করারই সামর্থ্য রয়েছে।' তিনি বলেন, ল্যাবরেটরিতে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় গবেষণার মাধ্যমে নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে আরও পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রকৃতিতে এই ভাইরাস কেমন আচরণ করে, তা পর্যবেক্ষণ করলে আরও দ্রম্নত উত্তর পাওয়া সম্ভব।

গত মঙ্গলবার করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের কথা জানান দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা। শনিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভ্যারিয়েন্টটির নাম দেয় 'ওমিক্রন'। বহুবার মিউটেড বা রূপ পরিবর্তন করা এই ভেরিয়েন্টকে 'উদ্বেগজনক' বলেও আখ্যা দিয়েছে সংস্থা। দক্ষিণ আফ্রিকার মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান অ্যাঞ্জেলিক কোয়েৎজ বলেন, 'এটি মৃদু রোগের উপসর্গের সঙ্গে পেশিতে ব্যথা এবং এক বা দুই দিনের জন্য ক্লান্তি বোধ সৃষ্টি করে। ভাইরাসটি সংক্রমিতের স্বাদ বা গন্ধের ক্ষতি করে না বলে এখন পর্যন্ত আমরা জানতে পেরেছি। আক্রান্তদের হালকা কাশি হতে পারে। কোনো বিশিষ্ট লক্ষণ নেই। আক্রান্তদের মধ্যে কয়েকজন বর্তমানে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।'

এই কর্মকর্তা জানান, ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে এমন রোগীদের চাপ হাসপাতালে নেই এবং টিকা নিয়েছেন এমন ব্যক্তিদের দেহে এই ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়নি। তবে টিকা নেননি এমন ব্যক্তিদের বেলায় পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। অ্যাঞ্জেলিক বলেন, 'আমরা কেবল দুই সপ্তাহ পর এগুলো জানতে পেরেছি। হঁ্যা, এটি সংক্রামক, তবে চিকিৎসাবিদ হিসেবে আমরা এখনো জানি না, কেন এতবার রূপ বদল করেছে, আমরা এখনো বিষয়টি অনুসন্ধান করছি। ৪০ বছর ও তারচেয়ে কম বয়সি কিছু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পুরো বিষয়টি আমরা দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর জানতে পারব।'

উলেস্নখ্য, দক্ষিণ আফ্রিকার গওতেং প্রদেশে এখন পর্যন্ত ৭৭ জনের মধ্যে নিশ্চিতভাবে এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়া বতসোয়ানায় চারজন এবং হংকংয়ে একজন এই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হয়েছেন। পরীক্ষায় এই ভ্যারিয়েন্টটি কিছুটা অদ্ভুত ফল দেয় এবং তার মাধ্যমে এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের ধারা অনুসরণ করা সম্ভব। তাই ধারণা করা হচ্ছে, গওতেং প্রদেশের ৯০ শতাংশ কেসই আসলে এই ভ্যারিয়েন্ট এবং দক্ষিণ আফ্রিকার অধিকাংশ প্রদেশেই এর উপস্থিতি রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই পরিসংখ্যানের মাধ্যমে এখনো ধারণা দেওয়া যাচ্ছে না, ভ্যারিয়েন্টটি ডেল্টার চেয়ে দ্রম্নতগতিতে ছড়াবে কি না? আশঙ্কা থাকছেই, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এই ভ্যারিয়েন্টটির বিস্তার ঠেকানো হয়তো সম্ভব হবে না।

উলেস্নখ্য, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। এরপর এটি দ্রম্নত সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাসটিতে এ পর্যন্ত ২৬ কোটি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৫২ লাখের বেশি মানুষ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে